সোশ্যাল মিডিয়া: প্রাইভেসির অবক্ষয় এবং ইনস্ট্যান্ট বিনোদনের ফাঁদ
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব, প্রাইভেসি এবং আধুনিক সমাজের চ্যালেঞ্জ
আপনার মন খারাপ? তাহলে এক্ষুনি সোশ্যাল মিডিয়া খুলে বসুন তারপর একটার পর একটা রিলস্ দেখুন। মাত্র ৩০ সেকেন্ড থেকে শুরু করে ১ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের এসব রিলস্ আপনার আগ্রহকে দীর্ঘসময় ধরে রাখতে সক্ষম। প্রযুক্তিতে সোশ্যাল মিডিয়ার যত কল্যাণ হয়েছে তত বেশি মানুষের মধ্যে হতাশা এবং আত্মহত্যা বেড়েছে। অন্তত পরিসংখ্যান তাই বলছে।
সর্বশেষ সংযুক্তি এই রিলস্ গুলোর মাধ্যমে আমাদেরকে ইনস্ট্যান্ট বিনোদন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। খুব সম্ভবত, এই পর্যন্ত ইন্টারনেট দুনিয়ায় সবচেয়ে আসক্তিকর এরচেয়ে বেশি কিছু আমার জানা মতে নাই। ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড (Brave New World)’ বইতে অ্যান্টি-ডিপ্রেশনের একটি ট্যাবলেট ‘সোমা (Soma)’ নামে পরিচিত ছিলো। যা একধরনের মাদকদ্রব্য।
আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন বা একটু মন খারাপ তাহলে একটি সোমা ট্যাবলেট খেয়ে নিন। একটাই হচ্ছে না তাহলে দুটো খান; আপনার সব ডিপ্রেশন উধাও হয়ে যাবে। উক্ত সমাজের একটি মন্ত্র-ই ছিলো, “সবাই এখন সুখী।”
ধরুন, আপনি গুগল বা ফেসবুকে এমন কিছু সার্চ দিলেন বা ক্রয় করলেন। উদাহরণস্বরূপ, একটি ব্রা/জাঙিয়া। আপনি সার্চ বা ক্রয় করার সাথে সাথেই আপনার সব তথ্য এসব জায়ান্ট কোম্পানির কাছে চলে যায়। এরপর দেখবেন সে সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন আপনাকে দেখানো হচ্ছে। আপনার নাম-পরিচয়-ঠিকানা কিছুই আর ঠিক প্রাইভেট রইলো না। প্রাইভেসি বলতে কিছুই থাকছে না।
এখন জমানা এমন যে, আপনি ফেসবুকে নাই তাহলে একরকম ‘FOMO’ তে ভুগবেন। বন্ধু থেকে পরিচিত জন’রা আপনাকে ওল্ড স্কুল মনে করতে শুরু করবে। আপনার ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় মোট অনুসারী নির্ধারণ করবে আপনি ব্যক্তি হিসেবে কত জনপ্রিয়। শুধু তাই নয়, আজকাল বিভিন্ন চাকুরী তেও বাধ্যতামূলক ফেসবুক আইডি প্রদান করতে হয়।
এখানে দুটো বিষয় নির্ধারিত হয়, পাবলিক ও প্রাইভেট। কিন্তু ঘুরেফিরে যা পাবলিক তা তো পাবলিকলি চলছে কিন্তু যা প্রাইভেট সেটাও পাবলিক হয়ে যাচ্ছে। একজন ব্যক্তির প্রাইভেট কিছু থাকাটা এই সমাজে হাস্যকর এবং অনুমোদিত নয়। আপনি কোথাও ঘুরছেন তারচেয়েও বেশি সেখানের থাকার ছবি তুলছেন। কেন? কারণ ফেসবুকে সবাইকে জানাতে হবে। না জানালে কি হবে? অনুমোদন/স্বীকৃতি পাওয়া যাবে না।
‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ বইতেও এর ভিন্ন কিছুই ঘটছে না। সেখানের যে নিউরো-কালচার এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং মানুষকে ছোট থেকেই অথোরিটির দাস বানাছে, এবং দাস আবার দাসত্ব বরণ করে অথোরিটি কে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। এই বইতে প্রাইভেটে কথা বলার জন্য বার্নার্ড লেনিনা কে যখন অনুরোধ করছে তখন লেনিনা শুনে হাসছে। লজ্জায় হাসছে না, কারণ এখানে প্রাইভেটে কথা বলা বা সেক্স করা এবজার্ড (অনর্থক), এই আইডিয়া টা-ই ওল্ড স্কুল আইডিয়া।
এখানে কিছুই প্রাইভেট থাকতে পারে না। প্রাইভেটে প্রাইভেসি নিয়ে কিছু করাটা শুধু লজ্জার নয়, অদ্ভুতও বটে। এখানে বাক-স্বাধীনতা এত ব্যাপক যে, লাজ – লজ্জা ছাড়াই একে অন্যের যৌনতা করার অভিজ্ঞতা অনায়াসে শেয়ার করছে। আপনি যদি মনোগামী হোন তাহলে অথোরিটি আপনাকে শাস্তি দেবে। এখানের শ্লোগান হচ্ছে, “সবাই সবার জন্য।”
একজন মেয়ে ফেসবুকে বা টিকটকে রিলস্ বানাচ্ছে, নাচছে। কখনো কিছুটা রাখঢাক থাকলেও বেশিরভাগ সময়ে অর্ধ নগ্ন থাকছে। সত্যি বলতে এদের অধিকাংশ দেখবেন ভালো পরিবারের। এই যে ডিজিটাল নর্তকী হওয়াটা এবং এক পর্যায়ে অর্ধ নগ্ন হওয়ার জন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা বা আইন নাই। শরীরের কতটুকু দেখানো যাবে তার কোনো সেন্সরশিপ নাই। উল্টো এতে সমাজের নৈতিক ক্ষতি হতে পারে ভেবে আপনি যদি ভুলভাল মন্তব্য করেন তবে আপনাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে ভরে দেওয়া হবে। এবং কীভাবে বিষয়গুলো সব সবার জন্য হয়ে যাচ্ছে আশা করি টের পেয়েছেন।
যে কোনো ছাত্র আন্দোলনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পাড়া এবং পূর্ব পাড়া মিলেমিশে যদি একাকার হয়ে যেতে বলা হয় তাহলে আমি না-হয় কিছুটা কন্ট্রোল দিলাম কিন্তু আমার বন্ধু অনিক কুমার ঘোষ কে তো আর দেওয়া সম্ভব নয়। ফলতঃ ছাত্র আন্দোলন আজকাল আর দাঁড়াতেই পারছে না, দাঁড়াতেই যেনো শুয়ে পড়ছে।
আর কানেকটিভিটির জন্য তো সোশ্যাল মিডিয়া আছেই। আজকাল ব্যানার-ফেস্টুন টানিয়ে আন্দোলন যত হয়, তারচেয়ে ফেসবুকীয় আন্দোলন অনেকগুনে বেশি হয়। সূত্রপাত এখান থেকেই ঘটে এবং এখানেই রফাদফা হয়ে যাচ্ছে।
এজন্য সময় সময় শুনবেন, আজ সরকার আড়িপাতার জন্য এই ফাঁদ তো আগামীকাল অন্য ফাঁদ পাতানোর জন্য কিছু না কিছু ক্রয় করেই চলেছে। আপাতত বাংলাদেশে ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপ এর ডাটা আর সংরক্ষিত নাই, প্রাইভেসি নাই। এই সমস্ত কিছুই এখন পাবলিক। প্রাইভেটে কিছু করতে যান, দেখবেন অথোরিটি ভয় পাচ্ছে এবং শাস্তিও দিচ্ছে। এমনকি পটেনশিয়াল থ্রেট হতে পারে এমন স্ট্যাটাস দেওয়া ব্যক্তিকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এখানে কারো একা থাকা কে আত্মকেন্দ্রিক বলা তারচেয়েও বেশি অদ্ভুত মনে করা। রাষ্ট্র মনে করতে পারে, সে হয়তো টেরোরিস্ট, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো পরিকল্পনা করছে। আপনি যা বলার, যা করার সবার সামনে করুন। সবাই সবার ব্যাপারে নাক গলাবে। আপনার কাছে কোনো ইভেন্টের ফটো নাই, তাইলে ঐ ইভেন্ট-ই ঘটে নাই। যা ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ বইতে সরাসরি দাবী করা হচ্ছে।
কেন এমন মনে হয়, আমাদের বর্তমান কালচার সেই ১৯৩২ সালে লিখে যাওয়া লেখক হাক্সলি কে সবস্ক্রাইব করছে। কেন এমন মনে হয়, আজকাল আমরা সম্পর্ক, ভ্রমণ বা কোনো আয়োজন আমরা উপভোগের চেয়ে ফিল্টারড্ সোশ্যাল মিডিয়াতে ফটো করে টাঙিয়ে রাখছি। আমাদের জীবন আমরা যতটা উপভোগ করছি তারচেয়ে বেশি সেই উপভোগের প্রমাণ চাইছি!
আজ এই পর্যন্তই, খোদা হাফেজ!