নির্মলা তার দেহদানের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ছড়িয়ে দেয়। তার বড়ো জা রমা প্রথমে এই সিদ্ধান্তে অবাক হলেও, নির্মলার ব্যাখ্যা শুনে তিনি দেহদানের গুরুত্ব বুঝতে পারেন। এই গল্পটি দেহদানের মাধ্যমে মানুষের উপকার এবং পুন্য অর্জনের বিষয়টি সুন্দরভাবে তুলে ধরে। এটি পাঠকদের দেহদানের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে এবং সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের আহ্বান জানায়।
বড়ো জা রমা এসে দাঁড়ালেন নির্মলার কাছে। বারান্দায় টাঙানো অবশিষ্ট দু’একটি পাখী রয়েছে তাদের দানা দিচ্ছিলো সে। দুটো পাখী কথা খুব সুন্দর শিখেছে। বলে তারা উপহার নাও। শেষ উপহার নাও। স্পষ্ট না হলেও বোঝা যায়। আশ্চর্য ব্যাপার। এই অদ্ভুত কথা পাখীদের শিখিয়েছে নির্মলা। সাধারণত পাখী কারুর নাম ধরে ডাকে।
পাখীদের কথা শিখানোর গোপন অর্থ
“হ্যাঁ রে এ কি কথা শিখিয়েছিস তুই পাখীকে? এর মানে কি শুনি?” নির্মলা হাসতে হাসতে বললো, “কেন বড়দি ডাকটা তোমার ভাল লাগে না?”
- জানি না বাপু এ কেমন ডাক, উপহার নাও!
- বড়দি গো এর গভীর অর্থ আছে। এসো তোমায় বোঝাই।
- আমার এখন সময় নেই বাপু তোর পাখীর বুলি বোঝবার। কাজকর্ম, পুজো পাঠ পড়ে রয়েছে। স্নানে যাই।
দেহদানের প্রস্তুতি
সেদিন দুপুরে নির্মলার যোগাযোগে দু’জন ভদ্রলোক এলেন বাড়ীতে। কথাবার্তা হলো বেশ কিছুক্ষণ। একটা লম্বা ফর্ম দিলেন সেটা ফিল আপ করে ও দুটি পোষ্টকার্ড সাইজের ফটো জোগাড় করে রাখতে বললেন।
- এই ফর্মে আপনার হয়ে কে সই করবে? উইটনেস হিসাবে দু’জন কে সম্মতি জানিয়ে সই করবেন এই ভাবে। পরে তো সব দায়িত্ব তাদেরই।
- আমার ছেলে বৌ সই করবে, তাদের মত আছে।
- তাঁদের ডাকুন, সামনা সামনি কথা বলবো আমরা।
- নির্মলার ছেলে ও বৌ এসে দাঁড়ালো তাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা সন্তুষ্ট হলেন। বললেন ঠিক আছে যথা সময় আপনি খবর পাবেন।
রমার আশ্চর্য
সব কথাই আড়াল থেকে কানে আসছিল রমার, ভদ্রলোকেরা চলে যাবার পর দৌড়ে এলেন তিনি- এ কি সর্বনেশে কথা ছোটো! তুই যে ধর্ম, কর্ম সর্বনাশ করে ছাড়বি রে! এ কি অনাসৃষ্টি কথা! মৃত্যর পর তুই দাহকার্য করাবি না! তিনি এক নাগাড়ে বলে যেতে লাগলেন- কাদের কাদের যেন কি কি দান করে যাবি শুনলাম!
- হ্যাঁ বড়দি ঠিকই শুনেছো মরণেরন পর এই দেহটা তো পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, তাতে কার কি লাভ!
- মানে?
- দেখ তার চেয়ে কিছু লেকের উপকারে যদি লাগতে পারি ভেবে দেখেছো?
- আমি তোর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছি না ছোট!
দেহদানের গুরুত্ব
এসো একটু শান্ত হয়ে বোসো। সকালে জিজ্ঞাসা করছিলে না পাখীদের আমি কি শিখিয়েছি? শিখিয়েছি ‘শেষ উপহার’, ‘মরণের পর উপহার নাও’। সবাইকে আমার উপহার, আমার শেষ উপহার নাও। বুঝলে?
- ওরে ছোট কি সব বললি, আমি বিন্দু বিসর্গ বুঝতে পারলাম না।
- বুঝিয়ে দিচ্ছি বড়দি মৃত্যুর পর আমাকে চারজন কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে দাহ করে দেবে। সব ছাই হয়ে যাবে। এক মুঠো ছাই!
- বদলে কারুকে আমার লিভার, কারুকে কিডনি। কারুকে হৃদপিন্ড কারুকে ফুসফুস, কারুকে অস্থিমজ্জা, কারুকে চোখের কর্নিয়া এই সব অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যায় কেমন হয়!
- কেন এমন করা ছোট?
- দেখ বড়দি একটু বোঝার চেষ্টা কর এ গুলির অভাবে কত লোক মৃত্যুমুখে পড়ে আছে। এগুলি পেলে তাদের প্রাণ বাঁচবে। এতোটা বুঝলে?
- খানিকটা।
- আরও কাজ হবে বড়দি একটি মৃত শরীর দিয়ে।
- ওরে বাবা আরও কাজ? কি কি শুনি?
- বড়দি কত মেডিক্যাল স্টুডেন্ডরা একটি শব দেহের জন্য বসে থাকে জানো?
- কেন রে?
- ডাক্তারি ছাত্ররা শব-ব্যবচ্ছেদ না করতে পারলে তাদের শিক্ষা অসম্পুর্ন থেকে যায় ডঃ ডিগ্রিই পাবেনা তারা। তাদের জন্য খুব দরকার একটি মরদেহ। তাদের কাজে লাগাটাও একটি পুন্যের কাজ।
- হ্যাঁরে, তোর কি আত্মার প্রতি কোন সম্মান নেই? আস্থা নেই, বিশ্বাস নেই? আত্মা যে অতৃপ্তি তে কেঁদে কেঁদে মরবে!
- না বড়দি আমারই আত্মা পরিপূর্ণ সফল হবে সকলের কাজে লেগে।
রমার অন্তর্দৃষ্টি
হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন রমা মাথাটা তাঁর ঘুরছে। চিরদিনের ধ্যান ধারণা যে সব ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে! স্বামীর মৃত্যুর পর বৈধব্য জীবন কাটছিলো, যেমন তেমন করে পুজো পাঠ জপ তপ নিয়ে কিন্তু কিছুদিন যেন চোখের দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছিলো, সেই চোখে একটু যেন আলোর রেখা দেখলেন। তবে কি তাঁরও কোন উপায় হবে?
জিজ্ঞাসা করলেন- এ সব কি করে তুই জানতে পারলি?
ঐ যে দেখলে দুপুরে কথাবার্তা বললেন একট ফর্ম দিলেন। ওটা একটা ঘোষণা পত্র বা প্রতিজ্ঞাপত্র। ঐ তে বিল্টু, বৌমাকে সই করতে হবে।
- ও বাবা এতো কান্ড। তারপর?
- দেখো বড়দি সব অঙ্গ! যেমন জীবিত অবস্থায় চামড়া, অস্থিমজ্জা, বা দুই কিডনির একটা দান করা যায কিন্তুহৃদপিণ্ড বা ফুসফুসের ক্ষেত্রে তা করা যায় না। তা করা হয় মরদেহ থেকে, পরে সময়ের মধ্যে প্রতিস্থাপন করতে হয়।
- বাবা এতো কিছু জ্ঞান তুই লাভ করেছিস। মানে দেহদান তুই করবিই?
- দৃঢ়স্বরে নির্মলা বলে, হ্যাঁ বড়দি এই মতাদর্শ থেকে কেউ আমায় টলাতে পারবে না।
- তারপর শেষ কাজটা কিভাবে হবে? দেখ আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।
- এইবার ঐ ফিল আপ ফরমে বাড়ীর লোক সই করে দেবে। রাজী আছে বলে।
সংস্থার স্বাগত
একদিন সেই সংস্থায় নির্মলার ডাক পড়লো পৌঁছে দেখলো সেখানে এক উৎসবের আবহাওয়া যেন এক আনন্দ আবেশ। প্রধান অতিথি হিসেবে এক রাজ্যমন্ত্রী এসেছেন তিনি বডি ডোনেটের উপকারিতা বিষয়ে এক মর্মগ্রাহী ভাষণ দিলেন। আরও দুজন ও তাকে স্টেজে ডেকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের গলায় বড় বড় মালা পরিয়ে দিলেন।
সংস্থার পক্ষ থেকে বিরাট বাঁধানো রঙিন সার্টিফিকেট দিয়ে বলা হলো বাড়ীর এমন জায়গায় এটি টাঙিয়ে রাখতে যাতে সর্বদা সবার নজর পরে। আর ঐ অঙ্গীকার পত্রের একটি ছোট সার্টিফিকেট দিয়ে বলা হলো যেন সব সময় এটি তার পার্সে রাখা থাকে।
রমার সন্তোষ
ফিরে আসার পর রমা বললেন- তোর বাহাদুরিকে শত শত গড় করিরে ছোট। আচ্ছা এবার বল, কিভাবে কেমন করে বলি ছোট দেখ আমার গায়ে আবার কাঁটা ফুটে উঠেছে সেই কাজটা কিভাবে হবে?
নির্মলা খুব শান্তভাবে বললো, বড়দি মৃত্যুর পর তো অঙ্গীকার রক্ষার ভার তাদের। যারা ওতে সই করেছে। তারা নিশ্চয় শ্রদ্ধাপূর্বক পরবর্তী কাজে অগ্রসর হবে!
- কেন ছোটো সই করেও পিছিয়ে যাওয়া যায়?
- হ্যাঁ। কারণ এখনো কোনো আইন পাসন হয় নি এ বিষয়ে। না হলে তো সই সাবুদের দরকারই হতো না। বলতে বলতে নির্মলার মুখ শক্ত, কঠিন হয়ে গেল এই জন্যই প্রয়োজম সব সময় সবাইকে এই ব্যাপার নিয়ে সচেতন করা, আলাপ আলোচনা করা তাদের বোঝানোর দায়িত্ব নেওয়ার।
- আচ্ছা এবারে বল পরের কি করা!
- সই যারা করেছে মৃতদেহের সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজে এনাটমী বিভাগে ওয়ার্ড বয়ের সঙ্গে সার্টিফিকেট সহ যোগাযোগ করা। তারপর ডাক্তারের দায়িত্ব।
- আর রাতে যদি কান্ডটা ঘটে?
- তাহলে সেই সংস্থায় তক্ষনি খবর দেওয়া। তারা সকাল হলেই নিয়ে যাবে।
- তা শবদেহ ঠিক থাকে? পচে গলে যায় না?
- না গো বড়দি মর্গে থাকে দেহ ফর্মালিন ভ্যাটে ফর্মালিন ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়। সংরক্ষিত শবদেহ বছর দেড়েকে ব্যবচ্ছেদ করা যায়।
- রমার হাঁ করা মুখের দিকে তাকিয়ে নির্মলা বললো- সব কথা বুঝলে?
- রমা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন- তা হলে আমারও দেহদানের ব্যবস্থা কর। আমিও এভাবে পুন্যঅর্জন করবো।
- নির্মলাও একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলো এতো বড়ো সফলতা!