শক্তি ও চিন্তার সম্পর্ক: রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতার পেছনের গল্প
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ও রাজনৈতিক প্রভাব
শক্তি ও চিন্তার সম্পর্ক
চিন্তার সাথে শক্তির সম্পর্ক হলো সরাসরি স্বার্থের সম্পর্ক। চিন্তা নির্ধারণ করে দেয় রাষ্ট্রে শক্তি কীভাবে প্রয়োগ হবে। কোন ধরণের চিন্তা? যে চিন্তা ঐ শক্তি বা পাওয়ার-হাউজের স্বার্থ পূরণ করতে সক্ষম। আমরা প্রায় প্রায় ভুলে যাই কোনো শক্তি/পাওয়ার-হাউজ কিন্তু দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। ওর নিজস্ব মেশিনারি আছে, ওর নিজস্ব চিন্তকও আছে, ওর নিজস্ব তহবিলও আছে, ওর নিজস্ব ভিশন/স্বপ্নও আছে। সব ধরণের শক্তির প্রাইম বা মূখ্য উদ্দেশ্য হলো ‘ক্ষমতা’। কি বা কোন ধরণের ক্ষমতা? রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা দিয়ে কি হবে? উত্তর হলো, টাকা। প্রতিটি পাওয়ার হাউজের দ্বিতীয় মূখ্য উদ্দেশ্য হলো, তার মৌলিক আদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা। কেন এসব আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হবে? উত্তর হলো, বারবার ক্ষমতায় থাকা এবং আরো টাকা উপার্জন করা। আরো অনেক গৌণ উদ্দেশ্য বড় বড় পাওয়ার-হাউজের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। আবার প্রতিটি পাওয়ার-হাউজের নির্দিষ্ট কিছু চরিত্র থাকে। নির্দিষ্ট কিছু মুখ থাকে। খুব সম্ভবত ঐ সব মুখ সবার সামনে দেওয়া হয় যিনি বা যারা জনগণের কাছে অপেক্ষাকৃত অধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়।
শক্তির পতন ও নতুন শক্তির উত্থান
আমি এঁদেরকে আদর করে বলে থাকি ‘ক্লাউন’। তাই রাষ্ট্রে যখন একটি বড় শক্তির পতন ঘটে তখন অন্যান্য শক্তিগুলো স্বভাবতই জেগে উঠবে। কারণ আপনি যদি শয়তানের সাথে লড়তে যান তাকে পতনের ক্ষেত্রে আরো এক বা একাধিক শয়তানি শক্তিকে কাজে লাগাতে হতে পারে।
হিজাব ও বোরখা নিষিদ্ধকরণ
কিছুদিন আগে আমি একটি সাধারণ প্রশ্ন কয়েকজন পরিচিত মানুষকে জিজ্ঞেস করি: আচ্ছা, হিজাব ও বোরখা নিষিদ্ধ করা হলে কার বেশি ক্ষতি হবে? জনৈক: ইসলামের অনেক ক্ষতি হবে।
নাহ্, ইসলামে পর্দার জন্য তো আরো অনেক পোশাক মিলে যাবে। কিন্তু যেসমস্ত ব্যবসায়ী রঙের ও ঢঙের হিজাব ও বোরখা ইতিমধ্যেই তৈরি করে রেখেছেন তাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে। ব্যবসায়ীদের ধর্মে এত আগ্রহ কেন? মসজিদে এত এত দান করেন কেন? কোনো মুফতি বা মাওলানা কে ওয়াজ মাহফিলের দাওয়াতে মুসলিম সমাজ আগে তো নিজেরাই চাঁদা তুলে চালিয়ে নিত। কিন্তু এখন একক বা একাধিক ব্যবসায়ী যুক্ত থাকেন কেন? এই সমস্ত কারণ হচ্ছে একশ্রেণির ব্যবসায়ী সমাজ। তারা চান ঈমাম থেকে মাওলানা ও মুফতি তাদের কথামতো চলুক। এতে ব্যবসা থাকবে চাঙ্গা, দেমাগ থাকবে ঠান্ডা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বাংলাদেশের ঋণ
বাংলাদেশ যখন প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার ঋণে জর্জরিত তখন আমরা ঠিকই ড. মুহাম্মদ ইউনূস কে পা ধরে ডেকে আনতেও কুন্ঠা বোধ করবো না। কারণ স্বভাবতই তাঁকে ডাক দিলে যুক্তরাষ্ট্র, আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক সহ একাধিক উন্নত দেশ ঋণ নিয়ে এগিয়ে আসবেন। এখানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চেয়ে ড্যাবল স্ট্যান্ডার্ড মন-মানসিকতা তো আমাদের!
আমরা যে মানুষকে এত এত অপমানিত করেছি তারপরেও এতবড় ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে একটি দেশ পরিচালনায় হাত দেবেন সেটা বোধহয় অনেকের চিন্তাতেই ছিলো না। ড. মুহাম্মদ ইউনূস কে নেতৃত্বে বসানোরও আগে যুক্তরাষ্ট্র এবং আইএমএফ তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার কথা বলেন; যা অতি স্বাভাবিক ছিলো। আর যা স্বাভাবিক নয় বা আমাদের চিন্তাতে এখনো এসেও চলে যাচ্ছে, সেটা হলো, ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিন্তু এখন স্রেফ একজন ব্যক্তি নন, তিনি অটোমেটিক একটি পাওয়ার হাউজের অংশ হয়ে গেছেন।
বাঙালীদের প্রত্যাশা
বাঙালীদের প্রত্যাশা/বাংলাদেশীদের প্রত্যাশা অসীম। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন মানুষ; মসীহ নন। আমরা এটাও প্রায় প্রায় ভুলে যাই, নেতৃত্বে ফেরেশতা বসলে ভালো হত; যা অসম্ভব। তাছাড়াও একটি অসভ্য জাতিকে শাসনের জন্য ফেরেশতা নয়, শয়তান দরকার। আমি আমার একটি ফেসবুক পোস্টে বলার চেষ্টা করেছি, “একটি অসভ্য ও বর্বর জাতিকে শাসনের জন্য শয়তানের প্রয়োজন হতে পারে কিন্তু ইবলিশ শয়তায় সবসময় বেশি ছিলো।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন পর্যন্ত তিনি সরাসরি এমন কোনো স্টেপ নেন নাই (জ্ঞানত) যা পুরোপুরি অযৌক্তিক। এই বয়সে তিনি যে পরিমাণ কাজের ভার নিয়েছেন সেটা যদি একটু ব্যবচ্ছেদ করেন তাহলে আমাদের মত যুবকদেরও ঈর্ষাবোধ হতে পারে। খুব সম্ভবত বাংলাদেশ এর পূর্বে অন্তত এত বিনয়ী একজন মানুষকে শাসক হিসেবে দ্যাখেন নাই।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার
একটু পেছনে ফিরে যাচ্ছি… আমার দৃষ্টিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে ‘ইবলিশ শয়তান’ বলা ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। কলামিস্ট পর্যন্ত হারিয়ে ফেলা এই দল বা পাওয়ার-হাউজ সুচিন্তক দিয়ে সুবিন্যস্ত ছিলো না। তার উপর এই দলের স্ব কর্মীদের (প্রাণপনে দল করেছেন এমন ব্যক্তিবর্গ) ছাঁটাই করা ছিলো বাহ্যিক চিন্তকদের আশীর্বাদ স্বরুপ। এখানে সমস্ত পাওয়ার-হাউজের চিন্তকদের একটি ভূমিকা ছিলো আর তা-হলো, ‘Connecting the dots!’
ইবলিশ শয়তানের পতন
সবগুলো ডট্ মিলে গেল একসময় এবং এই ইবলিশ শয়তানের পতন ঘটলো। পতনের পরপরই সমস্ত বাহ্যিক চিন্তক তাদের ধ্যান-জ্ঞান একে-অন্যের থেকে আলাদা হওয়ায় যে যার মত তার অবস্থানে ফিরে যাওয়াটাই ছিলো খুব স্বাভাবিক। কারণ তারা যেসমস্ত পাওয়ার-হাউজকে কাজে লাগিয়েছেন সেসমস্ত পাওয়ার-হাউজের হাতেও আছে রক্ত মানে এরাও ছোটোখাটো শয়তান। অথবা, বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদটি হলো শয়তান তৈরির কারখানা।
চিন্তকদের ভূমিকা
কিন্তু ওয়াদা সাপেক্ষে এই সমস্ত চিন্তদকদেরকে কিছু মাশুল নিশ্চয় গুণতে হয়েছে এবং আগামীতেও গুণতে হতে পারে। এই বিষয়টি এতগুলো চিন্তক ‘গ্রেটার গুড (Greater Good)’ দর্শনের আলোকে হয়তো ভাবছেন। প্রথম ক্ষমতা ছাত্রদের হাতে দিয়ে এই চিন্তকদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন বলে মনে হয়। এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর প্রধান শক্তি (পাওয়ার-হাউজ) এই ছাত্ররা পালন করছেন; যা প্রকাশিত ও প্রাসঙ্গিক।
শাসনের সমস্যা
কিন্তু শাসনের সমস্যা হচ্ছে, শাসন করার ক্ষমতা যতই খারাপ হোক না কেন তা প্রকাশের প্রবল ক্ষমতা থাকা জরুরী। একই সাথে শাসনের সমস্যা হচ্ছে, শাসন কর্তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে থাকা। কিন্তু আমরা দেখি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে পূর্বপরিকল্পিত বেশ কিছু উপদেষ্টা (বা এনজিও সরকার) যাঁদের কে নিয়ে এই চিন্তকদের পরিকল্পনা স্পষ্ট ছিলো বলে আজ পর্যন্ত মনে হয় নাই। এজন্য এখানে কিছু মহল থেকে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে তবুও বেশ দেরিতে।
ভবিষ্যতের ওয়াদা
এই ওয়াদা কি এই পর্যন্তই? খুব সম্ভবত নয়। এর পরের ধাপের ওয়াদা পূরণ করতে গিয়ে একাধিক বিরোধীদলগুলোর উপর ঘটে চলা অন্যায়ের সুবিচার করা বা বেকসুর খালাস দেওয়া। মুক্ত গণমাধ্যম সহ মানুষের মুক্তির স্বাদ দেওয়া; যার কিছু অংশ দৃশ্যমান। একইসাথে এই চিন্তকদের সাথে আমরা যারা রাষ্ট্র-সংস্কার চিন্তায় দিনানিপাত করছি তাও কিছুটা দৃশ্যমান; সংবিধানে সংস্কার ও গণতন্ত্রে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন।
চিন্তকদের দর্শন ও দলীয় স্বার্থ
কিন্তু চিন্তকদের দর্শন ও দলীয় স্বার্থের সংঘাতে চুপ থাকাই হয়তো বেশি ভালো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। কারণ আমাদের শাসন করার জন্য উপর আল্লাহ্ তো ফেরেশতা পাঠাবেন না। না আমরা ভোট দিয়ে ভালো ভালো মানুষকে ক্ষমতার মসনদে বসাতে পারি (পূর্বের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটগ্রহণের পরিস্থিতি বিবেচনায়)।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাদেরকে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরায় ফিরিয়ে দেবার আশ্বাস বারবার দিয়ে চলেছেন। কিন্তু তার উপদেষ্টা মহলে দৃশ্যমান দুর্দশা (পূর্বের ইবলিশ শয়তানের দোসর) ও বৈষম্য (ছাত্র-উপদেষ্টায় বৈষম্য) নিয়ে তিনি কি সেটা করতে পারবেন? এখানে চিন্তকদের পাওয়ার-হাউজ নিয়ে বিবেচনা কি? আমার কাছে তো স্পষ্ট নয়। কিন্তু আশা রাখা ছাড়া আর তো কিছুই আমরা করতে পারি না।
ইলিশ মাছ ও রাজনৈতিক প্রভাব
সর্বশেষ ইলিশ মাছ তো খেতেই পেলাম না। যেহেতু ইলিশ মাছ এখন একটি রাজনৈতিক মাছ সেহেতু এই মাছের দাম কমে বা বেশিতেও জাতীয় রাজনৈতিক প্রভাব কিছুটা হলেও বুঝা যায়। তারপরেও একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের বুঝার কথা যে, আমাদের মত জাতির জন্য শাসনকর্তা হিসেবে শয়তানকে দরকার। এবং পাশাপাশি মানছি, ইবলিশ শয়তান সবসময় সব জাতির জন্যই খারাপ ছিলো।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.