প্রোফাইলিং: জীবনালেখ্যের গুরুত্ব ও অন্ধকার মনোবিজ্ঞানের প্রভাব
ডেটা চুরি থেকে ম্যানিপুলেশন: প্রোফাইলিংয়ের বিভিন্ন দিক ও এর প্রভাব
প্রোফাইলিং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। একটি বড় কোম্পানি অনেক মানুষের প্রোফাইলিং করে তাদের পণ্যের ক্রেতা নির্ধারণে ও পণ্যের মান নির্ণয়ে। ভালো মানের প্রোফাইলিং যদি করতে পারেন তাহলে ভোক্তা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা মিলে যায় যা দিয়ে খুব সহজেই উক্ত পণ্য তারা বাজারে আনতে সক্ষম হোন। কারণ তারা দেখতে পান, ভোক্তা আছে এবং ভোক্তার আচরণ অনুযায়ী এই পণ্য বাজারে ভালো চলবে।
অনলাইন ডেটা চুরি ও প্রোফাইলিং
প্রায় আমরা অনলাইন ডেটা চুরি নিয়ে চিন্তিত থাকি, ভয়ে থাকি। অনলাইনে প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে মূলত কি হয়? অনেককিছুই হয় কিন্তু এই তথ্য প্রধানত বিক্রি করা হয় দানবাকৃতির কোম্পানির কাছে। তারও আগে একধরণের পদ্ধতিগত প্রোফাইলিং করা হয় প্রতিটি ব্যক্তির। এরপর এই সমস্ত তথ্য মোটা অঙ্কে বিক্রি করা হয় দানবাকৃতির কোম্পানি বা স্টক মার্কেটের বড় বড় স্টক হোল্ডারদের কাছে। এছাড়াও এই তথ্যগুলোর প্রয়োজন পড়ে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর সুরক্ষা নিয়ন্ত্রণে।
গোয়েন্দা এজেন্সি ও নিউজ এজেন্সি
সিক্রেট গোয়েন্দা এজেন্সি বা নিউজ এজেন্সি এই ধরণের তথ্য খুবই চড়া দামে ক্রয় করে থাকতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, মাত্র ১২ জনের একটি টিমও যদি যুক্তরাষ্ট্রকে অস্ত্র হিসেবে ‘বাঁশ’ দিয়েও অস্থিতিশীল করতে চান এবং তাদের নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কোন প্রতিষ্ঠানে হামলা করেন তাহলে হতে পারে ঐ দেশের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা এ সম্পর্কে ইতোমধ্যেই জেনে গেছেন। এবং, আপনাদের টিম সেখানে পৌঁছার আগেই সেদেশের সুরক্ষা বাহিনী উপস্থিত আছেন।
এই পুরো বিষয়টি খুবই নাটকীয় শোনালেও, সিনেমার মত মনে হলেও অনেকখানি বাস্তব। বর্তমানে মোটামুটি শক্তিশালী দেশও এমন কিছু টুল পর্যন্ত ব্যবহার করেন যা দিয়ে আরো সহজে অপরাধী বা দেশদ্রোহী কে শনাক্ত করতে পারেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
জুলাই বিপ্লবেও আপনি যদি বিচক্ষণ হোন তাহলে দেখবেন সেখানেই পুলিশ ছিলো যেখানে পুলিশের থাকা উচিত। অথবা, মাত্র ৩০-৪৫ মিনিটে বিএনপির মহা-সমাবেশ ভন্ডুল। উল্লেখ্য, আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নই। আমার দল হলো, ‘NOTA’। কিন্তু কীভাবে এসব সম্ভব? এ সম্পর্কে ভালো ধারণা আপনাকে দিতে পারবেন নিউজ এজেন্সির কেউ।
আমার কাছে যেটুকু আছে তা স্থূল এবং সার্ফেস স্তরের চিন্তাভাবনা। তবে যে-কোনো মব নিয়ন্ত্রণে শুধুমাত্র টুলগুলো/সফটওয়্যার সমূহ যথেষ্ট হয় না। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রোফাইলিং চড়া দামে ক্রয় করতে হয়। বাংলাদেশে আন্দাজ অনুযায়ী এখন পর্যন্ত এই ধরণের টুল/সফটওয়্যার ‘Enable’ আছে; যা মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করেই চলেছে। অবশ্য এটা আমার স্রেফ অনুমান মাত্র। প্রকৃত সত্য শুধুমাত্র নিউজ এজেন্সি বা সিক্রেট গোয়েন্দা এজেন্সি ভালো জানবেন।
অন্ধকার মনোবিজ্ঞানে প্রোফাইলিং
এখন এই ‘প্রোফাইলিং’ অন্ধকার মনোবিজ্ঞানে কীভাবে কাজ করতে পারে?
আচরণগত দিক পর্যবেক্ষণ
ডার্ক সাইকোলজিতে আপনাকে টার্গেটেড ব্যক্তির আচরণ খুবই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা জরুরী। বিশেষ করে তিনি কখন, কি বিষয়ে, কি কারণে, কার উপর কি ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন? এই সমস্ত নির্ধারণের মাধ্যমে আপনি ঐ ব্যক্তির ভবিষ্যৎ আচরণ নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে কি হতে পারে তা ধারণা করতে পারবেন।
উদাহরণস্বরূপ, ‘মি. ক’ সবসময় নার্ভাস অনুভব করেন যখন ‘মিসেস. খ’ এর সাথে দেখা হয় বা তার সাথে হ্যান্ডশেক করেন। তিনি ঠিক এই সময়ে চরম আনন্দে থাকেন। আর আপনি যেহেতু বিষয়টি জানেন তাহলে এখানে আপনার স্বার্থের ক্ষেত্রে আপনাদের সম্পর্কের মধ্যের কোন দ্বন্দ্ব নিয়ে কিছুটা হলেও মীমাংসায় আসতে পারবেন। কারণ মি. ক এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ‘Agreeable’ মনোভাব পোষণ করতে পারেন। মানে হলো, আপনি তাদের একসাথে করে একটি ফটো তুলে দেন এর পরক্ষণেই দু’কাপ চা নিয়ে নিজেদের দ্বন্দ্ব ভুলে যান।
কথা বলার ধরণ পর্যবেক্ষণ
মানুষের কথা ও বন্দুকের গুলি কখনো ফিরে আসে না। তাই কথা বলার সময় আমাদের নিজেদের যেমন সাবধানে থাকতে হবে এবং অন্যদেরকেও সাবধান করতে হবে। এখানে টার্গেটেড ব্যক্তির কথা বলায় শব্দচয়ন, বাচনভঙ্গি, গলার আওয়াজ এবং দ্রুততা উক্ত ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব আমাদের কাছে অনেকখানি প্রকাশ করে দেয়। আর এখানেই খেলা। কারণ আপনি টার্গেটেড ব্যক্তি বা ভিক্টিম কে যত বেশি বুঝতে বা চিনতে পারবেন ততবেশি ডার্ক সাইকোলজিতে ম্যানিপুলেশন প্রকিয়ায় আপনি এগিয়ে থাকবেন।
আমরা সবাই কোনো না কোন ভাবে হতাশ। কিন্তু মানুষ তাদের হতাশার কথা সবাইকে বলে না। বেছে বেছে কিছু বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের মানুষ তাদের হতাশার কথা বলে থাকেন। তবে কিছু মানুষ পাবেন যারা আবার কোন কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারেন না। এমন মানুষকে ম্যানিপুলেট করা খুবই সহজ। কারণ এদের আত্মসম্মান তূলনামূলক কম হয়ে থাকে। এদের কিছু কিছু কাজের অতিরঞ্জিত প্রশংসা করুন এবং একধরনের স্বীকৃতি প্রদান করুন। এতে করে ভিক্টিমের সিদ্ধান্তকে ইনফ্লুয়েন্স করতে পারবেন।
ইমোশনাল ট্রিগার
উদাহরণস্বরূপ, পুরুষদের ক্ষেত্রে কখনো তার আয়ের উৎস এবং উপার্জন ক্ষমতা নিয়ে খোটাও দিতে যাবেন না। এতে করে যেকোনো পুরুষ ক্রোধান্বিত হয়ে পড়বেন সহসাই। আপনি যদি কোন পুরুষকে বলেন, “দেখেছি, তোমার যত রাগ শুধু পরিবারের উপর, কিন্তু টাকা কামাই তো করতে পারো না! সংসার কীভাবে চলছে তুমি কি সেটা জানো?”
চেষ্টা করবেন জীবনে এই ধরণের কথা কোন পুরুষকে না বলতে। এতে করে তিনি আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পারেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ধরণের ইমোশনাল ট্রিগার খুবই কাজ করে। বিশেষ করে আমার মত যারা অলস। অবশ্য ডার্ক সাইকোলজি সম্পর্কে অবগত নন এমন মানুষকে দিয়ে কিছু কাজ নিশ্চয় করিয়ে নিতে পারবেন।
Vulnerability Exploitation
কারও ভয়, নিরাপত্তাহীনতা এবং দুর্বলতা বুঝতে পারলে আপনাকে তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব অর্জনের জন্য এই দিকগুলিকে কাজে লাগাতে দেয়। প্রোফাইলিং করার ক্ষেত্রে অবশ্যই এই মানদন্ড বিবেচনায় নিতে হয়। এটা অনেকটা আমাদের মনের সিস্টেমে কি কি ভাইরাস আছে তা চেক করা এবং ব্যাকডোর দিয়ে আমাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করে আমাদেরকে প্রভাবিত করার মতন।
কীভাবে এটা করবেন? এই বিষয়টি জানিয়ে দেওয়াও একধরণের অপরাধ। যাকগে, অন্ধকার মনোবিজ্ঞানে যখন ঢুকেই পড়েছি তখন দূর্বল একটি উদাহরণ দিয়ে এ বিষয়ে ইতি টানা যাক।
উদাহরণস্বরূপ, আমার বন্ধু সাঁতার জানে না। আমি তাকে একদিন খুবই জোর করে নৌকায় উঠবার জন্য প্রস্তাব দিই। কারণ আমার উদ্দেশ্য ছিলো, তার এই ভীতি থেকে সে বের হোক। কিন্তু আমি যদি এখানে এসব না করে তাকে মাঝ নদীতে নিয়ে গিয়ে বলতাম, “আজকে নদীর এই স্রোত খুব সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না, গতকাল ঠিক এখানেই একটি নৌকা ডুবে সকল যাত্রী মারা গেছেন।” বিষয়টি কিন্তু মোটেই হাস্যকর নয়। আমার বন্ধু প্যানিক অ্যাটাক পর্যন্ত করতে পারেন এই অবস্থায়।
এর পরক্ষণেই আমি তাকে জানাবো, “যেহেতু আমি আছি, সুতরাং তুই কোনো চিন্তা করিস না!” কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মাঝ নদীতে খুব সম্ভবত আমি নিজেকেই বাঁচাতে পারতাম না। কিন্তু আমার বন্ধু ভাবতে পারে, আমি তার অনেক কাছের বন্ধু এবং তার ক্ষতি আমি মোটেই চাই না; যা মিথ্যা। আমার ক্ষেত্রে আমি মাঝ নদীতে তাকে নিয়ে গেছি এবং বলেছি, “সতর্কতা জরুরী, আমাদের আশেপাশে খেয়াল করে দেখ আরো অনেক নৌকা যাচ্ছে এবং খুব সম্ভবত সবাই সাঁতার জানেন না।” মানে এখানে সাহস দেওয়া এবং ম্যানিপুলেট করার মধ্যে একটি পাতলা লাইন আছে।
উপসংহার
প্রোফাইলিং শুধুমাত্র নাম-ধাম, ঠিকানা, পরিচয়, ভালোলাগা, মন্দলাগা, আচরণ, ভোক্তার ধরণ, রাজনৈতিক ও সামাজিক অ্যাফিলিয়েশন এসকল বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটা বিশাল স্টাডি ও গবেষণার বিষয়বস্তু। ডার্ক সাইকোলজিতে এর প্যারামিটার সমূহ আরো বিস্তৃত। কিন্তু নৈতিকতা বিবর্জিত প্রোফাইলিং করতে দেওয়া বা নিজেই সেটা করা খুবই নিন্দনীয় বিষয়। দুটোর ব্যাপারে আমাদেরকে সোচ্চার থাকা জরুরী।
প্রোফাইলিং একটি শক্তিশালী টুল যা সঠিকভাবে ব্যবহার করলে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। তবে এটি নৈতিক দিক থেকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা জরুরী। আমরা যদি এই টুলটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারি তাহলে এটি আমাদের জীবনে অনেক উপকারী হতে পারে। তাই, প্রোফাইলিং সম্পর্কে জানা ও বুঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.