তিথিলার বিয়ে: বন্ধুত্বের বন্ধনে সমাজের কঠিন বাস্তবতা
নারীর সংগ্রাম ও মানসিক অবস্থা: এক বন্ধুর চোখে দেখা গল্প
তিথিলার বিয়ে। সারা বাড়ি জুড়ে শুধুই হইচই। আমি গিয়ে দেখলাম তিথিলা একটা বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। ডাক দিতেই কেমন চমকে উঠলো। আমায় দেখেই তিথিলা উঠে এসে জরিয়ে ধরেই বলতে লাগলো, “এই তোর আসার সময় হলো! বলেই কেমন কাঁদতে লাগলো।”
আসলে আমি দেরি করে এসেছি বলে সে কাঁদছে না। আমি বুঝে গেলাম আমার তিথির মন খারাপ। জিজ্ঞেস করলাম, খাবার খেয়েছিস? তিথি মাথা নাড়িয়ে, হ্যাঁ বললো। আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম, আমার ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। তিথি বললো, তুই হাত-মুখ ধুয়ে আয়, আমি খাবার দিচ্ছি।
কিছুক্ষণ পর তিথি খাবার নিয়ে আসলো। আমি তিথিকে কে কাছে বসিয়ে মুখে খাবার তুলে দিলাম। তিথি অবাক চোখে তাকিয়ে মুখে খাবার নিলো। দুই একবার খেয়েই জিজ্ঞেস করল, তুই কি করে বুঝলি আমি খাইনি? আমি একটু হেসে বললাম, “তিথিলার মন খারাপ আর সে এই মন খারাপ নিয়ে খাবার খাবে একি বিশ্বাস করার মতো বল! দীর্ঘ ৪ বছর আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। খুব বেশি না জানলেও এটুকু অন্তত জানি।”
আমি আর তিথিলা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। শুধু তাই নয়, আমরা একই রুমেই থাকতাম। সারাক্ষণ দুজনের কত মান-অভিমান চলতো তা কেবল আমরাই জানি। থেকে থেকে বাকি রুমমেটরাও বিরক্ত হয়ে যেত। কিন্তু আমরা বিরক্ত হতাম না। এটাই ছিলো আমাদের ডেইলি রুটিন। আমাদের বন্ধুত্বটায় এমন। সারাদিন যাইহোক না কেন তার রেশ বেশিক্ষণ থাকতো না।
ফাইনাল ইয়ারেই তিথির বাবা মারা যায়। তারপর আমরা গ্রাজুয়েশন শেষ করি। গ্রাজুয়েশন শেষ করে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দেবার পর আমার একটা চাকরি হয়ে যায় ব্যাংকে। তারপর আমাদের দুজনের ভিন্ন পথের যাত্রা শুরু। দীর্ঘ দুই বছর, ছয় মাস এবং নয় দিন পর তিথিলার সাথে আমার দেখা। আমার ব্যস্ততার তিথির সাথে কারণে খুব বেশি কথা বলাও হতো না।
তিথিলা আর আমি খাবার শেষ করে ওদের বাসার উপরের তলায় গেলাম। সেখানে ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে আমি ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি তিথিলা দুই মগ চা নিয়ে হাজির। সত্যি বলতে আমিও মনে মনে ‘চা’ চাচ্ছিলাম। তারপর চা খেতে খেতে আমরা বারান্দায় গিয়ে বসলাম। দুজনই বেশ কিছুক্ষণ চুপ ছিলাম। কেউ কোনো কথা বলছিলাম না।
তারপর হঠাৎ তিথিই বলতে শুরু করলো, “জানিস বাবা ছাড়া জীবন আর ছাদ বিহীন ঘর একই কথা।” তিথির চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। তারপর আবারও বলতে শুরু করলো, “সবাই মেয়েদের শুধু ভোগের সামগ্রীই মনে করে তাই না রে? মেয়েরা যেখানেই যাবে সেখানেই কোনো না কোনো ভাবে কেউ না কেউ তাদের ভোগ করতে চায়। এর বাইরে কি কিছু ভাবতে পারে না?” – বলেই তিথি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
আমি তিথির হাতটা শক্ত করে ধরলাম। তিথি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলতে শুরু করলো। জানিস এই দুই বছরে চারপাশের মানুষগুলোকে একদম কাছে থেকে বদলে যেতে দেখেছি। ঠিক বদলে যাওয়া নয়। কারণ বদলে যাওয়া বললে ভুল হবে। এই মানুষগুলোর আসল রূপটা দেখেছি। যারা এতোদিন ভদ্রলোক এবং দায়িত্ব পালনকারী মহান ব্যক্তির মুখোশ পরে ছিলো।
তিথির হাতের উপর হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম, তিথি কি হয়েছে? তিথি আবারও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, আমায় ধর্ষণ করা হয়েছে। তিথির কথায় আমার শরীরের সব লোমগুলো শিউরে উঠলো। অনায়াসে চোখ থেকে জল পড়তে শুরু করলো। আমি নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
তিথি বলতে শুরু করলো। আমার জন্য দুলাভাই ছেলে দেখেছে। তারা আমায় দেখতে চায় বলে বড় আপু আম্মু আর আমাকে ডেকে পাঠায়। এদিকে নানু অসুস্থ হওয়ায় আম্মু হঠাৎ ই নানু বাসায় চলে যায়। ফলে আমি একাই গিয়েছিলাম। ছেলের কি সমস্যা থাকায় তারা আর আসেনি।
আমি রাতে রিফাতের সাথে শুয়ে পড়লাম। রিফাত আপুদের একমাত্র সন্তান। এবার ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছে। রাতে রিফাতের প্রচন্ড জ্বর আসায় আপু রিফাতকে তাদের রুমেই নিয়ে গেলো। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ রাতে চমকে উঠি। তাকিয়ে দেখি দুলাভাই। চিৎকার করার আগেই মুখ আটকে দিলেন।
আমি তিথিকে জরিয়ে ধরলাম। ও আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়লো। আমি জিজ্ঞেস করলাম বাসায় বলিস নি? তিথি বললো, হুম। কিন্তু তারা বললো আমারই দোষ। আমি কেন দরজা লক করে শুইনি। আর ছেলে মানুষরা নাকি এমন একটু আধটু হয়।
এসব বাইরে বললে মান সম্মান থাকবে না। আর তাছাড়া এসব কথা মানুষ জানলে আমার বিয়েও দিতে পারবে না। সারাজীবন আমায় কে রাখবে। এসব বলেই চুপ করিয়ে রেখেছে। আর দুলাভাই হলেন দয়ার সাগর। এতো কিছুর পরও তিনিই আমার বিয়ের সব কিছু করছেন। তাই মা তার কথাতেই উঠেন এবং বসেন।
আমি চুপচাপ তিথির কথাগুলো শুনছিলাম। ঠিক কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। শুধু বললাম, তাই বলে এতো বড় অপরাধের কোনো ব্যবস্থায় নেবে না কেউ! অন্যরা না নিক, তুই তো নিতে পারতি! তিথি বললো মধ্যবিত্ত পরিবারের নাকি মান সম্মানটায় নাকি একমাত্র অবলম্বন। এটা ছাড়া নাকি আমাদের আর কোনো কিছুই নেই।
তিথির কথা শুনতে শুনতে কখন যে রাত গড়িয়ে এলো বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ ই আন্টির ডাকে চমকে উঠলাম। আন্টি বললো বৃষ্টি তোমার বাসার সবাই কেমন আছে? বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততায় একটু খোঁজ খবর নিতে পারিনি। আমি বললাম, আন্টি সমস্যা নেই। আমার কোনো সমস্যা হয় নি। আর বাসার সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। আন্টি হেসে বলল, চলো রাতের খাবার খেতে হবে। নিচে নেমে এসে আমি আর তিথি খাবার খেয়ে নিলাম।
রাতে তিথিকে ঘুম পারিয়ে দিয়ে আমি চুপচাপ ওর পাশে শুয়ে থাকলাম। তিথির এতো সুন্দর চেহারাটা কেমন যেন মলিন হয়ে গেছে। সবসময় চোখে মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ। আমার কোনো ভাবে ঘুম আসছিলো না। তিথির সেই কথাগুলো বারবার কানে বাজছে,
“সবাই মেয়েদের শুধু ভোগের সামগ্রীই মনে করে তাই না রে? মেয়েরা যেখানেই যাবে সেখানেই কোনো না কোনো ভাবে কেউ না কেউ তাদের ভোগ করতে চায়। এর বাইরে কি কিছু ভাবতে পারে না?”
আসলেই তো তাই। যেখানেই যাবে সেখানেই একটা নেগেটিভ অফার রেডিই থাকে। সেটা কর্মস্থলে বা বন্ধুবান্ধব মহলে অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় সবখানেই কোনো না কোনো ভাবে এমন একটা নেগেটিভ অফার থাকেই। এমনকি পরিবারেও। তারা পরিবারেও নিরাপদ নয়।
সকালে সবার হৈচৈ শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। সবাই তিথির গায়ে হলুদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আমিও উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলাম। তারপর তিথিকে মেহেদী দেয়া থেকে শুরু করে সন্ধ্যায় সাজানো পর্যন্ত সব কাজ আমিই করলাম। তিথির মুখে কোনো হাসি নেই। মনে হলো একটা প্রাণহীন শরীর সবার সামনে ঘুরাফেরা করছে। তিথিকে রেডি করে ওর পাশে গিয়ে বসলাম।
ওর হাতটা ধরে বললাম, তিথি আসলে মানুষ জীবন বলতে যা বোঝে জীবন তার ঠিক উল্টো। অনেকটাই সাপলুডু খেলার মতো। কখন কোন দান পড়বে আর কখন যে সাপ কাটবে তা বোঝার উপায় নেই। তাই আমাদের সবসময় উচিত ভেবে চিন্তে পথ চলা। যে পরিস্থিতিই আসুক আমাদের মনের মধ্যে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার মতো শক্তি সঞ্চয় করা উচিত। আমি আর বেশি কথা বাড়াতে পারলাম না। ওখান থেকে উঠে চলে গেলাম। তারপর সন্ধ্যায় সবার অনেক হৈচৈ এর মধ্যে দিয়ে তিথির হলুদ সন্ধ্যা সম্পূর্ণ হলো।
আজ তিথির বিয়ে। সবকিছুর শেষে ওর বিয়েটা সম্পূর্ণ হলো।
তিথির মলিন মুখটা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে শুধু তিথিলা একাই নয়, বাংলাদেশে হাজার হাজার তিথিলা এমন অত্যাচারের শিকার। আর এই হাজার হাজার পরিবার তাদের ঠুনকো লোক দেখানো মান-সম্মানের দোহায় দেখিয়ে চেপে রেখেছে হাজারও অপরাধ।
আমরা শুধু কাগজে কলমেই শিক্ষিত। মন থেকে কেউ শিক্ষিত হতে পারিনি। যদি আমরা শিক্ষিত হতাম তবে একজন গলা উঠালে বাকিরাও গলা উঠিয়ে প্রতিবাদ করতাম। আমরা কেবলই ঝামেলা থেকে গা বাঁচিয়ে চলি। আমরা কেউ কারও জন্য না।