Lagegi aag to aayenge ghar kai zad me, yahan pe sirf hamara makan thodi hai…
– Dr. Rahat Indori
যখন আমাদের নিজেদের বাড়িতে আগুন লাগে এবং ঐ আগুন নেভানোর কোনো উপায় থাকে না তখন বুঝা যায় ঐ তীব্র আগুনের সামনে আমরা কতটা অসহায়। আগুন তো আসলে ফারাক করতে পারে না যে, কে দোষী এবং কে নির্দোষী। শুধু সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।
মাত্র সামান্য ক’টা মিনিট আমাকে সময় দেওয়া হয়েছে, বের হয়ে যেতে হবে নিজের বাড়ি থেকে। অনেক স্মৃতি বিজড়িত নিজ বাড়ির সমস্ত কিছু রেখে খালি হাতে পালিয়ে যেতে হবে উত্তর/দক্ষিণ বা পূর্ব/পশ্চিমে, তাও আবার পঁচা-গলা অনেকগুলো লাশের মধ্যে দিয়ে।
দ্রুত বের হতে গিয়ে খাবার, ঔষধ এবং প্রয়োজনীয় কিছুই হাতে নেওয়া হলো না। সাথে স্ত্রী আছে। আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। ওর হাতে হাত রাখতেই বুঝলাম, কিছু একটা হয়েছে। হঠাৎ দেখলাম সামনে আমার ৮ বছর বয়সী ছোট মেয়েটা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। অন্ধকার রাতে ওর কাছে গিয়ে ওর হাতে হাত রাখতেই ভীষণ ঠান্ডা অনুভূত হলো। কপাল বেয়ে গরম রক্ত ঝরছে মাটিতে। একেবারে ব্ল্যাঙ্ক পয়েন্টে ‘ওরা’ ফাতিমা কে গুলি করেছে।
সেদিন আমি ও আমার স্ত্রী কিছুদূর গিয়ে একটি অন্ধকার ধ্বংসস্তুপের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলাম। একটু পরপর বিকট শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবে রাতটা পার করে ভোরবেলায় ভয়ে ভয়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। পুরো বাড়ি বিশাল কিছু একটার আঘাতে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। দেখে বুঝার উপায় নাই, এই জায়গায় একদিন একটি আস্ত বাড়ি ছিলো, সুন্দর বাগান ছিলো, পাশে খেলার মাঠ ছিলো। আর ছিলো হাজারো স্মৃতি।
স্মৃতি বিজড়িত ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়াতেই খেয়াল হলো আমার স্ত্রী’র কথা। ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন। চারপাশে যতগুলো যানবাহন আছে তার সবগুলোই অকেজো। বেশিরভাগ চেনাই যাচ্ছে না। এসব এলাকায় আগে গণপরিবহন চলাচল করতো। খুব কাছের হাসপাতালও ১০ কিলোমিটার দূরে। আমরা দু’জন খুব কষ্ট করে সেখানে হেঁটেই পৌঁছালাম।
কিন্তু একি! পুরো হাসপাতালও একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। চারপাশে হাজার হাজার মানুষ। কারো বা চোখ নাই, কারো পা বিস্ফোরণে উড়ে গেছে, কারো তো দেহের একটা অংশ পুরোপুরি নাই। রক্তেমাখা শরীর নিয়ে দুইহাত দিতে হামাগুড়ি দিয়ে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্য শেষ চেষ্টা করছে। হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলাম, কোনো ডাক্তার নাই, বিদ্যুৎ নাই, ঔষধগুলো ছড়ানো ছিটানো আর অনেক অনেক মানুষ মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। কিছু গর্ভবতী নারীরা বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে ডাক্তারের সাহায্য ছাড়াই কাতরাচ্ছে।
আমি এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি ঠিক জানিনা এই মানুষগুলোর ঠিক কি দোষ? বা, আমাদেরও বা কি দোষ? একটু বাদেই রকেটের বেগে কিছু একটা আছড়ে পড়লো এই হাসপাতালের ঠিক কেন্দ্রে। আমি দূরে ছিটকে পড়ে গেলাম।
হুঁশ ফিরতেই দেখলাম, হাসপাতালের অবশিষ্ট আর কিছুই নাই। আর এর সাথে সাথে নেই শান্তিতে শেষ নিঃশ্বাস নেওয়া এবং অনাহারে থাকা হাসপাতালের সব মানুষ। মিনিটের মধ্যে খেয়াল হলো, আমার স্ত্রী আমার সাথে নাই। একটু দূরে হাসপাতালের সামনে তার ছন্নছাড়া বিভৎস রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। আমার ওর কাছে যাবার আর সাহস হলো না। ওভাবে আমি ও কে দেখতে পারবো না।
আমি যতদ্রুত সম্ভব ওখান থেকে পালিয়ে গেলাম। পাশে আমার এক বন্ধুর বাড়ি। কিন্তু যতদূর চোখ যায় ততদূর ধ্বংসস্তূপ আর মানুষের লাশ ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমার বন্ধুর বাড়ির সামনে যেতেই দেখলাম এক যুবক দাঁড়িপাল্লায় কি যেন মাপছে! তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি এসব কি মাপছো?” যুবকটি বললো, “মৃত মানুষকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না, তাই সবাইকে একত্র করে কেজি হিসেবে তাদের হাড়গোড় আর মাংস ভাগ করে তাদের আত্মীয়স্বজনদের দেওয়া হচ্ছে।”
আমি জানিনা এই মাংসের ভাগগুলো যখন বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছাবে তখন মানুষ কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবে? যারা একসময় তাদের অতি প্রিয় মানুষ ছিলো, যারা তাদের ছোট ছোট বাচ্চা ছিলো! এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো, আমি বেহুঁশ হয়ে যেতে পারি। আমি এই অমানবিক হত্যাযজ্ঞের স্বাক্ষী হয়ে গত ১ বছরেরও বেশি এখানে জীবিত ভূতের মত ঘুরে বেড়াচ্ছি। হারিয়ে ফেলেছি নিজের ও কাছের সবটুকু।
আরো একটু দূরে যেতেই দেখলাম একটি ছোট বাচ্চা তার মৃত বাবা-মায়ের লাশের পাশে বসে আছে। সে মনে করছে তার বাবা-মা হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। তাই তাদেরকে জাগানোর চেষ্টা করছে, খুব চেষ্টা করছে। আমাকে দেখেই আমার কাছে দৌড়ে আসলো, আর একটি খালি পানির বোতল দেখিয়ে দিলো। এক গ্লাস পানি ওর খুব দরকার। কিন্তু আমি খুবই অসহায় বোধ করছি। বাচ্চাটাকে এক গ্লাস পানি দেবার মত পানিও নাই আমার কাছে। সব জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে।
একটুবাদেই বিমান থেকে একাধিক লিফলেট জমিনে এসে পড়তে শুরু করলো। স্পষ্ট করে লেখা আছে, “এই অঞ্চল থেকে ৫ মিনিটের মধ্যে সরে যেতে হবে।” আমি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার জানা মতে, এই অঞ্চলে, কোথাও আর পানি নেই, খাবার নেই, বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই। একটি হাসপাতাল ছিলো সেটাও চোখের সামনে উড়ে গেছে। কোনো সাহায্যকারীও নাই। তাই মিথ্যে আশ্বাস নয়, বাচ্চাটাকে মৃত বাবা-মায়ের কোলে রেখে এই জায়গা থেকে আমি পালিয়ে গেলাম।
একটুবাদেই দূর থেকে দেখলাম ভারি কিছু সেখানে বর্ষণ হতে শুরু করলো। ধূলায় মিশে গেলো ঐ বাচ্চা সহ ওর শেষ স্মৃতি ওর মৃত বাবা-মায়েরা। চারপাশটা দেখে মনে হলো এখানে এই পর্যন্ত ২০ হাজার টনেরও বেশি বোমা ও গোলাবারুদ ফেলা হতে পারে। বিশাল ধ্বংসস্তুপের মধ্যে আমার শুধু একটাই জিজ্ঞাসা, “এই সবগুলো মানুষ-ই কি অপরাধী ছিলো? এমনকি ঐ ছোট বাচ্চাও?”
আরো সামনে হাঁটতে হাঁটতে বুঝলাম ক্লান্ত লাগছে কিন্তু তারচেয়েও বেশি ঠান্ডা লাগছে। সামনে ছোট্ট একটি লাইট জ্বলজ্বল করছে। ভেতরে গিয়ে দেখলাম, একটি ছোট বাচ্চা কনকনে শীতের মধ্যে কাঁপছে। কাছে যেতেই ভয় পেয়ে বললো, “আমাকে মেরে ফেলবেন?” আমি শুধু জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার বাবা-মা কোথায়?” এই বাচ্চাটি শুধু বললো, “আমি যদি এভাবেই লুকিয়ে থাকি তাহলে আল্লাহ্ আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।” আমি পুনরায় জিজ্ঞেসা করলাম, “এই কথা তোমাকে কে বলেছে?” সে উত্তর দিলো, “আমার বাবা!”
আমার পরিহিত জ্যাকেট তাকে দিয়ে দিলাম। আমি জানি এই বাচ্চাটাকেও আমি বাঁচাতে পারলাম না। আসলে যে নিজ পরিবারকেই বাঁচাতে পারেনা সে কীভাবে অন্য পরিবারের ফেলে যাওয়া এতিম বাচ্চাকে বাঁচাবে? শুনেছি, এই পর্যন্ত এই অঞ্চলে মোট ৪১ হাজার ৮২৫ জন মারা গেছেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় ১৩ হাজারেরও বেশি শিশু ছিলো।
আমি জানিনা আজকের এই রাত আমি পাড়ি দিতে পারবো কিনা। তাছাড়াও আমার শুধু জানার ছিলো, এত এত ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে মোট কি পরিমাণ টাকা লেগেছে ‘ওদের’? আর কারা এই টাকাটা দিয়েছে? ওদের এক দূরদূরান্তে থাকা বন্ধু আছে। এই হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে ‘ওদের’ বন্ধুরা এই পর্যন্ত নাকি ১ হাজার ৭৯০ কোটি ডলার সহায়তা করেছে।
প্রচুর ঠান্ডায় এবং অনাহারে থাকায় একসময় হুঁশ হারিয়ে ফেললাম। হুঁশ ফিরতেই সামনে দেখি একটি টেলিভিশন। কীভানে এখানে সংযোগ পেয়েছে তা ঠিক জানিনা। টেলিভিশনের পর্দায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। উপরের দিকে লেখা ‘CNN’, আর নিচের দিকে লেখা ‘Los কিছু একটা…’। শুনেছি এই চ্যানেল হলো ‘ওদের’ দূরদূরান্তে থাকা বন্ধুদের চ্যানেল।
তবে কি তারা কর্মের প্রতিফলন পাচ্ছে? না, ভুল হবে। এসব ক্লাইমেট চেইঞ্জ। এক বুড়ো মানুষ কান্নাকাটি করছেন, নিচে লেখা ‘জেমস কাঠ’। তার একটু উপরে লেখা ‘অভিনেতা’। ভদ্রলোকটিকে আমি ঠিক চিনি না। ভয়ানক দাবানলে সেখানে সবাই দৌড়াদৌড়ি করছেন। কিছুটা আমাদের মতই।
হঠাৎ খেয়াল করলাম, হাত-পা অবশ হয়ে গেছে। আমি আর নড়াতে পারছি না শরীরের কোনো অংশ! মনে হয়, দুই দিনের দুনিয়ায় এখানেই আমাকে সমাপ্তি টানতে হবে। শুধুমাত্র একটি প্রশ্নের উত্তর পেলাম না, “কেন সবাইকে মেরে ফেললেন?”