বুধসন্ধ্যা: সাহিত্যিকদের সৃজনশীলতার কেন্দ্রবিন্দু
বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের তিন দশকের আড্ডা ও সমাজ উন্নয়ন
তিন দশক ধরে ‘বুধসন্ধ্যা’ ছিল বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান। এখানে তুমুল আড্ডা ও সমাজের উন্নতির জন্য নানা কাজ করা যেত। যেহেতু সাহিত্যিকদের প্রতিষ্ঠান, তাই বুধসন্ধ্যা নিয়ে সদস্য সাহিত্যিকদের বাড়তি ভালবাসা ছিল। বাংলা ভাষার অনেক দিকপাল লেখক ও কবিরা এই প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে যা করেছেন, তা সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করেছে।
প্রতিষ্ঠা ও প্রথম কাজ
বুধসন্ধ্যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮২ সালে। নামের আইডিয়া আসে স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের মাথায়। প্রথম কাজ ছিল সদস্য সাহিত্যিকদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ মঞ্চস্থ করা। দু’বার অভিনীত হয়েছিল মুক্তধারা, দু’বারই হাউজফুল। শো থেকে সংগৃহীত অর্থ থেকে ৩০ হাজার টাকা দান করা হয়েছিল ঠাকুর পুকুর ক্যান্সার হসপিটালে। ওই টাকায় লেখকদের চিকিৎসার জন্য একটি ফ্রি বেডের ব্যবস্থা করেছিল বুধসন্ধ্যা।
কবি সম্মেলন ও বিতর্ক সভা
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে বেশ কয়েকবার কবি সম্মেলন হয়েছিল, যেখানে প্রতিষ্ঠিত কবিদের পাশাপাশি নতুনদেরও স্থান দেওয়া হতো। এছাড়া বিতর্ক সভারও আয়োজন হতো বুধসন্ধ্যায়। কোনো বিতর্ক সভার বিষয় ছিল ‘সঙ্গীত’, কোনোটার ‘যুক্তি ও বিশ্বাস’। ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের ভয়ংকর প্রভাব থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন বিনয় মুখোপাধ্যায় (যাযাবর), নিমাইসাধন বসু, বুদ্ধদেব গুহ, পবিত্র সরকার, তুষার তালুকদার, মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়, উষা গঙ্গোপাধ্যায়, ডা. শৈবাল গুহ, দিব্যেন্দু পালিত এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
বুধসন্ধ্যার আসর
প্রতি বুধবার বুধসন্ধ্যার আসর হতো। বুধসন্ধ্যা কখনো এমব্যাসি ভবনের পাঁচতলায়, কখনো কল্যাণ চৌধুরীর ফ্ল্যাটে, এখানে ওখানে হতো। বুধসন্ধ্যার রজত জয়ন্তী সংখ্যায় সুভেনিরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন – ‘বুধসন্ধ্যার ঠাঁইবদল’। সুনীলের ম্যানডেভিল গার্ডনের ফ্ল্যাটে বুধসন্ধ্যার আসর সমাজ, সংস্কৃতি নিয়ে নানা ভাবনা, চিন্তা করার নির্ভেজাল আড্ডা হতো। তবে কখনো কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে আক্রমণ করা হতো না। এই নিয়ে মত বিরোধ হলেও কোনো গন্ডগোল কিংবা দল ভাঙেনি।
বিশেষ আকর্ষণ
বুধসন্ধ্যার বড় আকর্ষণ ছিল ‘ইলিশ দুপুর’ বা ‘চিংড়ি দুপুর’। এই ধরণের অনুষ্ঠান বুধবার করা যেত না, কারণ প্রায় সবার অফিস কিংবা কাজ থাকতো। ফলে রবিবার করা হত খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠান। বুধসন্ধ্যার পিকনিকগুলো খুব মজার হতো। আড্ডা, গানের লড়াই, মেমরি গেম, নাটকও অভিনীত হতো, কবিতা পাঠ।
রজতজয়ন্তী ও মূল্যায়ন
২০০৭ সালে বুধসন্ধ্যার রজতজয়ন্তী পালন করা হয়। এতো বড়ো একটি সার্থক প্রতিষ্ঠানের যথাযোগ্য মূল্যায়ন হয়নি আজও। লেখালেখির পাশাপাশি সেই সময়কার বাঙালি সাহিত্যিকদের একটি বড় অংশের ব্যক্তিজীবন, সমাজ ভাবনা কিছু করার তাগিদের জন্য বুঝতে হলে বুধসন্ধ্যার কাছে গবেষকদের যেতেই হবে।
সমরেশ বসু: একজন কিংবদন্তি সাহিত্যিক
ইদানিং সাহিত্যিকদের ‘দাদা’ সম্বোধন করার চল হয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন বেঁচে ছিলেন, তখন গোঁফ গজায়নি এমন ছেলেও তার বাবার বয়সের চেয়ে বড় সুনীলকে অনায়াসে ‘সুনীলদা’ বলে ডাকতো। আগে চল ছিলো দাদার বদলে ‘বাবু’। তাই সমরেশ বসু ছিলেন ‘সমরেশ বাবু’। সমরেশ বাবুর চেহারায় একটা কারিশমা ছিল। শৌখিন মানুষ ছিলেন। ধপধপে ধুতি – পাঞ্জাবি পরতেন। উত্তমকুমার পর মতো হাবভাব ছিলো। লেখার মতো সমরেশ বাবুর চেহারা, ব্যক্তিত্ব মানুষকে টানতো, বিশেষত মহিলাবর্গ।
সমরেশ বসুর সাহিত্যকর্ম
সমরেশ বসু ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, জেলও খেটেছিলেন। কারখানায় কাজ করতে, কত উঞ্ছবৃত্তি করতে হয়েছিল কম বয়সে। তাঁর সম্বন্ধে একটি চমৎকার বাস্তব জীবনী উপন্যাসাকারে লিখেছেন তাঁর ছোট ছেলে ডা. তথা লেখক নবকুমার বসু, ‘চিরসখা’ নামে। লেখক জীবনে সমরেশ বসু পুরোপুরি লেখক। লেখাই তাঁর জীবন। তাঁর কাজ ১৯৬৫-৬৬ সালের কথা একটানা লিখে যেতেন সমরেশ বসু ছোট ছোট অক্ষরে লিখতেন। কোনও কাটাকুটি থাকতো না। সাধক যে ভাবে পুজো করেন সে ভাবে একভাবে লিখে যেতেন। কথিত আছে তাঁর কানের কাছে ঢাকাঢোল বাজলেও তাঁর ঘোর কাটতো না। অনর্গল লিখতেন।
বিবর ও প্রজাপতি: বিতর্কিত উপন্যাস
শারদীয়া ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো তাঁর বিবর। আর শুরু হয়েছিলো তুমুল বিতর্ক। অশ্লীলতার দায়ে ধুন্ধুমার অভিযোগ। সেই চিঠিপত্র প্রকাশিত হতে থাকলো দেশ পত্রিকায়। লেখক সন্তোষ কুমার ঘোষ কিন্তু বিবর এর উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। অভুতপুর্ব সাধুবাদ জানিয়েছিলেন তিনি। ৩০.১০.৬৫ তারিখে সেই চিঠি যেন এক ঐতিহাসিক দলিল! বলেছিলেন সেরা দশটি উপন্যাসের মধ্যে এটি একটি। যুগধর্মী রচনার সমস্ত লক্ষণে এই বইটি আক্রান্ত। চিত হয়ে শুয়ে এই বই পড়া যায় না। ইংরেজি ‘ডিস্টার্বিং’ শব্দটির সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ আছে কি না জানা নেই, ‘বিবর’ এক কথায় ‘ডিস্টার্বিং’। হয়তো এক রাত্রির ঘুম নষ্ট হবে, চেনা মানুষ দেখলেও সকালে আঁতকে উঠবেন শেষমেষ রেগে বইটাকে হয়তো ছুঁড়ে ফেলতে চাইবেন, কিন্তু উড়িয়ে দিতে পারবেন না। এই খানেই বিবরের জিত।
প্রজাপতি: নিষিদ্ধ উপন্যাস
প্রজাপতি নিয়ে আবার বিতর্কের ঝড় ওঠে। বইটির প্রথম সংস্করণে ৮,৮০০ কপি ছাপা হয়েছিলো। প্রজাপতি বিক্রিও হচ্ছিলো হু হু করে। প্রজাপতি অশ্লীল বলে মামলা ও নিষিদ্ধ করা হলো সমরেশ বসুর পক্ষে প্রথম ও প্রধান সাক্ষী ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। আর ছিলেন কবি- অধ্যাপক নরেশ গুহ। মামলার শুনানির দিনে আদালতে মানুষের ঢল নেমেছিলো। কোথাও পা রাখার জায়গা ছিল না। সমরেশ বাবুর সেই মামলায় আর একজন অভিযুক্ত ছিলেন। দেশ পত্রিকার তৎকালীন প্রকাশক ও মুদ্রাকর সীতাংশুকুমার দাশগুপ্ত। এঁদের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিলেন ব্যারিস্টার করুণাশংকর রায়। অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন আদালতের রায়ে। তাঁদের ২০১ টাকা করে জরিমানা হয়। দুশো একটাকা জরিমানা দিয়ে বিবর এর মামলা মিটলো। আর প্রজাপতির মামলা চলতে থাকলো। নিষেধাজ্ঞা উঠলো না। এই রায়ের বিরুদ্ধে সমরেশ বসুর পক্ষ থেকে হাইকোর্টে আবেদন করা হলো ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। হাইকোর্টেও লেখকের পরাজয় হলো। হাইকোর্টের নির্দেশে প্রজাপতির প্রকাশনা বন্ধ হলো। আনন্দ পাবলিশার্সের তৎকালীন ম্য্যনেজিং ডিরেক্টর বললেন, “সুপ্রীম কোর্ট যাবো।” তাই যাওয়া হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত প্রথম প্রকাশের সতেরো বছর পর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রজাপতি নির্দোষ প্রমাণিত হলো। ১৯৮৫ সালে বের হলো প্রজাপতির দ্বিতীয় সংস্করণ।
সমরেশ বসুর সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন
লেখাই ছিলো সমরেশ বাবুর একমাত্র জীবিকা। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিলো সুরথ। লিখতেন সমরেশ, কালকুট, ভ্রমর নামে। তিনি তাঁর ‘শাম্ব’ উপন্যাসের জন্য ১৯৮০ সালে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান। প্রথম দিকে তাঁর বইয়ের তুলনায় বিবর, প্রজাপতি, স্বীকারোক্তি পর্বে তাঁর বই হু হু করে বিক্রি হতো। তাঁর কালকুট নামের বইগুলো বেশি বিক্রি হতো, এখনো হয়।
তথ্যবহুল টেবিল
বিষয় | বিবরণ |
---|---|
প্রতিষ্ঠা | ১৯৮২ |
প্রথম কাজ | রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ মঞ্চস্থ |
দানকৃত অর্থ | ৩০,০০০ টাকা (ঠাকুর পুকুর ক্যান্সার হসপিটাল) |
রজতজয়ন্তী | ২০০৭ |
বিতর্কিত উপন্যাস | বিবর, প্রজাপতি |
সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার | ১৯৮০ (শাম্ব উপন্যাস) |
সমাপ্তি
বুধসন্ধ্যা ছিল বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের জন্য একটি প্রিয় প্রতিষ্ঠান, যা তাদের সাহিত্যকর্মকে সমৃদ্ধ করেছে এবং সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করেছে। সমরেশ বসুর মতো কিংবদন্তি সাহিত্যিকদের অবদান এই প্রতিষ্ঠানকে আরও মহিমান্বিত করেছে। বুধসন্ধ্যার ইতিহাস ও কার্যক্রম গবেষকদের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.