বাংলাদেশে ‘Hierarchy’ এর অবস্থান: সামাজিক ন্যায়বিচারের সন্ধানে
বাংলাদেশে ‘Hierarchy (অনুক্রম, যাজকতন্ত্র, দেবদূতগণ)’ চরম বাজে পর্যায়ে অবস্থান করছে। এখানে শ্রেনী কাঠামো উগ্র এবং জটিল। স্তর/শ্রেনী বিন্যাসে প্রায় আক্ষরিক অর্থে এখানের ‘Hierarchy’ কে দেবদূত হিসেবে বললেও খুব ভুল বলা হয়তো হবে না।
ভিন্ন বিচারে ‘Hierarchy’ ঐ পর্যন্ত ঠিকাছে যে পর্যন্ত একটি সিস্টেম তূলনামূলক ভালো পারফর্ম করতে পারে। কিন্তু এই বিচার রাখার আগেও আমাদেরকে খুব গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে। কিছু ইতিহাসের তথ্য ও উপাত্ত সম্পর্কে জানতে হবে।
১৯০১ সালের ব্রিটিশ জনশুমারি অনুযায়ী হিন্দু সম্প্রদায় মোট জনসংখ্যার (পশ্চিম ও পূর্ব বাংলা) ৪৪.৩℅ শতাংশ ছিলো এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যা ৫৪.২% শতাংশ এবং বাকি ০.৭% শতাংশ খ্রিস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায় ছিলো।
সর্বশেষ সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য আদমশুমারী ২০১১ অনুযায়ী শুধু বাংলাদেশে যথাক্রমে একাধিক ধর্মের জনসংখ্যা ছিলো মোট জনসংখার ইসলাম ধর্ম ৯১.০৪% শতাংশ, হিন্দু ধর্ম ৭.৯৫℅ শতাংশ, বৌদ্ধ ধর্ম ০.৬১% শতাংশ, খ্রিস্টান ধর্ম ০.৩০% শতাংশ এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ আছেন ০.০৯% শতাংশ।
হিন্দু বা সনাতন ধর্ম এই উপমহাদেশে দীর্ঘসময় ধরে টিকে আছে এবং এই ধর্ম প্রায় পুরো উপমহাদেশ একধরণের জ্ঞানীয় এবং প্রভুত্ব নিয়ন্ত্রণ করে। এরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অন্য যে কোন ধর্মের চেয়ে এই উপমহাদেশে এগিয়ে। এই নিয়ন্ত্রণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভালো হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের ‘Hierarchical Order of The Pyramid’ -এ খুব বাজে ভাবে আঘাতও করেছে।
এই উপমাদেশে দীর্ঘসময় দুটো বড় ধর্ম (হিন্দু ও মুসলিম) সহাবস্থান করায় একে অন্যকে অনেক সাহায্য করেছে এবং দাঙ্গাও করেছে আবার একে অন্যের থেকে অনেক সংস্কৃতি বা প্রথা ধারও করেছে। অন্যদিকে কনভার্টেড মুসলিমরা ইসলাম ধর্ম কে মানেন কিন্তু কিছু সংস্কৃতি বা প্রথার প্রতি বিশ্বাস পুরোপুরি হয়তো ছাড়তে পারেন নাই। যার কিছুর অংশ অত্যন্ত ভালোও বটে।
কারো কারো মতে মানে বিশেষ করে ‘WhatsApp University’ তে পড়েছেন বা পড়ছেন তাদের মতে, বাংলায় শুধুমাত্র কনভার্টেড বা ধর্মান্তরিত মুসলিম বিদ্যমান যা পুরোপুরি ভুল তথ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে সবাই কনভার্টেড মুসলিম নয়। এই অঞ্চলের ইতিহাস বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মিশ্রণে সমৃদ্ধ।
ইসলাম ধর্মের প্রবেশ ঘটে প্রধানত ৮ম শতাব্দীতে, যখন আরব বণিক, সুফি ও ধর্মপ্রচারকরা বাণিজ্য ও ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে এই অঞ্চলে আসে। তবে, ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান, পারসি এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও বসবাস করে থাকেন, যা এই অঞ্চলের বহুস্তরীয় সংস্কৃতির প্রতিফলন করে।
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ধর্মান্তরিত মুসলিমদের উপস্থিতি ছিল বটে, কিন্তু এটি সমগ্র জনসংখ্যার একটি অংশ মাত্র। উপমহাদেশের ধর্মীয় বৈচিত্র্য এবং সংস্কৃতির সমৃদ্ধি একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য যা এই অঞ্চলকে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা করে তোলে।
ইসলামে বর্ণপ্রথা না থাকলেও খুব সুন্দর ও হালাল প্রক্রিয়ার এক ধরণের বর্ণপ্রথা এখানে প্রচলিত। আমি কিছু বংশের নাম লিখছি এসব নাম দেখেই আপনি বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবেন,
- চৌধুরী
- তালুকদার
- শেখ
- খান
- সিদ্দিকী
- মোল্লা
- আহমেদ
- মির্জা ইত্যাদি
দীর্ঘসময় বাঙালী বা বাংলাদেশী সমাজ এই সব বংশের মানুষকে উচু স্তরের মানুষ হিসেবে বিবেচনায় নিতেন। শুধু তাই নয়, বাংলায় (বাংলাদেশে) বড় বড় প্রতিষ্ঠান এবং বড় বড় অবস্থান শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু বংশের মানুষদের দখলে ছিলো; আজও তাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। হোক সেটা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, বিচারক, আমলা, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এই বংশের মানুষদের দেখা আপনি নিশ্চয় পাবেন। আমাদের বাংলায় কমার্শিয়াল সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খানের আসল নাম হলো ‘মাসুদ রানা’।
বাংলার মুসলিমরা হিন্দুদের এই বর্ণপ্রথা যা আবার অনেক হিন্দুরাও মানেন না সেটা অতি আগ্রহে ও সাগ্রহে গ্রহণ করেছেন। আজও কথা বলার সময় দেখবেন যে কিছু বংশের লোকের ব্যবহার দাম্ভিকতায় ভরা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এবং পুঁজিবাদী সিস্টেমের ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশ একটি ‘Wealth Driven’ সমাজে পরিণত হয়েছে। টাকা নাই! তাহলে বংশের নাম ধুয়ে খাও।
আমাদের দেশে দীর্ঘসময় বাথরুম পরিষ্কার করার জন্য নিচু বর্ণের ‘অস্পৃশ্য (Untouchable)’ মানুষদের ডাকা হত। কখনো কখনো তারা নিজে এসেই কোন পাড়া বা মহল্লায় মানুষদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করতেন। এখনও এই আধুনিক সমাজে আমাদের মধ্যে ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও এই মানুষদের আমরা ব্যক্তি স্বাধীনতা দিতে পারি নাই। এসব আমার ‘Lived Memory’ তে আছে।
আমার দাদু অনেক ধান চাষ করতেন। আমি দেখেছি ধান কাটার সময় আজও বহু মানুষ এদেশের কোন এক প্রান্ত থেকে আসেন এবং কম মূল্যে ধান কেটে দেয় বা কাজ করে দেয়। ওদের খাবারের মেনুতে খুব ভালো খাবার আমি কোনদিন দেখি নাই।
আজও কিছু পরিবার ভালো খাবার দিলেও অধিকাংশ পরিবার পান্তা আর আলু ভর্তার মধ্যেই আবদ্ধ আছেন। কিন্তু ইসলামিক আদর্শ বলুন বা নৈতিকতার সংজ্ঞায় ফেলে দেখুন, আপনি যা খাচ্ছেন ঠিক সে খাবার আপনার বাড়িতে আসা কাজের লোকদেরও খাওয়াতে হবে। কিন্তু প্রভু বা মালিক হলেন জমিদার যা কিনা মূলত হিন্দু প্রথা থেকে আগত। যে প্রথা খোদ হিন্দুদের অনেকেই মানেন না কিন্তু মুসলিমরা অতি আগ্রহে সেটাও গ্রহণ করেছেন।
বাড়ির রান্নার জন্য বুয়া রাখা আপনি কোন পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির মধ্যে পাবেন না। কিন্তু এখানে স্তরে স্তরে এই ‘প্রভু’ বাড়িতে রান্নার জন্য লোক রাখেন, বাড়ি পরিষ্কার করার জন্য আলাদা লোক রাখেন, বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য আলাদা লোক রাখেন। এই ‘মালিক’ বা ‘প্রভু’ জমিদারের চেয়ে কি কোন অংশে কম মনে হয়?
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র থেকে আজও ভারতীয় উপমহাদেশ মুক্ত নয় হোক সেটা ভারতের কংগ্রেস/বিজেপি, বাংলাদেশের আওয়ামীলীগ/বিএনপি এবং পাকিস্তানের মুসলিম লীগ। দলের প্রধানমন্ত্রী ‘Hierarchical Order of The Pyramid’ মোটেই মানেন না। একবার ভেবেও দেখেন না যে, দলে পরিবারের বাইরেও অনেক ভালো এবং দক্ষ রাজনীতিবিদ আছেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাদের নামের তালিকা খুবই সংক্ষিপ্ত কেন?
আরো একজন এ.পি.জে আবদুল কালাম কই? (হিন্দু হলেও চলবে), আরো একজন বন্ধবন্ধু কই?, আরো একজন ভাসানী কই?, আরো একজন শেরে বাংলা কই?, আরো একজন নেতাজী বা মহাত্মা গান্ধী কই? জন্মাবে না। কারণ এখানে রাজার পুত্র রাজা হয়। মেনে নাও, চুপ থাকো এবং এই বিভৎস ‘Hierarchy’ মেনে নাও।
এক সাক্ষাৎকারে রতন টাটা একটি সুন্দর কথা বলেছেন, “আমি এমন একটি ভারতের স্বপ্ন দেখি যেখানে সবার সমান সুযোগ থাকবে (বাংলা অনুবাদ)।” তিনি যখন কোন আইডিয়া কোন কোম্পানির কাছে নিয়ে যেতেন তখন তাঁকে চুপ করতে বলা হত। কেন? কারণ অভিজ্ঞতা নিয়ে এসো, তুমি (এই ফিল্ডে) অনেক নতুন আমাদের ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। রতন টাটার মত মানুষ পর্যন্ত তাঁর জীবনে এই বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশে প্রাইভেট থেকে পাবলিক সকল ধরণের সার্ভিস ও কোম্পানিতে কমবেশি স্বজনপ্রীতি দেখা যায়। আপনি কোন দল করছেন শুধুমাত্র সেই দল আপনাকে হেদায়েত করবে। আপনার যোগ্যতা, আপনার আইডিয়া, আপনার দক্ষতা, আপনার অভিজ্ঞতা দল করার চেয়ে অনেক ছোট।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের নামকরা একটি পত্রিকা লেখেন, “দুর্নীতি নিয়ে এখন হাসাহাসি হয় কিন্তু এটা যে গুরুতর অপরাধ তার বিচার হতে দেখা যায় না।” এসবও তো আমাদের ‘Lived Memory’ তে আছে।
এখানে কি ঋণখেলাপীদের ছাড় দেওয়া হয় না? জানেন না? এদেশ থেকে টাকা পাচার হয় না? এদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বই ক্রমান্বয়ে যাকাতের টাকায় মুদ্রণ করা হয়েছে বলে মনে হয় না? পৃষ্ঠাগুলো কেমন জানি অস্পষ্ট, আকর্ষণীয় নয়।
এই সমস্ত সেক্টরে এক ধরণের প্রভুত্ব বিদ্যমান যা সিস্টেম কে খারাপ দিকে নিয়ে যাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি থেকে বেকার সমস্যা বাড়ছে। কিন্তু ‘Hierarchy’ অনেক গুরুত্বপূর্ণ, দেবতা/প্রভুরা যা বলবেন সেটাই সহীহ্।
শেষ কিছু কথা…
সর্বশেষ কবে চায়ের দোকান থেকে নিজে গিয়ে আপনার চা নিজের জন্য এনেছিলেন? সর্বশেষ কবে আপনার অধীনে কাজ করা মানুষটার সাথে বসে এক কাপ কফি খেয়েছিলেন? সর্বশেষ কবে আপনি নিজের কার/বাইক নিজে ধুয়েছিলেন? এখনো কি লন্ড্রি তে যান? এখনো কি কাপড় ইস্ত্রী নিজে করতে পারেন না? এখনো কি বুয়া রান্না করলে তবেই দুপুরের খাবার খান? এখনো কি কাউকে নিজের চেয়ে নিচুস্তরের বলে মনে হয়?
আসলে আমরা সবাই প্রভু/দেবতা হয়ে গেছি। কাজের বুয়াও কবির সিং সিনেমার মতও নয়। অনুগ্রহ করে এই বিভৎস প্রভুত্ব বা ‘Hierarchy’ একটু পাশে রাখা যায় না?
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.