মনোবিজ্ঞান

ব্যক্তিত্বের ব্যাধি: একটি গুরুত্বপূর্ণ মানসিক সমস্যা

ব্যক্তিত্বের ব্যাধি কি? লক্ষণ, কারণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

প্রতিদিন আমরা চোখের সামনে বিভিন্ন ধরনের মানুষ দেখি। একেকজন একেক রকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কিন্তু কোন বৈশিষ্ট্যগুলো সুস্থ মানুষের আর কোন বৈশিষ্ট্যগুলো অসুস্থ মানুষের তা অনেক সময় বুঝতে পারি না। সেজন্য আজ একটু ভিন্ন রকমের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব। এটিও একটি মানসিক রোগ যার নাম, ‘Personality Disorder’ বা ‘ব্যক্তিত্বের ব্যাধি’। বিষয়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে ব্যক্তিত্বের ব্যাধি সম্পর্কে জানার আগে ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের জানা উচিত।

ব্যক্তিত্ব কি?

ব্যক্তিত্ব বলতে আমরা কি বুঝি? ব্যক্তিত্ব বলতে আমরা ব্যক্তির চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং আচরণের উপায়কে বুঝি। যা একজন ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তির হতে আলাদা করতে সাহায্য করে। কোনও ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বা Personality তার অভিজ্ঞতা, পরিবেশ এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রভাবিত হয়।

ব্যক্তিত্বের ব্যাধি কি?

Personality Disorder বা ব্যক্তিত্বের ব্যাধি হল, এক ধরনের মানসিক ব্যাধি যেখানে মানুষের চিন্তাভাবনা, কাজ এবং আচরণের একটি অনমনীয় এবং অস্বাস্থ্যকর দিক রয়েছে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিস্থিতি, লোকেদের বুঝতে এবং সম্পর্ক তৈরিতে সমস্যা হয়।

এটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে, সামাজিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে, বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। এমনকি স্কুলেও উল্লেখযোগ্য সমস্যার সৃষ্টি করে। এটি এমন একটি সমস্যা যা অনেক সময় বোঝায় যায় না যে, এই ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের ব্যাধি রয়েছে। কারণ তার চিন্তাভাবনা এবং আচরণগুলোকে স্বাভাবিক বলে মনে হবে।

এতে ব্যক্তির যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয় তা সে সহজেই অন্যকে দোষারোপ করতে পারে। একারণেই এটি একটি জটিল সমস্যাও বটে। ব্যক্তিত্বের ব্যাধিগুলি আচরণ এবং অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতার ফলে আস্তে আস্তে প্রকাশ পায় যা কৈশোরে বা শৈশবকালের প্রথম দিকে শুরু হয়। আর এটি ক্রিয়াকলাপে সমস্যা সৃষ্টি করে। চিকিৎসা ব্যতীত এই ব্যক্তিত্বের ব্যাধি দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে।

ব্যক্তিত্বের ব্যাধির ধরণ

১. অসামাজিক ব্যক্তিত্বের ব্যাধি

এই অসামাজিক ব্যক্তিত্বের ব্যাধিগ্রস্থ ব্যক্তি সামাজিক রীতিনীতিগুলো মেনে চলতে পারে না। বারবার মিথ্যা বলা বা অন্যের সাথে প্রতারণা করা এদের অভ্যাস। অর্থাৎ এরা সবসময় সমাজের নীতির বিরুদ্ধে থাকতে চায়।

২. পরিহারকারী ব্যক্তিত্বের ব্যাধি

এই ব্যাধির বৈশিষ্ট্য হলো অত্যন্ত লাজুক, অপ্রাপ্তির অনুভূতি এবং সমালোচনার প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীলতা এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির। পরিহারকারী ব্যক্তিত্বের ব্যাধির মানুষ সহজে অন্যদের সাথে মিশতে চায় না। এরা সবসময় অন্যদের পরিহার করতে ভালোবাসে।

৩. বর্ডারলাইন ব্যক্তিত্বের ব্যাধি

এই বর্ডারলাইন ব্যক্তিত্বের ব্যাধি সমস্যাটি ব্যক্তিগত সম্পর্কের অস্থিরতার একটি দিক। এই রোগীর তীব্র আবেগ এবং দুর্বলতা কাজ করে। এই ধরনের ব্যক্তিরা পরিত্যক্ত হওয়া, বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা, অনুপযুক্ত রাগ বা শূন্যতা বোধ করা এড়াতে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে থাকেন।

৪. নির্ভরশীল ব্যক্তিত্বের ব্যাধি

এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অন্যের উপর নির্ভর না করে প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে। নিজের যত্ন নিতে বা সমস্যাগুলো সমাধান করতে অক্ষম হওয়ার ভয়ে তারা যখন একা থাকে তখন অস্বস্তি বা শক্তিহীন বোধ করে।

৫. নারকিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে অন্যের প্রতি সহানুভূতির অভাব দেখা যায়। নারকিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির আত্ম-গুরুত্ব, অধিকারের বোধ, সহানুভূতির অভাব ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।

বিজ্ঞাপন

৬. পারক্সিজমাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার

এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা প্রায় সময়ই মনে করে যে মানুষ তাদের ক্ষতি করবে বা তাদের সাথে প্রতারণা করবে। এই কারণে এই রোগীরা অন্যদের বিশ্বাস করতে চায় না এবং অন্যের নিকটেও আসতে চায় না।

ব্যক্তিত্বের ব্যাধির কারণ

১. জিনগত কারণ

কিছু ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য মানুষ উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়ে থাকে। অর্থাৎ পিতামাতার মাধ্যমে সন্তান তাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লাভ করে। ফলে পিতা মাতার এই রোগ হলে সেখান থেকে সন্তানেরও হতে পারে।

২. পরিবেশগত কারণ

একজন মানুষের জন্য পরিবেশটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ মানুষ যে পরিবেশে বড় হয় সেই পরিবেশে যে ঘটনাগুলি ঘটে তা পরিবারের সদস্য এবং অন্যদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাই সেখান থেকেও এই সমস্যা হতে পারে। আর ব্যক্তিত্বের ব্যাধিগুলিকে এই জিনগত এবং পরিবেশগত প্রভাবগুলির সংমিশ্রণ দ্বারা সৃষ্ট বলেই মনে করা হয়।

যদিও ব্যক্তিত্বের ব্যাধিগুলির সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা যায়নি তবুও কিছু কিছু কারণ ব্যক্তিত্বের ব্যাধির জন্য মনে করা হয়।

  • পারিবারিক ইতিহাস: অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের ব্যাধি বা অন্যান্য মানসিক অসুস্থতা জনিত এমন কোন সমস্যা থাকলে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
  • শৈশবকালের আপত্তিজনক, অস্থির বা বিশৃঙ্খল পারিবারিক জীবন: এর ফলেও মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
  • শৈশব আচরণ ব্যাধি: নির্ণয় করার জন্যও এটি হতে পারে।
  • মস্তিষ্কের রসায়ন এবং গঠনে তারতম্য: এর কারণেও হতে পারে।

ব্যক্তিত্বের ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব কি?

এই সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এর জন্য কিছু সাইকোথেরাপি আছে যা ব্যক্তিত্বজনিত অসুবিধাগুলি নিরাময়ে কার্যকর। আর এই সাইকোথেরাপি একজন ব্যক্তিকে অন্যের উপর তার আচরণের প্রভাবগুলি বুঝতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয় কেমন আচরণ করতে হবে, কীভাবে সমাজে বাস করতে হবে এই বিষয়গুলো বুঝতেও সাহায্য করে।

তবে এই চিকিৎসার ধরণটি সমস্যা নির্দিষ্ট করণের উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্বের ব্যাধি, তার তীব্রতা এবং স্বতন্ত্র অবস্থার উপর নির্ভর করে এই চিকিৎসা করা হয়।

পরিশেষ

কারো যদি ব্যক্তিত্বের ব্যাধির কোন লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে তবে অবশ্যই ডাক্তারকে দেখানো উচিত। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে ব্যক্তিত্বের ব্যাধিগুলি জীবনে উল্লেখযোগ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)

ব্যক্তিত্বের ব্যাধি কি সারাজীবন থাকে?

না, ব্যক্তিত্বের ব্যাধি সারাজীবন থাকতে পারে না। সঠিক চিকিৎসা এবং থেরাপির মাধ্যমে এই ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

ব্যক্তিত্বের ব্যাধির লক্ষণগুলো কি?

ব্যক্তিত্বের ব্যাধির লক্ষণগুলো হলো অস্বাভাবিক চিন্তাভাবনা, আচরণের অস্থিরতা, সামাজিক সম্পর্কে সমস্যা, এবং দৈনন্দিন কাজে অসুবিধা।

ব্যক্তিত্বের ব্যাধি কি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায়?

হ্যাঁ, ব্যক্তিত্বের ব্যাধি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যেতে পারে। জিনগত কারণগুলো এই ব্যাধির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

ব্যক্তিত্বের ব্যাধির চিকিৎসা কি কার্যকর?

হ্যাঁ, ব্যক্তিত্বের ব্যাধির চিকিৎসা কার্যকর। সাইকোথেরাপি এবং ঔষধের মাধ্যমে এই ব্যাধির লক্ষণগুলো কমানো যায়।

সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ।

সেলিনা আক্তার শাপলা

I'm Shelina Akter Shapla. I work as a content writer for the Ovizatri - News & Magazine online news portal. Additionally, I am a co-founder of this website along with the admin, MD Mehedi Hasan. I also have another identity: I have completed my Master's degree from the Department of Philosophy at Rajshahi University.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button