সিরিয়ার ৫৪ বছরের শাসনের অবসান: বাশার আল-আসাদের পতন এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
আলাওয়াইট শিয়া মুসলিমদের শাসন থেকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী HTS-এর উত্থান: সিরিয়ার নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ
বাশার আল-আসাদ এবং তার পরিবার প্রায় ৫৪ বছর ধরে সিরিয়া শাসন করেছেন। ১৯৭০ সালে হাফেজ আল-আসাদ ক্ষমতায় বসেন। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন তার পরবর্তী বা উত্তরসূরি হিসেবে শাসনে আসবেন তার-ই বড় ছেলে বাসেদ আল-আসাদ। ১৯৯৪ সালে বাসেদ আল-আসাদ একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান এবং ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসেন তার নিকট ছোট ভাই বাশার আল-আসাদ।
বাশার আল-আসাদের প্রারম্ভিক জীবন
বাশার আল-আসাদ ১৯৮৮ সালে দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রী অর্জন করার পর তিনি লন্ডনে যান চক্ষু চিকিৎসা (অপথালমোলজি) নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য। সেখানে গিয়ে পরিচয় ঘটে আস্মা আখরাসের সাথে। আস্মা আখরাস হলেন একজন ব্রিটিশ-সিরিয়ান। ২০০০ সালে তাদের বিয়ে হয় এবং তাদের তিনটি সন্তান আছে: হাফেজ, জেইন ও কারিম। তার পতন ঘটলো এই ডিসেম্বর মাসে। তিনি তার শাসনকালে সমর্থন পেয়েছিলেন রাশিয়া ও ইরানের।
শাসনের প্রারম্ভিক দিনগুলো
বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় আসার পর সিরিয়ার মানুষজন তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তাদের শাসক গণতন্ত্রের কথা বলেন, বাক-স্বাধীনতার কথা বলেন, মানবাধিকারের কথা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনমূলক আচরণ কে মোটেই ভালো চোখে দেখেন না, সিরিয়ায় তো নয়-ই; ইরাকেও না। এছাড়াও সাংবিধানিক পরিবর্তন ও পরিমার্জন সহ বিরোধীদলীয় মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন ইত্যাদি।
বাস্তবতা ও প্রত্যাশা
কিন্তু এই সবই ছিলো খাতা-কলমে। মাঠের দৃশ্য ছিলো পুরোই উল্টো। পশ্চিমা চিন্তা দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত বাশার আল-আসাদ নিজ দেশে এসে পশ্চিমা সংস্কৃতিও কায়েম করতে ভুলে যান। উল্টো, সকল ধরণের বিরোধী মতকে উপেক্ষা করেন। ব্যাপক ধরপাকড় ও নির্যাতন শুরু করে দেন। এমনকি গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে যায় সিরিয়া। ফুটে উঠে একজন সত্যিকারের উগ্র কর্তৃত্ববাদী শাসকের চেহারা। তিনি মোটামুটি তার বাবাকেও ছেড়ে যান বিভিন্ন প্যারামিটারে। সিরিয়ায় একটি ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের এই পারিবারিক শাসন ও শোষণ আরো দীর্ঘায়িত হয়।
গৃহযুদ্ধ ও বিরোধী আন্দোলন
২০১১ সালে শুরু হয় এই সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। এরপর সরকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কথা না শুনলে আন্দোলন হয়ে ওঠে আরো তীব্র এবং দমনও হয়ে ওঠে আরো তীব্র। ২০১১ থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই গৃহযুদ্ধে মারা যায় আনুমানিক ৪ লাখ ৭০ হাজার থেকে ৬ লাখ ১০ হাজার মানুষ। শুধু তাই নয়, আয়নাঘরের মত ব্যাপক আয়োজন করে ঘরবন্দী করে নির্যাতন করা হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষকে। যাদের অনেকেই ইতোমধ্যেই মুক্তি পেয়েছেন এবং ভয়ানক ভয়ানক সব তথ্য বের হয়ে আসছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন
মানবাধিকার সংগঠন সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটসের তথ্য অনুযায়ী, আসাদের কারাগারে অন্তত ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৪ বন্দি ছিলেন। এরপর মাঠে নামেন ‘হায়াত তাহরির আল-শাম (HTS)’ এবং বাশার আল-আসাদের খেলা খতম করেন।
হায়াত তাহরির আল-শাম (HTS)
কিন্তু কারা এই ‘হায়াত তাহরির আল-শাম (HTS)’? বাশার আল-আসাদের পতনে প্রধান বিপ্লবী দল হলো এই হায়াত তাহরির আল-শাম (HTS)। ‘HTS’ মূলত আল-কায়েদার একটি শাখা হিসেবে গঠিত হয়েছিল এবং বর্তমানে এটি সিরিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। মানে আরো খণ্ড খণ্ড অনেক বিদ্রোহী গোষ্ঠী আছে এখানে তাও বিভিন্ন অঞ্চলে। জোর যার দখল তার হিসেবে।
HTS-এর নেতৃত্ব
HTS-এর নেতৃত্বে ছিলেন আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি, যিনি আগে ইরাকে আল-কায়েদার হয়ে লড়াই করেছিলেন এবং আমেরিকান বাহিনীর হাতে বন্দী হয়েছিলেন। HTS এবং তুরস্ক সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (SNA) মিলে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কাস দখল করে এবং আসাদ সরকারকে উৎখাত করেন। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে মাত্র ১০ দিনের মধ্যে দামেস্কাস সহ চারটি শহর দখল করে।
আলাওয়াইট শিয়া মুসলিম
এই পুরো ঘটনায় খুব সম্ভবত আমরা সবাই এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রদায়কে চিনতে ভুল করছি। এই সম্প্রদায় হলো ‘আলাওয়াইট শিয়া মুসলিম’। বাশার আল-আসাদ একজন আলাওয়াইট শিয়া মুসলিম। আলাওয়াইটরা শিয়া ইসলামের একটি শাখা, যা সিরিয়ার জনসংখ্যার একটি ছোট অংশ। আসাদের শাসনামলে, আলাওয়াইট সম্প্রদায়ের সদস্যরা প্রশাসনের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
সিরিয়ার জনসংখ্যা
সিরিয়ায় ৭০% শতাংশ সুন্নি মুসলিম রয়েছে আর ১০-১৫% এই আলাওয়াইট শিয়া মুসলিম। কিন্তু এই ১০-১৫% মানুষদের হাতে ছিলো সিরিয়ার ভাগ্য অন্তত এই ডিসেম্বর পর্যন্ত। রাজনৈতিক ভাবে এখানে একধরণের ‘আরব জাতীয়তাবাদ’ প্রতিষ্ঠিত ছিলো। বাশার আল-আসাদের এই পার্টির নাম হচ্ছে ‘আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি (Arab Socialist Ba’ath Party)’। আর এই পার্টির সমর্থক হিসেবে দেখা যায় এই আলাওয়াইট শিয়া সম্প্রদায়।
আরব জাতীয়তাবাদ
মনে রাখার মত বিষয়, এরাই সেই পার্টি যারা গৃহযুদ্ধের সময় বাশার আল-আসাদের সমর্থক ছিলো। তাহলে কি শিয়া বলেই ইরানের সমর্থন ছিলো? আর ইরানের সমর্থন পাওয়া মানেই রাশিয়ার সমর্থনও পাওয়া! মোটাদাগে আমার অন্তত এটাই অনুভূত হচ্ছে।
আরব বসন্ত ও রাজনৈতিক সমীকরণ
আবার আরব জাতীয়তাবাদ এত সুন্দর বা সহজ শব্দ নয়। এছাড়াও আরব বসন্ত নিয়ে বিশাল আলোচনা করা সম্ভব। অনেক মানুষকে মুক্তির খবর আমাদের অবশ্যই ভালোলাগার। ৫৪ বছরের শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তিও আনন্দের, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এই HTS সিরিয়াকে কি উপহার দিতে যাচ্ছে? এবং বাকি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির সাথে বোঝাপড়া কীভাবে করবে? বা, বর্তমানে ইসরায়েলের যে হামলা সেগুলো সামাল দেবে কীভাবে? অথবা, মধ্যপ্রাচ্যের নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ কোনদিকে ঘুরে গেলো? এই প্রশ্নগুলো সকল মানুষদের মনে রয়েই গেলো।
ভবিষ্যতের প্রশ্ন
হ্যাঁ, আনন্দের সাথে অনেকগুলো প্রশ্ন রয়ে গেল। আরো মৃত্যু না হোক এই কামনায়।
পরিশেষ
বাশার আল-আসাদের শাসনের অবসান সিরিয়ার জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। তবে, ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি কীভাবে উন্নত হবে তা দেখা যাবে। আশা করা যায়, সিরিয়ার মানুষজন শান্তি ও সমৃদ্ধির দিনগুলো দেখতে পাবে।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.