তীজ উৎসব: করলার তেতো স্বাদে মিষ্টি স্মৃতি
ছত্তিশগঢ়ের গ্রামেগঞ্জে নারীদের সামাজিক বন্ধন ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি
ভাদ্র মাসের তৃতীয়া বা ‘তীজ’—ছত্তিশগঢ়ের গ্রামেগঞ্জে এই উৎসব শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং সংস্কৃতি, সম্পর্ক ও নারীর সমাজিক বন্ধনের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। বাসস্ট্যান্ডে ভিড়ের দৃশ্যটাই এর সূচনা। ডিলাক্স বাসে ঠেসে ঠেসে উঠছেন মহিলারা, কোলে শিশু, হাতে থলে—সবাই বাপের বাড়ি (মায়কা) যাওয়ার তাগিদে। বাসের ভেতরে তিল ধারণের জায়গা নেই। অধিকাংশ যাত্রীই বিবাহিতা নারী, যাদের সঙ্গে কচিকাঁচারা। কারও গন্তব্য এক ঘণ্টা, কারও আট ঘণ্টার পথ। এই ভিড়ের মধ্যে অশ্বিনী তার ছোট জাকে টেনে নিয়ে বলছে, “এ ছোটী, তুই যে শাড়ি পরবি, ওটা লহঙ্গা নাকি সাধারণ? না হলে আমার কাছ থেকে নিয়ে নে!”
মায়কার ডাক: পরিবারের পুরুষদের ভূমিকা
তীজের নিয়ম অনুযায়ী, বিবাহিত মেয়েদের বাপ বা ভাই তাদের নিজ বাড়ি নিয়ে যান ব্রত পালনের জন্য। অশ্বিনীর বাবা এসেছেন আগের দিনই, আর তার ছোট জার ভাই এসেছে বোনকে নিয়ে যেতে। উভয় পরিবারের পুরুষদের এই দায়িত্ব সামাজিক রীতি। শাড়ি-গহনা, শিশুদের জিনিসপত্র গুছিয়ে মহিলারা রওনা দেন। বাসে ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুঁতির মধ্যেও মুখে হাসি—মায়কায় পৌঁছানোর আনন্দে সব ক্লান্তি ভুলে যায়।
মায়কায় পদার্পণ: আড্ডা, রান্না ও করলার মেলা
বাপের বাড়ি পৌঁছেই শুরু হয় ভাইবোন, প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের সঙ্গে গল্পগুজব। রান্নাঘরজুড়ে করলার ঘ্রাণ। সন্ধ্যায় ‘করু ভাত’ (করলা তরকারি ও ভাত) খেয়ে উপবাস শুরু করার রেওয়াজ। তবে এই ‘করু ভাত’ প্রতিটি বাড়িতে স্বতন্ত্র! একেক রান্নার কৌশল একেক রকম:
- মালতী বলে, “আমার বাড়িতে সাদা করলা শাক বানানো হয়!”
- চৈতি জানায়, “আমার শাশুড়ি বেসন মাখিয়ে করলা ভাজেন। ভিতরে জিরা, ধনিয়া, মরিচ, সর্ষে দিয়ে স্টাফ করা!”
- মিলিয়া হাসতে হাসতে বলে, “আমার দাই (বড় ননদ) দই আর ইমলি দিয়ে টক-ঝাল করলা বানায়! মুখে জল আনে!”
- দুলম যোগ করে, “আমার ভৌজী (জা) তো করলার ভর্তা বানায়, পুড়িয়ে মসলা কুটা!”
করলার এই রকমফের শুনে কলমী বলে ওঠে, “বস রে, শুনলে মুঁহে পানি চলে আসে!” সবার হাসিতে ভরে যায় উঠোন।
বাজারের হাল: করলার রেকর্ড বিক্রি
তীজের দিনে ছত্তিশগঢ়ের বাজারে করলার চাহিদা আকাশছোঁয়া। একসময় এই সবজি মৌসুমি ছিল, কিন্তু এখন সারা বছর পাওয়া গেলেও তীজে এর দাম চড়ে যায় কয়েক গুণ! স্থানীয় কৃষকরা আগে থেকে জমি থেকে করলা জোগাড় করে রাখেন। কথিত আছে, একদিনে এত করলা বিক্রি হয় যে গিনিজ বুক অব রেকর্ডসে নাম ওঠানোর যোগ্য!
২৪ ঘন্টার কঠোর ব্রত: নিরম্বু উপবাস
করু ভাত খেয়ে শুরু হয় কঠোর উপবাস। পরের দিন সূর্যোদয় থেকে পরদিন সূর্যোদয় পর্যন্ত এক ফোঁটা জল খাওয়া নিষেধ। বিবাহিত নারীরা স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনায় এই ব্রত পালন করেন। উপবাসের পরের দিন গণেশ চতুর্থী। স্নান সেরে ঝলমলে শাড়ি, চুড়ি, সিঁদুরে সাজেন মহিলারা। পূজার শেষে ‘তবপ জল’ (তুলসী জল) ও ফলাহারি দিয়ে উপবাস ভাঙা হয়।
স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও লোকবিশ্বাস:
কথিত আছে, করলার তেতো রস রক্ত পরিষ্কার করে, লিভার সুস্থ রাখে ও পেটের অ্যাসিডিটি রোধ করে। বৈজ্ঞানিকভাবে করলায় থাকা ‘মমর্ডিকা চারান্টিয়া’ যৌগ অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর। তাই ২৪ ঘণ্টার উপবাসে দুর্বলতা এড়াতেই করলা খাওয়ার এই প্রথা। স্থানীয় ডাক্তাররা বলেন, “করলা খেয়ে উপোস শুরু করলে পেটে অম্লতা বাড়ে না, এটা প্রাচীন চিকিৎসাবিদ্যার সমর্থন পায়!”
মায়কা থেকে সসুরাল: ফেরার পথে মিষ্টি সমঝোতা
ব্রত শেষে বাবা বা ভাই মহিলাদের ফেরত নিয়ে যান শ্বশুরবাড়ি। ফেরার পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হালকা রসিকতা চলে:
- “কালা (প্রিয়তমা), শ্বশুরবাড়ি থেকে কি কি মিষ্টি ঠুসে এনেছ?”
- “কুমহাড়া, কচুই, বেসন বন্ধি, রামকলি—নাও, মন ভরে খাও!”
- “ওরে, ক্ষীর পুড়ি খেয়েছিস নাকি? পেট ভরে গেল নাকি?”
সংস্কৃতির অনুষঙ্গ: ওড়িশার ‘নওয়া খাই’
এই সময়ে ওড়িশায় পালিত হয় ‘নওয়া খাই’ উৎসব—নতুন ধান উৎসর্গের রীতি। যদিও তীজের সঙ্গে এর সরাসরি যোগ নেই, তবু দুই সংস্কৃতির মেলবন্ধন দেখায় পূর্ব ভারতের বৈচিত্র্য।
শেষ কথা: তীতার মধ্যেই মিষ্টির সন্ধান
প্রতি বছর ভাদ্র মাসে এই উৎসব শুধু ধর্মীয় আচার নয়, নারীদের একত্রিত হওয়া, রান্নার রসিকতা, পারিবারিক মেলবন্ধনের মাধ্যম। করলার তিতা স্বাদ যেমন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, তেমনি তীজের ব্রত সামাজিক সম্প্রীতির মিষ্টি সুর বাজায়।
— “করলা খেয়ে উপোস করলেও, মায়কার মিষ্টি স্মৃতি তো চিরকালের!”