বাংলা কবিতার বর্তমান অবস্থা: হারানো গৌরব ও নতুন সম্ভাবনা
অনুবাদের চ্যালেঞ্জ ও গুরুত্ব, এবং বাংলা সাহিত্যের বিশ্বমঞ্চে পুনরুত্থান
বাংলা সাহিত্য ক্রমশঃ বিশ্বের কাছে হারিয়ে ফেলছে গুরুত্ব, কবিতার পাঠক সেখানে ক্ষীয়মান। অন্যদিকে, বাংলা কবিতা নদীর মতো বাঁক নিয়ে এগিয়ে চলেছে, কতটা কাল তার অন্দরে প্রবেশ করে ধন দৌলত খোঁজো। পথের সন্ধান দিয়েছি, পথিক তোমরা।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পাঠ
প্রায় বছর চল্লিশেক পূর্বে সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবির সম্মান পাওয়া উপলক্ষে মঞ্চে নিজের কবিতা পাঠ করছেন, কবিপত্নী ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিচ্ছেন। মধ্যপ্রদেশের ভোপালের হলের অডিটোরিয়াম স্তব্ধ।
শেষ হয়ে গেলে কন্নড় কবি এইচ এস শিবপ্রকাশ বলেন, “কবিতা আমায় টানলো না।” সে কি! বামপন্থীর কবিতায় এতো সূক্ষ্মতা দেখা যায় না। কবিতায় হীরের কুচি ছড়িয়ে আছে। কন্নড় কবি বলেন, “ইংরেজি অনুবাদে আমার মনে হলো না দ্যাটস দ্য পোয়েমস আর গ্রেট। আমাকে বাংলা শিখতে হবে।” হ্যাঁ ঠিকই অনুবাদে তো হীরের কুচি হয়ে যায় কাঠের কুচি।
বাংলা কবিতার অবস্থান
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ভিন্ন আর কেউ স্থান করে নিতে পারেনি কন্নড় না মরাঠিতে।
- কোনও বাঙালি কবি: ত্রিবান্দ্রামে জায়গা পাননি।
- কেরল আর বাংলার মাঝে: বটবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে কার্ল মার্ক্স। সেখানে সমর সেন, বিষ্ণু দে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জায়গা নেই। জায়গা নেই সুকান্তর।
অনুবাদের গুরুত্ব
‘বনলতা সেন’ কন্নড় কবিতা হতে পারে নি। বিশ্বময় কি ভাবে জানবে লোকে বাংলা কে যদি না তার হয় সঠিক অনুবাদ! অনুবাদ এক সাধনা। বুদ্ধদেব বসু বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিজের আত্মাকে, বোদল্যর রাইনার মারিয়ার কাছে, বন্ধুত্ব বিক্রি করেছিলেন পাস্তেরনাকের কাছে, মেঘদূতের কাছে। বুদ্ধদেব নিজের উচ্চতস হ্রাস করে আমাদের কাছে ইউরোপ তুলে ধরে তুলেছিলেন।
বাংলা কবিতার ভাবনা
বাঙালির ভাবনা নেই নিজের ঘরের প্রতি কোথায় মালয়ালম, হিন্দি, মণিপুরী, সে ভাবে ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ নিয়ে। মনে হয় কালিদাস না হলেও চলতো, শেকসপিয়র তো আছে!
অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা
শঙ্খ ঘোষ অনুবাদিত ইকবাল রয়েছে। নামদেও ধামাল না করলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক বিভাগে তাঁর কবিতা পড়ানো হতো না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এক একটি ট্রান্সলেটর সেন্টার খোলা যেতে পারতো!
অনুবাদের চ্যালেঞ্জ
সব সময় গ্রান্ট, অনুমোদনের দিকে না তাকিয়ে নিজেকে এগোতে হয়। কোন গ্রান্ট পাননি কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাভারতের যুগান্তকারী অনুবাদ করতে, আলেকজান্দ্রা পোপ ইলিয়াড ওডিসি একা করেছিলেন। এঁরা এক এক নির্জন মানুষ এক এক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো।
বাংলা কবিতার বিস্তার
বাঙালি কি ইনসুলার! তাহলে সেই যে রবি ঠাকুর ছোট এক গ্রামে জড়ো করেছিলেন ম্যানচেষ্টার, মনিপুর জাপান, জাভা সবাই কে এক উঠোনে! সমালোচক তখন বলেন বেশ। তারপর? এখন কি হলো! মরাঠি বই অনুবাদ হয়? জীবনানন্দ আমরা পড়ি, তোমরা পড়ো বেন্দ্রো। আমরা বিষ্ণু দে। তারাশংকর মালয়ালি স্কুলে লেখক হিসেবে পরিচিত। সম্মানটা কিন্তু ভারতীয়রা বাংলা কে দিয়েছে। বাংলা ভরতীয়দের দেয়নি। বলে, ধুর! বিহারি আবার লিখবে কি! ওডিশায় কবি হলো কবে!
বাংলা কবিতার রেনেসাঁ
আবার বলা পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতার রেনেসাঁ! সুনীল, শক্তি, শঙ্খ, আলোকরঞ্জন, বিনয়। এঁরা যে বাংলা কবিতার ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ এর গণিত বদল করে দিয়েছিলেন। আরও কত দাপট – আলোক সরকার, শরৎকুমার, তারাপদ রায়, কবিতা সিংহ। এঁদের প্রয়াণে সবাই বলে, “ওহে কবিরা সব গেলেন কোথায়!” গুণতিতে আছেন এখন জনা চার, পাঁচ প্রবীণ।
বাংলা কবিতার অপমান
বাঙালি অপমান করছে ভারতবর্ষের বাংলা কবিতাকে। অসমের নরকান্ত বরুয়া, নীলমনি ফুকন, ওডিশার ‘শ্রী রাধা’ লেখক রমাকান্ত রথ, গুজরাতি কবি সীতাংশু যশচন্দ্র। কেদারনাথ হিন্দি কবিতাকে আধুনিক করো জ্ঞানপীঠ পেলেও তাঁকেও বাঙালি আপন করে কাছে টানলো না।
ইংরেজি কবিতার ফ্রন্টলাইন
ইংরেজি কবিতা এখন ভারতীয় কবিতার ফ্রন্টলাইন ধরে রেখেছে। জয়ন্ত মহাপাত্র এখন কটকে থেকেও ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজি কবিতাকে বাংলা কবিতার সামনে টাঙিয়ে এক চ্যালেঞ্জ দিয়ে দিলেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
মাইকেল মধুসূদন কে ধমক ধামক দিয়ে মদ ছাড়ানোর চেয়েও দুঃসাহসী কাজ ইংরেজি কবিতা লেখা ছাড়ানো হয়েছিলো। শব্দের সঙ্গে শব্দের বিবাহ দেওয়া মধুসূদন মেঘনাদ বধের অমিত্রাক্ষরে গ্রেট রাবণের দীপ্তি হারিয়ে যেতে দেননি। একই ছত্রে অসংখ্য অর্থের ‘ফেনাময়’, ‘ফনাময়’, ‘ফনিবর’ এই ত্রি-শব্দে কোথাও সেই ছন্দ কে তরল করে দেয়নি।
১৮৭৩ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে কনফেশন (লাস্ট) দিতে একেবারে। শেষে বলেছিলেন, “আপনাদের যেখানে খুশী আমায় সমাধিস্থ করেন… আমার কবরের ওপর যেন গজিয়ে ওঠে সবুজ ঘাস।” পরবর্তীতে কেউ নিশ্চয় লক্ষ করেছেন জীবনানন্দের ‘ঘাস’ কবিতাতে হয়তো পাবেন ঘাস নতুন জীবনের ইঙ্গিত, সে ঘাস জন্মাশ কবির সমাধিতে। সেই মধুসূদন আজ দুশো বছরে দেখছেন কি পরিমাণ ইংরেজি কবিতা ভারতীয় অলিতে-গলিতে রচিত হচ্ছে?
কবিতার আত্মা
সেই কবিতার আত্মা কিন্তু বাঙালি, মারাঠি, কোনকোনি, সাঁওতালি এমন কি দলিতও। গালিব একবার তাঁর কবিতাশ আক্ষেপ করেছিলেন, “একদিকে সীমাহীন কাতরতা অন্যদিকে নির্বিকার নিশ্চুপতা।” গালিব আল্লাহ, ঈশ্বর বা প্রেমিকা যাকেও বলে থাকুন, সীমাহীন কাতরতা নিয়েই কবিতার জগত তৈরী ও সীমহীন নিশ্চুপতা এক কবিকে এগোতে সাহায্য করে।
কৃতজ্ঞতা
সুবোধ সরকার
শ্বেতা মিত্র
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.