ছোটগল্প

অসমাপ্ত স্বপ্ন: জয়িতার অসমাপ্ত স্বপ্ন এবং তার মৃত্যুতে সন্দীপের হতাশা

করোনা যখন ছিন্ন করে স্বপ্ন

দীর্ঘ নয় বছর পর আজ জয়িতা মা হতে চলেছে। জয়িতা আমার ছোট ভাই সন্দীপের স্ত্রী। সন্দীপ হলেন একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। এই করোনাকালীন সময়ে সব কিছু বন্ধ থাকলেও ব্যাংকের কাজ নিয়মিত চলছে। ব্যাংক থেকে ফিরে খুশির খবর পেতেই সন্দীপ, “দিদি… দিদি… করে চিৎকার করতে লাগলো। আজ সে মহাখুশি। অনেক সাধনার পর আজ তারা মা বাবা হতে চলেছে।”

সন্দীপ জয়িতাকে নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস। তার মধ্যে এখন তো সে তার সন্তানের মা হতে চলেছে। তাই সে ভীষণ চিন্তিত জয়িতাকে নিয়ে। অফিসে যাওয়ার আগে সব কাজ শেষ করে, জয়িতার খাবার রেডি করে তারপর সন্দীপ তার অফিসে যায়। আবার অফিস থেকে ফিরেই রাতের খাবার রেডি করে। এভাবেই চলছে তাদের সংসার।

তাদের এমন সম্পর্ক দেখে বেশিরভাগ সময়ই সবাই ভাবতো তাদের প্রেমের বিয়ে। কিন্তু তা নয়। পারিবারিক ভাবেই তাদের বিয়ে হয়। আসলে দুজনের মধ্যে বোঝাপড়াটা বেশ চমৎকার ছিলো। তাই কোনো কিছুতেই তাদের সমস্যা হতো না।

দেখতে দেখতে জয়িতার নয় মাস চলছে। দিন যতই এগুচ্ছে সন্দীপের চিন্তা ততই বাড়ছে। কিন্তু সে সবসময়ই জয়িতার খেয়াল রাখতো। যত্নে কোনো ত্রুটি ছিলো না। মজার বিষয় থেকে থেকে তারা বাচ্চাদের মতো মারামারিও করতো। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তারা এমনই থাকে যেন সারাজীবন।

একদিন অফিস থেকে ফিরে এসেই সন্দীপ বিছানায় শুয়ে পড়লো। জয়িতা এসব দেখে তার গায়ে হাত দিয়ে দেখলো সন্দীপ এর প্রচন্ড জ্বর। তারপর আমি সন্দীপ কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম এবং তার পরামর্শে সকল ওষুধ নিয়ে আসলাম। দিনকাল ভালো না। করোনায় বাইরের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তাই বললাম নিয়ম করে চলবি ভাই। এর দুইদিন পর ওর জ্বর কমে গেলো। অফিসে তার এই জ্বরের কথা জানানো হলে তাকে অফিস থেকে ৭ দিনের ছুটি দিলো।

৩ দিন পর আবারও জ্বর। শরীর ব্যাথা। আরও সমস্যা দেখা দিলো। তখন ডাক্তার বললো করোনা টেস্ট করতে। আমি টেস্ট করালাম। রিপোর্টে সন্দীপ এর রেজাল্ট আসলো করোনা পজিটিভ। সন্দীপ চিন্তিত হয়ে পড়লো জয়িতাকে নিয়ে। কারণ জয়িতার তখন ৯ মাস চলছিলো। তারা দুজনই আলাদা রুমে থাকতে শুরু করলো। আমার বাসা আর সন্দীপ এর বাসা পাশাপাশি থাকায় আমি নিয়মিত তাদের খাবার দিয়ে আসতাম।

তিন দিন হোম কোয়ারান্টাইন এ থাকার পর সন্দীপের হঠাৎ মনে হলো জয়িতারও করোনা টেস্ট করানো উচিত। তাই সে আমায় বললো, দিদি জয়িতারও করোনা টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করো। আমি সন্দীপ এর কথা মতো তাই করলাম। এই টেস্টের রেজাল্ট দেখে সন্দীপ খুব ভয় পেয়ে গেলো। কারণ জয়িতারও করোনা পজিটিভ আসছে। কিন্তু জয়িতার শরীরে করোনার কোনো নমুনা ছিলো না।

তবুও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চললো জয়িতা। কিছুদিন পর জয়িতা আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলো। পাঁচ দিন পর জয়িতাকে হসপিটালে ভর্তি করতে হলো। জয়িতার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে হয়ে যাচ্ছিলো। জয়িতার এমন অবস্থা দেখে ডাক্তার সিজার করতে বললো।

রাত ৮টায় জয়িতার অপারেশন। ওটিতে যাওয়ার আগে একবার সন্দীপের সাথে ভিডিও কলে কথা বললো। সন্দীপের ওমন ফোলা ফোলা চোখ দেখে জয়িতা বললো, “আমি ভালো আছি।” নিজের যত্ন নিও। আমাদের নতুন অতিথিকে নিয়েই ফিরবো আমি।

সন্দীপ একটু হেসে বললো, আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকবো। জয়িতা হাসি মুখে ফোন রেখে দিলো। এক ঘন্টা পর আমি ফোন করলাম। সন্দীপ ফোন ধরেই বললো, দিদি আমার জয়িতা ভালো আছে তো! বাড়ি ফিরবে তো!

আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ ভাই তোর জয়িতা এবং আমাদের নতুন অতিথি ভালো আছে। সন্দীপ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মেয়েকে ভিডিও কলে দেখলো। মেয়েকে দেখেই আমায় জিজ্ঞেস করলো, দিদি জয়িতা মামণিকে দেখেছে? আমি বললাম দেখেছে কিন্তু স্পর্শ করেনি। ডাক্তার বলেছে জয়িতা এখনও করোনা পজিটিভ। সন্দীপ এর মুখটা আবারও মলিন হয়ে গেলো।

বেবি হওয়ার দুই দিন হয়ে গেলো। জয়িতা আস্তে আস্তে সুস্থের দিকে। তৃতীয় দিন হঠাৎ আবার জয়িতার শরীর খারাপ হতে শুরু করলো। তাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হলো। আমি ভাইকে ফোনে সব জানালাম। ভাই আবারও চিন্তা করতে শুরু করলো।

দেখতে দেখতে আরও তিনদিন কেটে গেলো। আমি বাবুকে নিয়ে বসে আছি। ডাক্তার হঠাৎ করে বললেন রোগী দেখা করতে চায় আমার সাথে। আমি বাবুকে নার্সের কাছে রেখে গেলাম। জয়িতা বললো, দিদি আমার মেয়েটাকে দেখো।

আর ওর নাম রেখো স্পৃহা। তোমার ভাইকে বলো আমি ফিরতে পারলাম না। বলেই জয়িতা জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। আমি নর্বিকার চোখে তাকিয়েই রইলাম। ডাক্তাররা অক্সিজেন দেয়ার ব্যবস্থা করে আমাকে বাইরে যেতে বললেন। আমি বাইরে এসেই সন্দীপ কে কল দিলাম। সন্দীপ সব কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে রইলো।

 

পরের দিন সকালে…

ফোন বেজেই চলছে। আমি বারবার কল দিয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছি। এদিকে সন্দীপ তার রুমে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। কোনো ভাবেই সে ফোন রিসিভ করছিলো না। এমন করে প্রায় আধা ঘণ্টা বেজেই চললো তার ফোন। তারপর কিছুক্ষণ আমি আর কোনো ফোন দিলাম না। আমি কোনো উপায় না পেয়ে হোয়াটসঅ্যাপ এ একটি ভিডিও পাঠালাম।

“ভাই জয়িতার শেষ মুখখানা দেখবি না? প্লীজ ফোনটা রিসিভ কর!”

কিছুক্ষণ পর আমি আবারও কল দিলাম। ফোনটা রিসিভ করেই সন্দীপ চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। সন্দীপ কাঁদতে কাঁদতে সৃষ্টি কর্তাকে বলতে লাগলো, “ঠাকুর! এ কেমন লীলা খেলা তোমার! আমার তো সবই নিয়ে গেলে। এই শেষ সময়টাও আমাকে একটু সুযোগ দিলে না!”

বলেই সন্দীপ কেঁদেই চললো। ওপার থেকে আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আমিও কাঁদতে লাগলাম। কি বলবো বুঝতে পারছি না। আর কি বলেই বা ভাইকে সান্ত্বনা দিবো। তবুও আমি ভাইকে বললাম, ভিডিও কলটা অন রাখ। কোনো ভাবেই ফোন কাটবি না। সন্দীপ শুধু কেঁদেই চলছিলো। আমি বুঝতে পারছি না কি করবো। এদিকে স্পৃহা, আর একদিকে জয়িতা এবং অন্যদিকে ভাই। আমার নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসছিলো।

আমি বারবার ভাইকে দেখছিলাম। ফোন কাটতে দেইনি। সন্দীপ জয়িতার কথা মনে করতে করতে বারবার কাঁদছিলো। তার আর জয়িতার কাটানো মূহুর্তগুলো বারবার আমায় বলছিলো। সে আমায় বললো, দিদি জয়িতা আমাকে একা রেখে গেলো কিভাবে?

মনে আছে দিদি একবার আমি কাজের সূত্রে বাইরে গিয়েছিলাম! ফোনে নেট প্রবলেম হওয়ায় কোথায় কল দিতে পারছিলাম না। এমনকি কোনো কল আসছিলোও না ফোনে। এজন্য কাজ শেষ করেই আমি বাড়ি ফিরে ছিলাম। এসে দেখি সেকি কান্না তার। আমায় দেখেই জড়িয়ে ধরে আরও কাঁদতে লাগলো। কোনো ভাবেই তাকে থামাতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর তার সেই রাগ হলো। বললাম, নেটে সমস্যা ছিলো। তারপরও তার অভিমান ভাঙ্গাতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত প্রমিজ করিয়ে নিয়েছে। যেন আর কখনো তাকে একা রেখে কোনো কাজে না যাই। সে নাকি আমায় ছেড়ে থাকতে পারবে না। তাহলে দিদি আজ সে কিভাবে আমায় ছেড়ে থাকবে? বলেই ভাই আবারও কাঁদতে লাগলো।

আরও চৌদ্দদিন পর সন্দীপের রিপোর্ট করোনা নেগেটিভ আসলো। সে তার মেয়ে স্পৃহাকে কোলে তুলে নিলো। মেয়েকে জড়িয়েই সন্দীপ আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, আমরা দুজনই ‘Unlucky’। তোমার মায়ের কতো কষ্টের ফসল তুমি জানো! সে তোমাকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারেনি।

সন্দীপের এই কান্না দেখে বুক ফেটে যাচ্ছিলো আমার। এই মহামারীতে শুধু সন্দীপই নয়, আরও কত মানুষ তার প্রিয়জনদের হারিয়ে নিঃস্ব।

সন্দীপ মেয়েকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে গেলো। এই মেয়েই তার বেঁচে থাকার স্পৃহা। জয়ীতা এজন্যই হয়তো মেয়ের নাম দিয়েছে স্পৃহা।

ছবি: Image by v.ivash on Freepik

সেলিনা আক্তার শাপলা

I'm Shelina Akter Shapla. I work as a content writer for the Ovizatri - News & Magazine online news portal. Additionally, I am a co-founder of this website along with the admin, MD Mehedi Hasan. I also have another identity: I have completed my Master's degree from the Department of Philosophy at Rajshahi University.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button