মনোবিজ্ঞান

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার: মানসিক আঘাতের স্থায়ী ছাপ

PTSD এর উপসর্গ, কারণ এবং প্রতিকার: একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ

বহু মানুষ নানা রকম মানসিক জটিলতায় ভুগে থাকেন। নানা কারণে মানুষ স্ট্রেসে থাকে। আর এই স্ট্রেস থেকেই মানুষ এক সময় কঠিন মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। এই সকল মানসিক রোগের মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হল একটি।

আমরা এর আগেও বেশ কিছু মানসিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা জানবো পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার সম্পর্কে। কোনও কঠিন ঘটনার সম্মুখীন হলে এই ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আর এই রোগে পর্যায়ক্রমে আক্রান্ত হচ্ছে বহু মানুষ। তবে এ পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার নিয়ে কিছু ভুল ধারণাও রয়েছে।

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD)

PTSD বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার রোগটি একটি জটিল সমস্যার চেয়ে কম নয়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কোনও খারাপ ঘটনা ভুলতে পারেন না এবং ক্রমাগত এটি অনুভব করতেই থাকেন। এর ফলে রোগী নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করে থাকে।

অর্থাৎ এই পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হল এমন একটি মানসিক সমস্যা যা আঘাতমূলক পরীক্ষার একটি স্থায়ী ফলাফল। যার ফলে রোগীর মনে তীব্র ভয়, অসহায়ত্ব বা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়ে থাকে।

এই পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার প্রায়ই যৌন বা শারীরিক আক্রমণ, ঘনিষ্ঠ কারোর অপ্রত্যাশিত মৃত্যু, দুর্ঘটনা ইত্যাদির কারণে হতে পারে।

পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এর উপসর্গ

দুঃস্বপ্ন

পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এ আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় প্রায় রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকেন এবং তাঁর স্বপ্নে সবসময়ই একই বিষয় থাকে।

একই ঘটনা বারবার স্মরণ করা

প্রায়সময়ই এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির উপর যে খারাপ ঘটনাটি প্রভাব ফেলে সেই ঘটনাটি তার বারবার মনে পড়ে। এর ফলে সে সেই স্ট্রেস থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারে না।

মনোনিবেশ করতে অসুবিধা

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারে না। কারণ সে ঘটনা থেকে তার মনোযোগ সরাতেই পারে না।

বিরক্তি

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মেজাজ সারাদিন খিটখিটে থাকে এবং কারো সঙ্গে বেশি কথা বলতে পছন্দ করেন না। এমনকি ব্যক্তি প্রায়শই সেই ঘটনা সম্পর্কে কথা বলতে চান না এবং এটি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।

বিজ্ঞাপন

প্যানিক অ্যাটাক

অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তি প্যানিক অ্যাটাক অনুভব করে থাকেন। এবং মনে রাখার ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি হয়।

রোগের কারণ

সাধারণত যেসব ট্রমাটিক ঘটনার জন্য PTSD হয়ে থাকে –

  • কোনো রকম দুর্ঘটনা থেকে এই রোগের সৃষ্টি হতে পারে।
  • শিশুকালে কোনো রকম শারিরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
  • কোনোভাবে যৌনতার শিকার হলেও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
  • শারিরিক নির্যাতনের কারণেও এই রোগ হতে পারে।
  • যুদ্ধের নির্মমতা দেখার ফলেও এটি হতে পারে।
  • প্রিয়জনের মৃত্যুর ফলেও মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

এছাড়াও অন্যান্য আরো অনেক কারনেও মানুষ এই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হতে পারে। শুধু সরাসরি ঘটনার শিকার হলেই নয়, প্রত্যক্ষ দর্শনেও এটি হতে পারে।

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা

অনেকেই মনে করেন শুধু ঘনিষ্ঠ কারও মৃত্যুতেই মানুষ এই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয়।

কিন্তু এটি একেবারেই ভুল ধারণা। কারণ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির মৃত্যু ছাড়াও আরও অন্যান্য অনেক কারণেই এই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হতে পারে। যে কোনও ঘটনাতেই ব্যক্তি যদি খুব আঘাত পান তবে এই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার দেখা দিতে পারে।

আবার অনেকেই মনে করেন পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার খুব কঠিন একটি রোগ।

এটা কোন সাধারণ বিষয় নয় বলেই মনে করেন অনেকে। কিন্তু বাস্তবে তা একেবারেই নয়। বর্তমানে বহু মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এমনকি বেশ নিয়ম করে চিকিৎসা করলে এই রোগ থেকে মুক্তি সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কেউ কেউ বলেন শুধু মাত্র দুর্বল ব্যক্তিরা এই ট্রমায় আক্রান্ত হন যা একেবারেই ভুল ধারণা।

শুধুমাত্র দুর্বল মানসিকতার ব্যক্তিরাই যে আঘাত পান আর বাকিরা পান না তা কিন্তু নয়। সব ধরণের মানুষই এই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হতে পারেন।

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার এর লক্ষণ

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এর লক্ষণ সেই দূর্ঘটনা ঘটনার ১ মাসের মধ্যেই শুরু হতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীর পরিবর্তনগুলো যে এই রোগের লক্ষন তা বুঝতে অনেক সময় লেগে যায়। এটা প্রায় বছরের মতো লেগে যায়।

  • দূর্ঘটনা মনে পড়ে যায় এমন বস্তু, কথা বা ঘটনার প্রতি রোগীর অস্বাভাবিক মানসিক স্ট্রেস বা শারিরিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
  • সেই দূর্ঘটনা নিয়ে বার বার দুঃস্বপ্ন দেখা আর যার ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।
  • সেই ঘটনা ঘটার অনেকদিন পরেও যদি ঘটনার সাথে সম্পর্কিত কোনো বস্তু রোগী দেখে তবে আতঙ্কিত হয়ে যাওয়া।
  • স্মৃতিগত সমস্যার সৃষ্টি হয়।
  • হতাশায় ভোগে।
  • ট্রমাটিক ঘটনার সাথে সম্পর্কিত জায়গা, কাজ বা মানুষদের এড়িয়ে চলা।
  • মানুষের থেকে দূরত্ব সৃষ্টি করা। এমনকি পরিবার বা কাছের বন্ধুদের সাথেও অস্বাভাবিক আচরণ করা।
  • সবসময় অস্বাভাবিকভাবে নিজেকে দোষারোপ করা।
  • আক্রমণাত্মক আচরণ করা।
  • সবাইকে অবিশ্বাস করা।
  • মাত্রাতিরিক্ত সতর্ক থাকা।
  • আত্মহত্যার চেষ্টা করা।

এছাড়াও পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এর পাশাপাশি আরও অন্যান্য আরও মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়। যেমন; ডিপ্রেশন, অ্যানজাইটি ডিসওর্ডার, ডিসোসিএটিভ ডিসওর্ডার ইত্যাদি।

এই রোগের প্রতিকার

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এর চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হচ্ছে শারিরিক এবং মানসিক লক্ষণগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। যার ফলে যেন রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। এই রোগের কোনো সঠিক নিরাময় নেই।

এটি কাউন্সিলিং এবং কিছু ঔষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তাই যদি আপনার পরিচিত কাউকে এই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসওর্ডারে আক্রান্ত বলে মনে হয় তবে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের নিকট নিয়ে যেয়ে তার পরামর্শ অনুযায়ী কাউন্সিলরের সাথে যোগাযোগ করবেন।

আর মনে রাখবেন এই রোগটি যেকোনো বয়সী মানুষের দেখা দিতে পারে।

পরিশেষ

বিভিন্ন কারণে মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগে। যা অনেক সময় নিজে নিজে বোঝা যায় না। তাই নিজের পাশাপাশি কাছের মানুষগুলোরও খেয়াল রাখা উচিত যে কারো কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। এতে কোনো সমস্যা ধরা পড়লেই দ্রুত চিকিৎসকের নিকট নিয়ে যাওয়া যাবে এবং চিকিৎসার ফলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

আজ এই পর্যন্তই। সবাই ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ

জিজ্ঞাসা ও উত্তর (FAQs)

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) কি?

পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) হল একটি মানসিক সমস্যা যা কোনো আঘাতমূলক ঘটনার পরে দেখা দিতে পারে। এটি তীব্র ভয়, অসহায়ত্ব বা আতঙ্কের সৃষ্টি করে।

PTSD এর লক্ষণগুলো কি কি?

PTSD এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে দুঃস্বপ্ন, একই ঘটনা বারবার স্মরণ করা, মনোনিবেশ করতে অসুবিধা, বিরক্তি, প্যানিক অ্যাটাক ইত্যাদি।

PTSD এর কারণ কি কি?

PTSD এর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্ঘটনা, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, যুদ্ধের নির্মমতা দেখা, প্রিয়জনের মৃত্যু ইত্যাদি।

PTSD এর চিকিৎসা কিভাবে করা যায়?

PTSD এর চিকিৎসা কাউন্সিলিং এবং ঔষুধের মাধ্যমে করা যায়। নিয়মিত চিকিৎসা করলে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

PTSD এর প্রতিকার কি সম্ভব?

হ্যাঁ, PTSD এর প্রতিকার সম্ভব। নিয়মিত চিকিৎসা এবং কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।

PTSD কোন বয়সের মানুষের দেখা দিতে পারে?

PTSD যেকোনো বয়সী মানুষের দেখা দিতে পারে। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।

বিজ্ঞাপন

সেলিনা আক্তার শাপলা

I'm Shelina Akter Shapla. I work as a content writer for the Ovizatri - News & Magazine online news portal. Additionally, I am a co-founder of this website along with the admin, MD Mehedi Hasan. I also have another identity: I have completed my Master's degree from the Department of Philosophy at Rajshahi University.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button