Disclaimer: This novel is entirely fictional. It has no resemblance to reality. If by chance any character or any particular event of this novel matches with anyone’s life, then this novel will not be responsible for that in any way. Moreover, this novel is not written to hurt anyone’s religious and political sentiments.
পরেরদিন সন্ধ্যায়…
গতকালের সে ঘটনার পর থেকে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত এখনো স্বাভাবিক হতে পারিনি। তাই বিকেলে এক বোতল হুইস্কি আনিয়েছিলাম গ্রামের এক ছোকরাকে দিয়ে। কারণ একটুবাদে আমি যা করতে যাচ্ছি তা স্বাভাবিক মস্তিষ্কে ডিল করতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। সত্যি বলতে একেবারে নিকট মানুষদের সাথে জঘন্য আচরণ করা বাধ্য হয়ে পড়েছে। একজন হচ্ছেন বিজন দাদা। ছোটবেলা থেকেই জানি যে, এই গ্রামে তিনি সবার দাদা।
এই গ্রামের সব গল্প শুরু হয় তার এই চায়ের স্টল থেকে আবার শেষও হয় এখানে। অথচ, আজ তাকে জেরা করতে হবে; তার সাথে খারাপ আচরণ করে সত্যটা বের করতে হবে। আর অন্যদিকে আছেন আমার পিতৃতুল্য ‘মিজানুর হুজুর’। এই গ্রামের একজন মাথা। যিনি আমায় ছোট থেকে আদব-কায়দা শিখিয়ে বড় করে তুলেছেন। আজ তার সাথেও এসপার-ওসপার করতে হবে। ভাবতেও কষ্ট লাগছে।
বিজন দাদার চায়ের দোকানে প্রবেশ করতেই তিনি তাড়াহুড়ো করে কাউকে ফোন করে চা স্টলে আসতে বললেন। আর আমি চা স্টলে গিয়ে আস্তে করে বসলাম। অবাক করার মতন বিষয় হচ্ছে, আজ চায়ের দোকানটা বেশ ফাঁকা, মানে কেউ নেই আমি ছাড়া। অবশ্য এরকম পরিবেশই আমার জন্য আজ ভালো হবে। প্রথমে আমি কথা বলতে শুরু করলাম,
আমি: তা বিজন দা… ও বিজন দা? আপনার এলাকার সব সুস্থ আছে তো?
বিজন দা খুব ভয় পেয়ে বললো: তুমি এসব কি ভুল বকছো?
এবার আমি পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে টেবিলে রাখলাম। অমিতের দেয়া ‘MP-443 Grach’। এরমধ্যে হঠাৎ মিজানুর হুজুর সামনে এসে বসলেন। তিনি এক কাপ চা নিয়ে বসেছেন।
আমি: হুজুর, আপনি?
হুজুর: কাউকে হুমকি-ধমকি দেবার আগে একটু বুঝে শুনে। আমার শেখানো আদব তুই কি ভুলে গেছিস? বড়দের সাথে এ কেমন আচরণ?
আমি: তারমানে আপনিও ছিলেন? এই পুরোটা আপনাদেরই সাজানো… হায়!
বিজন দাদা: এলাকায় তো তোমরা থাকো না। এই গ্রামে থাকি আমরা। তোমরা হঠাৎ শহর থেকে এসে যা খুশি তাই করে যাবে তারপর তার ভোগান্তি আমরা পোহাবো!
হুজুরে চোখ লাল করে বললেন: অতিরিক্ত ভালোবাসা শুধু মানুষকে মহৎ বানায় না, কখনো কখনো এই ভালোবাসা শত্রুর চেয়েও আমাদের নিকৃষ্ট বানায়।
আমি: ওহুম, আপনাদের কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনারা দুজনে মিলে কিছু করতে চাইলে তা যে কোনো সময় করতে পারতেন। এত নাটকীয়তা কেন?
বিজন দাদা: কারণ, নাটক সবাই পছন্দ করে। ধরো, কোনো স্ট্রাগল করলে না, কোনো ফাইট করলে না অথচ এমনিতেই রাজ্যসহ রাজকন্যা পেয়ে গেলে ব্যাপারটা কেমন হয়?
হুজুর: আর তোদের বিয়েটা আমি পড়াতে চাই। কিন্তু কি অজুহাতে তোদের বিয়ে পড়াবো? এত সহজ ভাবছিস?
আমি: এই দেখুন, এখন কিন্তু আমার নেশা চড়ে গেছে। ভালোই ভালোই সব বলুন নতুবা নিজেই নিজের মাথার খুলি উড়িয়ে দেবো। আর এ কি! বিজন দাদা! এত স্পষ্ট প্রমিত বাংলায় কথা বলছেন যে!
হুজুর: মানে হচ্ছে, গ্রামের লোককে আমরাই রাগিয়ে তুলেছিলাম। এই ধর্মাধর্মের বেড়াজাল নিয়ে। স্বাভাবিক, ওরা যদি আঘাত না করতো তাহলে আমিও পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারতাম না।
আমি: তাই বলে আমাকে একেবারে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করবেন?
বিজন দাদা: ধূর, সত্যিই চড়ে গেছে দেখছি! এরা তোমার কাছে খুবই ঠুনকো। আমরা শুধু দায় নেবো না সেটা নিশ্চিত করা এবং আমাদের সন্তানকে সুখী দেখা। আর অভিভাবক হিসেবে এটাই আমাদের কর্তব্য।
হুজুর: ভালোবাসার টেস্টামেন্ট বলতে পারিস।
আমি: হুজুর! আপনি কি এখন পবিত্র কুরআন পাশে রেখে বাইবেল পড়ছেন নাকি!
হুজুর: এবার তুই কিন্তু চড় খাবি বলে দিলাম। আগামীকাল সকাল সকাল মেয়েটকে নিয়ে আমার বাড়িতে আয়।
ঝিমানো থেকে কিছুটা মুক্তি পেতেই বাড়িতে ফিরলাম। আমাদের সেই মাটির বাড়ি। কারো সাথে তেমন একটা কথা বললাম না। সরাসরি নিজের রুমে চলে আসলাম। এখানে মাটি যেন শুষে নিচ্ছে আমার ভেতরে থাকা সমস্ত বিষ। একটুবাদে শিহাব এসে খাবারের জন্য ডেকে গেল। খুব সম্ভবত স্নেহার সাথে ওমন আচরণ করা আমার উচিত হয়নি। আমি আরো চিন্তা করে কথাগুলো বলতে পারতাম অথবা পুরো ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে পারতাম। কারো অতীত খুঁড়ে তেমন কি লাভ!
স্নেহা যদি আমার অতীত খুঁড়তে বসে? তাহলে সেটা কি আমার জন্য ভালো হবে। যে অতীতে কেউ একজন ছিলো। আমি যে আধা-সত্য গল্পে স্নেহার মন জয় করেছি তার শেষটা যদি স্নেহা কখনো জেনে যায় তবে ভালো হবে না। একদমই ভালো হবে না।
রাত ১০টা, রাতের খাবারের টেবিলে…
খাবারের টেবিলে সব হালকা খাবার। মেনু অর্ডার কিছুটা এরকম – ভাত, ডাল, ভর্তা, ভাজা, বাটা, শাক, পোলাও এবং দই-মিষ্টি। কিহ্! বাবা সবাই ডায়েটে আছে না কি! অবশ্য স্নেহা আজ দায়িত্ব নিয়েছে সবাইকে খাবার দেবার। দেখে বুঝার জো নেই ওর ওপর দিয়ে গতকাল এক বিশাল ঝড় বয়ে গেছে। একদম নিরব দেখে মা বোধহয় কিছু একটা টের পেয়েছেন।
মা: তা স্নেহা, গতকাল তোমরা কোথায় বের হয়েছিলে?
স্নেহা মায়ের পাশে বসে খেতে খেতে বললো: প্রথমে স্কুলে, তারপর চেয়ারম্যানের বাড়ি হয়ে দীঘি…
স্নেহা: কিন্তু স্নেহা মা, ফেরার সময় তুমি গতকাল একা ফিরলে যে! কি হাসান? ঝগড়া করেছিস?
আমি: ইয়ে মানে…
স্নেহা: নাহ্ মা, আপনার ছেলের বন্ধু আমিত এসেছিলো। এখন ওখানে আমি থাকি কেমন করে বলুন? এতদিন পর দুই পুরনো বন্ধুর দেখা! কত জমানো গল্প থাকতে পারে কে জানে…
শিহাব: হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার ভাই আর অমিত ভাই একত্র হলে তো কোনো কথা হবে না সেখানে। রুশ বিপ্লব থেকে শুরু করে বর্তমানের রাশিয়া-ইউক্রেন পর্যন্ত একবার রিভিশন হয়ে যায়… আপনি চলে এসে ভালো করেছেন।
শিহাব কথা বলা শেষে মুচকি মুচকি হাসছে। ওর সাথে সায় দিলো মা আর স্নেহা। মানে এদের দেখে সত্যিই কিছু বুঝে ওঠা মুশকিল। খাবার শেষে মা তার রুমে ডাকলেন। রুমে প্রবেশ করতেই দেখি স্নেহা আর মা দুজনে একসাথে বসে আছে। স্নেহার লম্বা চুলের দায়িত্ব নিয়েছে মা, গুছিয়ে দিচ্ছে। মা বোধহয় কিছু বলতে চান। অবশ্য আমার মত অনুভূতি শূন্য মানুষকে তেমন কিছু কোনো বাবা-মায়ের বলার থাকে না। কিন্তু নিশ্চয় জরুরী কিছু আছে।
এক পর্যায়ে মা বলা শুরু করলেন,
“হাসান, আমি জানি খুব কম সময়ের জন্য তুই বাড়িতে এসেছিস। আবার দ্রুত ফিরে যাবি। তোদের এই সাহায্য আমাদের জন্য খুব দরকার ছিলো। কিন্তু যাবার আগের এই মূহুর্তে কিছু বলতে চাই, আর তা হলো, স্নেহা খুব ভালো একটা মেয়ে। ওর মত আর কাউকে পাবি না। সত্যি বলতে, প্রথম প্রথম আমারও একটু খটকা লাগছিলো এই ভেবে যে, দুই ধর্মের দুটো মানুষ একসাথে এক জীবন পাড়ি দিবে কি করে! কিন্তু আস্তে আস্তে তোদের পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম, আর কেউ না পারুক, তোরা পারবি। ভালোবাসার উপরে কিছু নেই। চারদিকে এত এত অন্ধকার, আমি চাই তুই এই অন্ধকারে আলো নিয়ে আয়। কেবল আলো-ই পারে এই অন্ধকার কে ঘোচাতে। আমার কথা রাখবি তো বাবা?”
আমি: নিশ্চয়, মা। কিন্তু ঐ টাকাগুলো আমার নয়, মা। ওটা স্নেহার। প্রথমে ভেবেছিলাম, এটা বলবো না। কিন্তু তোমার কাছে আমি এটা আর গোপন রাখতে চাই না। যাকগে, আমি চাই তুমি নিজের একটু যত্ন নাও। অপারেশন টা এবার করে নিও। আমার পক্ষে তোমাকে সামনে খুব বেশি সময় দেওয়া সম্ভব হবে না।
স্নেহা: হাসান! পাশের রুমে এসো। আমার সাথে তোমার কিছু কথা আছ। আর মা, আপনি অনুমতি দিলে আজ রাতটা আমি হাসানের সাথে থাকতাম।
মা: তোদের ঝগড়া হয়েছে তাই না? আমি কিন্তু আগেই টের পেয়েছিলাম। ঠিকাছে, যাও। আর আল্লাহ্ তোমাদের অনেক অনেক ভালো রাখুক।
আচ্ছা, মাটির ঘর গরম হয় কি? হলেও কেমন গরম হয়? যে এই তাপে আপনি ঘেমে একাকারও হয়ে যেতে পারেন! স্নেহা আমার রুমে এসে খাটের একপাশে চাদর জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পড়েছে। পাশের টেবিলে দু’গ্লাস জল রাখা। আর একটা পিল। জল টা আমি খেয়ে নিলাম।
স্নেহা: এখনো অভিমান করে আছো?
আমি: নাহ্, কীসের জন্য অভিমান করবো?
স্নেহা: কথায় কথায় এমন অভিমান করলে নির্বাচনে অংশ নেবে কি করে? বিশেষ করে ‘সূবর্ণা’ যখন তোমার প্রতিপক্ষ।
আমি: অমিত সব বলে দিয়েছে?
স্নেহা: নাহ্, অনেকদিন ধরেই তোমার লেখা ছোট্ট নোট খেয়াল করতাম। চুপচাপ বসে থাকো আর কি যেন হিব্রু অক্ষরে দুই চার লাইন ওখানে লিখো। তারপর সেটা আবার সাটিয়ে রাখো নিজ টেবিলের ওপর। একদিন বুঝলাম ওসব হিব্রু ভাষা আর রোমান সংখ্যা নয়। ওসব তোমার মোর্স কোড।
আমি: তারপর তুমি একদিনের মধ্যে পুরো মোর্স কোড বুঝে ফেললে! হাস্যকর!
স্নেহা: তুমে ভুলে যাচ্ছো এখন ইন্টারনেটের জমানা, “… ..- …- .- .-. -. .- / .. … / — -.– / — .–. .–. -.. — -. -. – / .. -. / .-. .- .— -… .- .-. .. /” এই মোর্স কোডের অনুবাদকৃত অর্থ হলো, “’Suvarna’ is my opponent in Rajbari.”
আমি: ঠিকাছে, এজন্যে আমার কি সাজা হওয়া উচিত?
স্নেহা: সাজার প্রশ্ন আসছে কীভাবে?
আমি: মিথ্যে বলা, ঠকানো…
স্নেহা: ওহ্, তুমি আবার মানুষকে ঠকাতেও পারো নাকি?
এরপর স্নেহা আবার মুচকি মুচকি হাসছে…
“দেখো, হাসান, সূবর্ণাকে আমি চিনি। তোমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে, পাশের বিভাগে। খুব সম্ভবত বাংলা বিভাগ। নিশ্চয় সূবর্ণা তোমার জন্য যোগ্য প্রতিপক্ষ। মানে গ্রেট অরেটর। পাক্কা স্টুডেন্ট পলিটিক্স করা মেয়ে না হলে ওমন বিস্ফোরক ভাবে কোন স্পিচ দেওয়া যায় না। কিন্তু ভিন্ন অর্থে, তোমার আমার কাছে থেকে সূবর্ণা কে লোকানো স্বাভাবিক।”
আমি: পুরো গল্পটা মিথ্যে নয়। আমি শুধু চেয়েছি তুমি বর্তমান টা না জানো। এতে আঘাত পাবে।
স্নেহা: উঁহু! এখন যে সব জেনে গেলাম। আমার হবু স্বামী আমাকে তার অতীত সম্পর্কে জানাতে এত কুন্ঠাবোধ করবে জানতাম না।
আমি: আমি দুঃখিত!
স্নেহা: এই দুই শব্দ বলতে এত সময় লাগলো, হাসান?
আমি: কাউকে হারানোর ব্যাথা তুমি জানো। আর ওমন করে আমিও জানি। এত সহজ হয় না মুভ অন করা।
স্নেহা: এত টেম্পটিং কেন তুমি! ইশ্! মা কে টাকার কথাটা না বললে চলতো না বুঝি?
আমি: স্নেহা, আমায় বিয়ে করবে?
স্নেহা: তাহলে বুঝি আমায় তোমার বিশ্বাস হবে! তাহলে আগামীকাল বিয়েটা করেই রওনা দেই? কি বলছো?
আমি: হুজুর যেতে বলেছেন। শুধু আফগানিস্তানের রাজধানীর নাম মনে রেখো। ওটার অর্থ হলো ‘রাজী’
স্নেহা বেশ লজ্জা পেয়েছে। আসলে এই সব প্রশ্ন-উত্তর এবং তার দুর্দান্ত কাউন্টার দিতে দিতে কখন জানি আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা হয়ে গেছে।
স্নেহ শুধু বললো: ইট গোস টু ফার, হাসান!… শোন, আগামীকাল বিয়েটা করেই রওনা দেবো।
জীবন কি অদ্ভুত। ক’টা দিন আগেও কত অচেনা ছিলাম আমি নিজের কাছে, এই পৃথিবীর কাছে। এখন আমার কর্মসংস্থান হচ্ছে, বিয়ে হচ্ছে। আর আমিও একদিন বাবা হবো!
‘দত্ত পরিবার’ উপন্যাসের ১১তম পর্ব পড়ুনঃ উপন্যাস: দত্ত পরিবার (পর্ব – ১১)