মনোবিজ্ঞান

সাইকোসিস: একটি গুরুতর মানসিক সমস্যা

সাইকোসিস কি? লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

মানসিক সমস্যা সম্পর্কে অনেকেই নানা প্রশ্ন করে থাকেন। অনেকেই বিভিন্ন লক্ষণ দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই আমরা মানসিক সমস্যা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে তা জানানোর চেষ্টা করে থাকি। আজও এমনই একটি মানসিক সমস্যা সম্পর্কে কিছু তথ্য জানানোর চেষ্টা করবো। আমাদের আজকের বিষয় হল সাইকোসিস।

সাইকোসিস কী?

অন্যান্য মানসিক সমস্যার মধ্যে সাইকোসিস হল একটি অত্যন্ত গুরুতর মানসিক সমস্যা। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি হ্যালুসিনেশন অর্থাৎ দৃষ্টিভ্রম বা ডিলিউসন অর্থাৎ বিভ্রমে ভোগেন। যাকে বলা হয় বাস্তব জগতের সঙ্গে যোগসূত্র হারিয়ে ফেলা।

এটি কোনো সাধারণ সমস্যা নয়, এটি বেশ গুরুতর একটি সমস্যা। এবং এর দ্রুত চিকিৎসা হওয়ার প্রয়োজন। না হলে এই সাইকোসিস রোগীরা নিজের এবং সেই সাথে আশেপাশের মানুষদের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে।

সাইকোসিসের লক্ষণ

সাইকোসিসের বিভিন্ন ধরণের লক্ষণ দেখা যায়। যা দেখে আপনি বুঝতে পারবেন যে কেউ সাইকোসিস রোগে আক্রান্ত কি না। এরপর সেই অনুযায়ী তার চিকিৎসার ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে সুবিধা হবে। সাইকোসিসের কিছু লক্ষণ:

১. দৃষ্টিভ্রম

দৃষ্টিভ্রম যাকে ইংরেজিতে বলা হয় “Hallucination”। এটি হলো সাধারণভাবে অস্বাভাবিক উপলব্ধি। অর্থাৎ এটি কোনো অলীক বস্তুকে দেখতে পাওয়া এই সম্পর্কে একটি মিথ্যা উপলব্ধিতে ভোগা। যে কোনো মানসিক রোগীর ক্রমাগত এই দৃষ্টিভ্রম হতে পারে।

২. ভ্রম

ভ্রম যাকে ইংরেজিতে বলা হয় “Delusion”। যা মিথ্যা বিশ্বাস। অর্থাৎ এমন কোনো বিশ্বাস করা যা সমাজের সকলেই মিথ্যা বলেই জানে এবং তার বিপরীতে সকলের কাছেই যথেষ্ট প্রমাণ আছে। যেমন ভ্রমের উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে; রোগীর মনে হতে পারে তার আপনজনরা তাকে ঠকাচ্ছে। অথচ এমন কোনো কিছুই নেই অথবা এমন হবারও কোনো কারণ নেই।

৩. ক্যাটাটোনিয়া

ক্যাটাটোনিয়া বলতে বোঝায় পেশী নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা। অর্থাৎ মানসিক রোগীরা এক্ষেত্রে তার শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ কোনো কারণ ছাড়াই নাড়াতে থাকে। আর দেখা যায় যে, পাঁচ থেকে নয় শতাংশ মানসিক রোগীরা এই ধরণের সমস্যায় ভোগেন।

৪. চিন্তার বিশৃঙ্খলা

এই সাইকোসিস রোগীদের দেখা যায় তাদের চিন্তায়, অনুভবে এবং আচরণের অস্বাভাবিকতা। যাকে বলা হয় চিন্তার বিশৃঙ্খলা। এটি স্কিটসোফ্রিনিয়া এবং সাইকোসিসের মতো রোগেরও গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। এছাড়াও সাইকোসিস রোগের অন্যান্য কারণও রয়েছে। যেমন:

৫. ঘুমের সমস্যা

ঘুমের সমস্যা অর্থাৎ ঘুম না হওয়া অথবা অতিরিক্ত ঘুম হওয়া।

৬. অবসাদ বা বিষণ্ণতা

রোগী অবসাদ বা বিষণ্ণতায় ভুগবেন।

বিজ্ঞাপন

৭. উদ্বেগ

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে উদ্বেগ কাজ করে।

৮. মনযোগের সমস্যা

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মনযোগের সমস্যা হয়।

৯. পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে।

১০. আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা

কোনো কোনো সময় তারা আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা অথবা প্রচেষ্টা করে থাকে।

সাইকোসিসের কারণ

এই ধরণের মানসিক সমস্যা সাধারণত হয়ে থাকে যদি বংশে কারও মানসিক সমস্যার ইতিহাস থাকে তবে সেই মানুষের এই সাইকোসিস রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আবার জানা যায় যে, কয়েকটি ক্রোমোজোমের রোগের ফলেও এই সাইকোসিস রোগটি হতে পারে। এছাড়াও অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:

১. মাদক সেবন

কেউ যদি নিয়মিত মাদক সেবন করে তবে সে সাইকোসিস রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

২. ঝঞ্ঝাটপূর্ণ এবং অবসাদগ্রস্থ পরিবেশ

ঝঞ্ঝাটপূর্ণ এবং অবসাদগ্রস্থ পরিবেশে বসবাসের ফলেও মানুষ এই সাইকোসিস রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

৩. মস্তিষ্কে টিউমার

মস্তিষ্কে টিউমার থাকলে তার জন্যও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

৪. পার্কিনসন্স বা হান্টিংটন্স রোগ

পার্কিনসন্স বা হান্টিংটন্স রোগের মত মস্তিষ্কের রোগগুলির কারণেও মানুষ এই সাইকোসিস রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

৫. বাইপোলার রোগ

কেউ যদি বাইপোলার রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলেও তার সাইকোসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৬. ডিলিউসনাল ব্যাধি

ডিলিউসনাল ব্যাধি থেকেও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

৭. সাইকোটিক ডিপ্রেশন

সাইকোটিক ডিপ্রেশনের ফলেও মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

৮. স্কিজোফ্রেনিয়া

স্কিজোফ্রেনিয়ার কারণেও মানুষ সাইকোসিস রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

সাইকোসিস রোগীর জন্য করনীয় কী?

প্রথমত

সাইকোসিস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির পর্যবেক্ষণ এবং উপরোক্ত লক্ষণগুলির ওপর তার প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে বুঝতে হবে যে তিনি কোনো জটিল রোগে ভুগছেন। এর ফলে তাকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসতে হবে।

এরপর চিকিৎসক সেই রোগীকে দেখে তার পরবর্তী চিকিৎসা ও মূল্যায়নের জন্য মনোচিকিৎসকের কাছে পাঠাতে নির্দেশ দিবেন।

দ্বিতীয়ত

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাধারণত অ্যান্টিসাইকোটিক প্রকৃতির ওষুধ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। যা রোগীর দৃষ্টিভ্রম ও বিভ্রম কমাতে সাহায্য করে এবং বাস্তব জগৎ ও অবাস্তবের মধ্যে নিশ্চিত পার্থক্য বোঝাতে সাহায্য করে।

তৃতীয়ত

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। অর্থাৎ এইসব রোগীদেরকে চিকিৎসকরা কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপির পরামর্শও দিয়ে থাকেন যা এই ধরণের সমস্যায় এগুলি সাহায্য করে থাকে।

এই কাউন্সেলিং এর ফলে বাইপোলার ও সাইকোটিক এইধরনের রোগীরা স্বাচ্ছন্দ্য এবং বাস্তবের সঙ্গে যুক্ত থাকার অনুভূতি পায়।

চতুর্থত

সাইকোসিস রোগের সঙ্গে লড়াই করা সত্যিই একটি কঠিন প্রক্রিয়া। তাই এই রোগের জন্য প্রয়োজন দৃঢ়সংকল্প মনোভাব। শুধু তাই নয়, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে একটানা সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদানের জন্য পরিবারের সদস্যদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন।

মনে রাখতে হবে এইরকম পরিস্থিতিতে রোগীকে একা রাখা উচিত নয়। কারণ এই সময়গুলোতে তাদের সাধারণত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন

পরিশেষ

সাইকোসিস রোগীর সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে এবং তাদের বুঝতে হবে। এছাড়াও খেয়াল রাখতে হবে পরিবারের কোনো সদস্যের মধ্যে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় কি না। দেখা গেলে যত দ্রুত সম্ভব তাকে চিকিৎসকের নিকট নিয়ে যেতে হবে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

সাইকোসিস কি নিরাময় যোগ্য?

সাইকোসিস একটি গুরুতর মানসিক সমস্যা, তবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পরিচর্যার মাধ্যমে এর লক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু করলে রোগীর সুস্থতার সম্ভাবনা বেশি।

সাইকোসিসের লক্ষণগুলি কীভাবে চিহ্নিত করা যায়?

সাইকোসিসের লক্ষণগুলি চিহ্নিত করার জন্য রোগীর আচরণ, চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতির উপর নজর রাখতে হবে। দৃষ্টিভ্রম, ভ্রম, ক্যাটাটোনিয়া, চিন্তার বিশৃঙ্খলা, ঘুমের সমস্যা, অবসাদ, উদ্বেগ, মনযোগের সমস্যা, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি এবং আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা এই রোগের কিছু প্রধান লক্ষণ।

সাইকোসিসের চিকিৎসা কীভাবে করা হয়?

সাইকোসিসের চিকিৎসা সাধারণত অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ, কাউন্সেলিং এবং সাইকোথেরাপির মাধ্যমে করা হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা গুরুত্বপূর্ণ।

সাইকোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের ভূমিকা কী?

সাইকোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সদস্যদের সমর্থন, সহযোগিতা এবং সাহায্য রোগীর সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। রোগীকে একা রাখা উচিত নয় এবং তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে।

সাইকোসিসের প্রাথমিক লক্ষণগুলি কী?

সাইকোসিসের প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে দৃষ্টিভ্রম, ভ্রম, ক্যাটাটোনিয়া, চিন্তার বিশৃঙ্খলা, ঘুমের সমস্যা, অবসাদ, উদ্বেগ, মনযোগের সমস্যা, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি এবং আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা।

আজ এই পর্যন্তই। আবারও নতুন কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হবো। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ

সেলিনা আক্তার শাপলা

I'm Shelina Akter Shapla. I work as a content writer for the Ovizatri - News & Magazine online news portal. Additionally, I am a co-founder of this website along with the admin, MD Mehedi Hasan. I also have another identity: I have completed my Master's degree from the Department of Philosophy at Rajshahi University.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এছাড়াও চেক করুন!
Close
Back to top button