ওসিডি: একটি মারাত্মক মানসিক সমস্যা
ওসিডি কি? লক্ষণ, কারণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
মানসিক সমস্যাগুলোর মধ্যে ওসিডি একটি মারাত্মক মানসিক সমস্যা। যা স্বাভাবিক ভাবে সমস্যা মনে না হলেও এটি খুবই মারাত্মক একটি সমস্যা। আজকের বিষয় হল ওসিডি কি? এর লক্ষণগুলো কি কি? কি কি কারণে এই রোগটি হয়ে থাকে? এর চিকিৎসা কি? এসব বিষয় নিয়ে।
ওসিডি কি?
ওসিডি (অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার) হল এমন একপ্রকার সমস্যা যা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি সবসময়ই অনর্থক, যুক্তিহীন চিন্তা করে এবং সেই চিন্তা অনুযায়ী কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে।
অর্থাৎ, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এক অযৌক্তিক চক্রের মধ্যে আটকে পড়েন। যেমন বারবার হাত ধোয়া, জিনিসগুলি পরীক্ষা করা বা পরিষ্কার করা ইত্যাদি যা একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন কার্যকলাপ এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়াতে উল্লেখযোগ্যভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
এর ফলে রোগীর মানসিক চিত্রে, বাসনায় এক অবাঞ্ছিত চিন্তার সৃষ্টি হতে পারে যা তার মানসিক যন্ত্রণার কারণ হিসেবে পরিগণিত হয়। আর এই সমস্যাটি শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবার মধ্যেই দেখা যেতে পারে।
ওসিডি এর লক্ষণ
- চিন্তার পুনরাবৃত্তি: এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির চিন্তার পুনরাবৃত্তি হয় যা উদ্বেগ বা উৎকন্ঠার সৃষ্টি করে।
- ধর্ম ও যৌনতা নিয়ে অতিরিক্ত নিষিদ্ধ চিন্তা: ধর্ম ও যৌনতা নিয়ে অতিরিক্ত নিষিদ্ধ চিন্তা চেতনা কাজ করে।
- বারবার একই কাজ করা: বারবার একই কাজ করা এর একটি বড় লক্ষণ। যেমন, গ্যাস বন্ধ করা হয়েছে কিনা অথবা দরজার তালা দেওয়া হলো কিনা তা দিনে বারবার খোঁজ নেওয়া।
- জিনিসপত্রকে অতিরিক্ত নিখুঁত ভাবে সাজিয়ে রাখা: জিনিসপত্রকে অতিরিক্ত নিখুঁত ভাবে সাজিয়ে রাখা যাকে বলা যায় অত্যন্ত নির্দিষ্ট রীতিতে রাখা।
- বারবার গণনা করা: বারবার গণনা করা।
- আক্রমণাত্বক চিন্তাভাবনা: সবসময় একটা আক্রমণাত্বক চিন্তাভাবনা করা।
- জীবাণু ও দূষণের ভয়ে অতিরিক্ত হাত ধোয়া: জীবাণু ও দূষণের ভয়ে অথবা মনে সন্দেহ পোষণ করে অতিরিক্ত হাত ধোয়া বা পরিষ্কার করা।
ওসিডি এর কারণ
- মস্তিষ্কের ক্ষতি: মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব ক্ষতির সম্মুখীন হলে অথবা বেসাল গ্যাংলিয়ার কর্মক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে মানুষ এই ভয়ংকর রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
- জিনগত ও পরিবেশগত কারণ: জিনগত এবং পরিবেশগত কারণেও এই ওসিডিতে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে।
- সেরোটোনিনের অস্বাভাবিক মাত্রা: অস্বাভাবিক রকম নিম্ন মাত্রায় সেরোটোনিনের উপস্থিতির ফলেও এই ওসিডিতে আক্রান্ত হতে পারে।
ওসিডি এর চিকিৎসা
প্রথমত, যদি আপনার কাছের কোনো মানুষের মধ্যে এমন লক্ষণগুলো দেখেন তখন তাকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এরপর চিকিৎসক শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষার মাধ্যমে ওসিডিতে রোগী আক্রান্ত কি না তা নির্ণয় করবেন। এরজন্য তিনি জিজ্ঞেস করবেন যে, উপরোক্ত লক্ষণগুলির মধ্যে কতগুলি উপসর্গ রোগীর দৈনন্দিন জীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে?
দ্বিতীয়ত, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। তিনি মেডিসিন অথবা থেরাপি অথবা ডীপ ব্রেন স্টিমুলেশন এর কথা বলবেন। এর যেই চিকিৎসাটা রোগীর প্রয়োজন তারা সেটায় পরামর্শ দিবেন। যেমন:
- ওষুধ: মস্তিষ্কের স্বাভাবিক রাসায়নিক ভারসাম্য ফেরাতে এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। ওসিডির উপসর্গ তথা লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য তারা বিভিন্ন প্রকার ওষুধ প্রদান করে থাকেন। এর ফলে রোগী আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণে আসে।
- সাইকোলজিকাল থেরাপি: এই থেরাপি অবসেসিভ চেতনা ও ভয়ভীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হেল্প করে। তাই একজন সাইক্রিয়াটিস্ট রোগীর অবস্থা বুঝে সাইকোলজিক্যাল থেরাপি সাজেস্ট করেন।
- ডীপ ব্রেন স্টিমুলেশন: এই চিকিৎসা করা হয় তাদের ক্ষেত্রে যারা অন্তত পাঁচ বছরব্যাপী ওসিডিতে ভুগছেন। এই প্রক্রিয়ায় রোগীর মস্তিস্ককে ইলেকট্রোডের সাহায্যে হালকা বৈদ্যুতিক প্রবাহ পাঠানো হয় এবং এর ফলে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।
এগুলো ব্যাতিত আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ বা উপদেশ তারা প্রদান করেন:
- নিয়মিত মেডিটেশন ও ডীপ-ব্রিদিং এক্সারসাইজ: নিয়মিত মেডিটেশন, ডীপ-ব্রিদিং এক্সারসাইজ ইত্যাদি করতে বলা হয়। এগুলো রোগীদের স্ট্রেস ও টেনশন কমানোর জন্যে খুবই কার্যকর।
- পর্যাপ্ত ঘুম ও শারীরিক পরিশ্রম: চিকিৎসকগণ পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম এবং শারীরিক পরিশ্রম তথা ব্যায়ামের পরামর্শ দেন এবং একই সাথে অ্যালকোহল আর নিকোটিন বর্জন করতে বলেন।
ওসিডি রোগীদের জন্য নিষিদ্ধ খাদ্য
- সুগারি ফুড: ওসিডি রোগীদের জন্যে সুগারি ফুড বেশ ক্ষতিকর। যেমন; সুগারি ড্রিঙ্ক, সোডা, ক্যান্ডি, অন্যান্য মিষ্টি জাতীয় তথা অতিরিক্ত শুক্রজ জাতীয় খাদ্য খাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। কেননা এই খাবারে রোগীর উৎকণ্ঠা আর প্যানিক অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- কফি ও অ্যালকোহল: কফি, অ্যালকোহল খাওয়া এই রোগীদের একদম নিষেধ। তবে খুব বেশি হলে দু’-এক কাপ চা খেতে পারে।
- ফল: সব ধরনের ফল খাওয়া ওসিডি রোগীদের জন্যে ভালো।
- মাছ ও মাংস: ওসিডি যেহেতু সবচেয়ে কঠিন ধরনের অ্যাংজাইটি নিউরোসিস তাই এই রোগীদের খাদ্যতালিকায় মাছ এবং মাংস রাখা যাবে না।
ওসিডি সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ওসিডিতে ২% থেকে ৩% লোক আক্রান্ত হয়ে থাকে। আর এটি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে পুরুষদের তুলনায় মহিলারা কিছুটা হলেও বেশি প্রভাবিত হয়।
ওসিডি শৈশব বা কৈশোর অথবা প্রথম দিকেই শুরু হয়। তবে গড়ে এটি ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তাই নিজের এবং কাছের মানুষের একটু লক্ষ্য রাখবেন যেন তারা কেউ এমন সমস্যায় ভুগলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
ওসিডি সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
ওসিডি কি নিরাময় যোগ্য?
ওসিডি নিরাময় যোগ্য একটি রোগ। যথাযথ চিকিৎসা ও থেরাপির মাধ্যমে এই রোগের লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ওসিডি রোগীদের জন্য কি কি খাদ্য নিষিদ্ধ?
ওসিডি রোগীদের জন্য সুগারি ফুড, কফি, অ্যালকোহল ইত্যাদি নিষিদ্ধ। তবে ফল ও সবজি খাওয়া উপকারী।
ওসিডি রোগীদের জন্য কি কি ব্যায়াম করা উচিত?
ওসিডি রোগীদের জন্য নিয়মিত মেডিটেশন, ডীপ-ব্রিদিং এক্সারসাইজ, যোগ ইত্যাদি করা উচিত।
ওসিডি রোগীদের জন্য কি কি ওষুধ প্রয়োগ করা হয়?
ওসিডি রোগীদের জন্য এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ, সাইকোলজিকাল থেরাপি, ডীপ ব্রেন স্টিমুলেশন ইত্যাদি প্রয়োগ করা হয়।
ওসিডি রোগীদের জন্য কি কি পরিবেশগত পরিবর্তন করা উচিত?
ওসিডি রোগীদের জন্য পরিবেশগত পরিবর্তন হিসেবে পর্যাপ্ত ঘুম, শারীরিক পরিশ্রম, অ্যালকোহল ও নিকোটিন বর্জন করা উচিত।
আজ এই পর্যন্তই। আবারও নতুন কিছু নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ।