ছোটগল্প

হৃদয়হীনার হৃদয়স্পর্শী প্রেম

একটি ইন্টার্নশিপ, কিছু ভুল বোঝাবুঝি এবং সম্পর্কের নতুন অধ্যায়

রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আছি। সন্ধ্যা ৬টা বেজে ৫ মিনিট। শহরের ল্যাম্পপোস্ট গুলো একটা একটা করে জীবন্ত হতে শুরু করেছে। এই শহরের ভেতরে শুধু অটো আর প্রাইভেট কার বেশি দেখতে পাওয়া যায়। কখনো কখনো দুই একটি বাস গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। কিছুটা ব্যস্ত; সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা হতে পারে, আমারও। হাতে স্মার্টফোন, একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করছি।

অপেক্ষা করা বড়ই কঠিন কাজ। কিন্তু মন বলছে আর মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে ও আসবে। আমার চোখ এখনো স্মার্টফোন স্ক্রিনের কি-বোর্ডের দিকে, একটি কবিতা লিখছি। কবিতার নাম ‘শূন্য’।

সুজয়া হঠাৎ পেছন থেকে বললো: মাহির, চলো, যাই?

আমি শান্তভাবে বললাম: আমি একটা অটো খুঁজি।

সুজয়া একটু মাথা নাড়ালো। আমাদের দেখে অটোগুলো কেমন জানি একটার পর একটা কাছে এসে দাঁড়াচ্ছিল। কিন্তু পেছনের দু’সিট ফাঁকা নাই তাই বিরুক্ত হয়ে একজনকে বললাম, “মামা, পেছনের সিট আমাদের ফাঁকা চাই! কিছু বুঝেছেন?”

অটোওয়ালা কি বুঝলো জানিনা কিন্তু মুচকি হেসে চলে গেলেন। এরপর আমরা এক অটো পেলাম, পুরো অটোতে কোনো যাত্রী নাই।

আমি: সুজয়া?

অটোতে উঠে পড়েছে সে, বললো, “হ্যাঁ, কিছু বলবে?”

আমি: ইয়ে মানে… না…

সুজয়া: কাউকে না জানিয়ে এভাবে সবার আগে চলে আসলে যে? তোমার কি কোন সমস্যা হয়েছে? আমি: কই না তো! আমার আসলে টিউশনি আছে।

সুজয়া: ওহ হো! আমারও আজ কাজ পড়ে গেছে। তাই চলে আসলাম।

কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি সুজয়ার কোনো কাজ আপাতত হাতে নাই। আমার সাথে একসাথে যাওয়া টা-ই ওর মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এত সুন্দরী মেয়ে আমাকে কোনোভাবে পছন্দ করে না তো! নাকি ওর কোন বিশেষ উদ্দেশ্য আছে? তাও আবার আমাকে নিয়ে!

সুজয়া: তুমি যেভাবে ইন্টার্ণ করছো তাতে এই কোম্পানিতে তোমার চাকুরী এমনিই হয়ে যাবে।

আমি একটু অবাক হয়ে: তুমি বেশি বলছো। আসলে তোমার পারফরম্যান্স দারুণ।

সুজয়া: আমার কথা জানিনা কিন্তু তুমি এখানে থাকছো-ই! তুমি সত্যিই খুব ভালো পারফর্ম করছো!

সম্পর্কিত নিবন্ধ

একে-তো এই কোম্পানিতে কাজ করবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নাই। আমি তো এখানে এসেছি আমার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে, জীবনবৃত্তান্ত তো আর শূন্য রাখা যায় না! কিন্তু সুজয়ার জন্য মনে অদ্ভুত সব চিন্তা আসছে। আমরা স্রেফ এখানে মাত্র এক মাসের ইন্টার্ণ করতে এসেছি, এর বেশি বা কম কিছুই নয়।

ওর বাসা এই কোম্পানির প্বার্শে এক আবাসিক এলাকায়। তাই আগেই নেমে গেল।

আমি: ভাড়াটা আমি দেই?

সুজয়া: না, না, আমার কাছে খুচরো আছে… বাই…

আমি: হুম, বাই…

কি অদ্ভুত রকমের মেয়ে! ৭ টাকা খুচরো কারো কাছে প্রতিদিন থাকে? কি জানি! তাতে আমার কি!

পরের দিন…

সেদিন বেহায়ার মত সুজয়া কে কানে কানে বলেছিলাম, “হিজাবে তোমাকে একদম মানাচ্ছে না!” কিন্তু আজ যে ড্রেসে এসেছে এতে করে চার্লস ডিকেন্সের ‘গ্রেট এক্সপেকটেশানস (Great Expectations)’ উপন্যাসের নায়িকার মতন লাগছে। আবার ওরকম হৃদয়হীনা নয় তো আবার? উঁহু! এই মেয়েটা আমার মাথা খাচ্ছে।

নিজেকে সামলাতে না পেরে আমি সুজয়ার পাশে গিয়ে বললাম, “এখনো ক্লাস শুরু হয় নাই, আমি কি তোমার সাথে একটা সেল্ফি তুলতে পারি?”

সুজয়া মিষ্টি করে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ!”

ওমা! এ তো কারো সাথে কথা বলে না অথচ, আমার ভাঙ্গা ফোনে সেল্ফি তুলতে আপত্তি নাই! নিজের সিটে বসে আমাদের দুজনের ছবিটা আমি বারবার দেখছিলাম আর সময় সুযোগ পেলে লুকিয়ে লুকিয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছি, সুজয়া মোটেই বিরুক্ত হচ্ছে না।

একটুবাদে সকালের ‘টি-ব্রেক’। সবাই যে যার মত করে চা নিয়ে একে অন্যের সাথে গল্প করছে। কিন্তু এখানে সবাই আমার অপরিচিত, সুজয়া ছাড়া। এছাড়াও আমি একা থাকতে পছন্দ করি। পাশে এক সুন্দরী মেয়েকে দেখলাম। ওর নাম মনীষা। আমি আমার চোখে এত সুন্দরী মেয়ে জীবনে দেখি নাই। ছেলেরা মনীষা কে ভয়ানক বিরুক্ত করছিলো। এক পর্যায়ে মনীষা আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।

মনীষা: তুমি একা কেন?

আমি: আমার একা থাকতেই ভালো লাগে।

মনীষা: একটা কথা বলার ছিলো।

আমি: বলো?

মনীষা: আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

আমি: ওয়াও! ছেলে কি করে?

মনীষা: ইঞ্জিনিয়ার… কিন্তু আমার পরিবারের চাপে বিয়েটা করতে হচ্ছে, ছেলেটাকে আমার পছন্দ নয়।

আমি: তাহলে বিয়েটা করো না। বাড়িতে ভালো করে জানিয়ে দাও।

মনীষা: কিন্তু কি এক্সকিউজ দেবো! আমার তো কোন বয়ফ্রেন্ড নেই!

আমি: বলো, তুমি ছেলেটাকে পছন্দ করো না।

মনীষার সাজগোজ, ভ্যানিটি ব্যাগ, হাতের ঘড়ি এবং স্মার্টফোন সবই দামী। এই মেয়ে সাধারণ পরিবারের কেউ হতেই পারে না। তার উপর এই উপচে পড়া সৌন্দর্য। উপর আল্লাহ্ শুধু একে বুদ্ধিটা দেন নি, বাকিসব ঠিকই আছে। আর এই বয়ফ্রেন্ডের ইঙ্গিত কেমন জানি আমার দিকে ছুঁড়ছে। এমনিতেও মেয়ে নিয়ে আমার জীবনে খুব ভালো ঘটনা নাই, আরো কিছু বাজে স্মৃতি তৈরি করতে চাই না। আর ওর সাথে এর আগে আমার মাত্র একবার কথা হয়েছে।

হঠাৎ পেছন থেকে সুজয়া উপস্থিত। আমি দেখতেই কেন জানি ঘাবড়ে গেলাম। সুজয়া কে বললাম, “উনার নাম মনীষা, আমার বড় আপু। আর মনীষা! আপনি তো সুজয়াকে চেনেন তাই না?” মনীষা এসবে কান না দিয়ে বললো, “আমি আগামীকাল ঢাকায় যাচ্ছি, একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনবো…” মনীষা সুজয়াকে পাত্তা না দিয়ে এসব বলে চলে গেল। যেন ঈর্ষায় মরছিলো। কিন্তু কীসের জন্য এই ঈর্ষা?

সুজয়ার দিকে তাকাতে দেখলাম ওর হাতে চা নাই। বললাম, “চা পছন্দ করো না?”

সুজয়া: করি…

আমি: আচ্ছা, আমি এখুনি তোমার জন্য এক কাপ চা আনছি, আর এখানেই থেকো…

সুজয়া একটু জোরে বললো: চায়ে চিনি দু’চামচ…

চা হাতে করে আনছিলাম, চিনি দু’চামচ। কিন্তু দু’চামচ-ই বা কেন? ফ্রি-তে ফ্রি-তে চা মিলছে সুতরাং স্বাদ যেমনই হোক সেটাই গিলতে হবে। এই মেয়ে কি শুধুই আমার মাথা খাবার জন্য জন্মেছে!

সুজয়া: ধন্যবাদ মাহির… তোমার ডেট অব বার্থ কত?

আমি: মানে…?

সুজয়া: আমার ডেট অব বার্থ হচ্ছে ১৯৯৪… আমি তোমার কতটুকু বড় হবো? তোমার ডেট অব বার্থ কত?

আমি: ও…! আমাদের বয়স তো প্রায় কাছাকাছি, আমরা সমবয়সী হবো।

সুজয়া: বলো না?

আমি: ১৯৯৫! মানে সার্টিফিকেট, কিন্তু ঐ ১৯৯৪ এর কাছেই হবে।

সুজয়া: তোমার সিভিতে ১৯৯৬ লেখা ছিলো। ঠিকাছে, আমি তোমার চেয়ে এক বছরের বড় হবো। এতে সমস্যা নাই!

আমি: এহেম… এহেম… কিন্তু ডেট অব বার্থ দিয়ে কি হবে?

সুজয়া: কোথায় পড়াশোনা করেছো?

আমি: এই শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন স্নাতক প্রায় শেষ।

সুজয়া: আমার তো আর ৩ মাস পর মাস্টার্স শেষ হবে। যাকগে, কোন হলে থাকো?

আমি: বঙ্গবন্ধু

সুজয়া: তুমি হলেই থাকো?

আমি: না আমি হলে কমফোর্টেবল বোধ করি না। তাছাড়া আমি একটু ইন্ট্রুভার্ট প্রকৃতির। মেসে থাকি…

ইন্টার্ণশীপের শেষদিন

আমাকে মনীষা খুব বিরুক্ত করছে। কিন্তু এত সুন্দরী মেয়ে যখন বিরুক্ত করে তখন ব্যাপারটা বিরুক্তির না হয়ে রোমান্টিক হয়ে যায়। ফেসবুক গ্রুপে মনীষা আমাদের সেল্ফিও তুলে দিয়েছে। আমাদের এই ইন্টার্ণ গ্রুপের সবাই এখন জানে আমার আর মনীষার মধ্যে কিছু তো চলছে।

অন্যদিকে সুজয়া আমার সাথে আগের মত আর মিশছে না। কি ভুল করে ফেললাম আবার? পাশেই বসে আছে, মনোযোগ দিয়ে স্যারের লেকচার শুনছে। কর্পোরেট দুনিয়ায় এরকমই হয়। কে? কখন? কেন? সেল্ফি তুলেছে সেটা নিয়ে এত রাগ! এত অভিমান! কিন্তু আমার তাতে কি? আমি ও কে নিতে এত ভাবি কেন? আজ যাবার সময় কাউকে কিছু না বলে চলে যাবো। তাহলে সকল কিচ্ছা এখানেই খতম হয়ে যাবে।

ক্লাস শেষে সবাই হোলি উৎসবে মেতে উঠলো। আমার আর সুজয়ার গালে এক বড় আপু রঙ লাগিয়ে দিলো, আমাদের দুজনকে দারুণ লাগছিলো। তিনি আমাদের সাথে একটা সেল্ফিও তুললেন আর বললেন, “তোমাদের দুজনকে বেশ মানিয়েছে।”

আচ্ছা, হয়তো এখানের সবাই পাগল নতুবা আমি একাই পাগল হবো। কোন মেয়ের বয়ফ্রেন্ড নাই, কেউ আবার আমার ছবি আঁকাচ্ছে, কেউ আমার সাথে আবার একান্তে সেল্ফি তুলছে। এখন কো-অপারেট করা ছাড়া বড় ভাই মানে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক আমার উপর একটু তো রাগ করবেন।

হঠাৎ ফ্লোরে এক স্মার্টফোন কেউ ছুঁড়ে মারলো, তাকিয়ে দেখলাম ওটা সুজয়া। খুব রেগে আছে। রাগে জোরেশোরে বললো, “আমি সবার সাথে সেল্ফি তুলি না।” পাশের ছেলেটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কয়েকদিন এই ছেলেটি সুজয়ার পেছনে ঘুরছে, বিয়ের প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়েছে। সুজয়া শুধু কেউ ডিস্টার্ব আর বিয়ের প্রস্তাবের বিষয়টি বলেছিলো আমাকে, এখন পরিষ্কার হলাম।

তবুও, আমার সুজয়াকে একা ছাড়া উচিত। মনীষাকেও… কারণ এই অভিজাত পরিবারগুলো ভালোবাসার অর্থ জানে না। সম্পর্ক কে শ্রদ্ধা করতে জানে না। অবশ্য এরমধ্যে বড় ভাই পরিস্থিতি সামলে নিয়েছেন। এখন আমার যাওয়ার পালা।

কিন্তু যাওয়ার সময় একটা ছোট্ট পরীক্ষা হয়ে যাক। এজন্য আমি প্রথমে মনীষার কাছে গেলাম আর বললাম, “মনীষা, আমার এক্ষুনি যেতে হবে, ভালো থেকো!” মনীষা বললো, “আজ অনুষ্ঠানের দিন, সবার সাথে একটু সময় কাটাই?” আমি শান্তভাবে উত্তর দিলাম, “ওকে।”

ঠিক ঐ একই কথা সুজয়াকেও বলে বাইরে দুই মিনিট দাঁড়ালাম। ক্লাসরুম থেকে সুজয়া সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে এরমধ্যে বাইরে এসে আমাকে বললো, “আজও আমার হাতে কিছু কাজ আছে, একসাথে যাই?”

বড় ভাই আমাদের দেখে কাছে আসলেন। আর আমাকে বললেন, “সুজয়ার খাবারের প্যাকেট টা নিয়ে যাও, মাহির? ও এখনো কিছুই খায়নি।” আমি মাথা নাড়ালাম। এক দৌড়ে খাবারের রুম থেকে একটা প্যাকেট খাবার সুজয়ার জন্য নিয়ে আসলাম। সুজয়া বললো, “অনেক ধন্যবাদ, মাহির!”

আমি আর সুজয়া সিঁড়ি তে পা রাখতেই বড় ভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, “মাহির, গেটের প্বার্শে একটা বাগান আছে, ওখানে একটা গোলাপ ফুল ফুটেছে।”

মেহেদি হাসান (বিকেল)

I'm MD Mehedi Hasan, also known by my pen name Mr. Bikel. I'm the admin of the site Ovizatri - News & Magazine. I am a versatile individual with a professional life that spans various fields. I work as a writer, actor, social worker, radio jockey, web developer, web designer, editor, presenter, blood donor, audio and video editor, photo editor, YouTuber, and drama director. I am also a developer and app developer at Microsoft.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button