কলম

ইয়ংবেঙ্গল: এক সাহসী যুব সম্প্রদায়ের গল্প

বঙ্গদেশের সামাজিক পরিবর্তনের অগ্রদূত এবং তাদের সংগ্রামের ইতিহাস

বিজ্ঞাপন

এ সেই সময়ের কথা, যখন বঙ্গ দেশে মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণ প্রচলিত হয়নি এবং ‘সতীদাহ’ প্রথা শহরের দিকে লুপ্ত হলেও গ্রামে, গঞ্জে প্রচলিত ছিল। তখন ভারতীয়দের মধ্যে এক শ্রেণীর অগ্রণী যুবা শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছিল যাঁরা ‘ইয়ংবেঙ্গল’ নামে খ্যাত হয়েছিলেন।

ইয়ং বেঙ্গল যুব সম্প্রদায়

ইয়ং বেঙ্গল সেই যুব সম্প্রদায়, যাঁদের শিক্ষাগুরু ছিলেন ‘ডিরোজিও’ নামে এক অকালমৃত ফিরিঙ্গি যুবক। দেশীয়দের মধ্যে এঁরাই ইংরেজি শিক্ষায় কৃতবিদ্য ছিলেন। এই ‘ইয়ংবেঙ্গল’ যুবা সম্প্রদায় নামে চিহ্নিত গণ কিন্তু বহুপ্রকার অখ্যাতিরও সম্মুখীন হয়েছিলেন।

রক্ষণশীল সমাজের প্রতিক্রিয়া

রক্ষণশীল সমাজের চক্ষুশূল ছিলেন এঁরা। ডিরোজিও শিষ্য এই ইয়ংবেঙ্গল উন্মাদনা বশে এমন অনেক উৎকট কান্ড কারখানা করতেন যা কর্তব্য নয়। পথেঘাটে কোন টিকিধারী বামুন দেখলে তাকে তাড়া করে চেঁচাতেন বলতেন, “আমরা গরু খাই গো গরু খাই।” বামুন ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়ে ত্বরিত গতিতে পালাতে গিয়ে ‘মুক্তকচ্ছ’ হয়ে পড়তেন। আবার প্রতিবেশীদের গৃহপানে সরবে চিৎকার করে বলতো, “এই দ্যাখো আমরা মুসলমানের ছোঁয়া জল খাচ্ছি।” এই যুবক দল সমাজের বহু মঙ্গলজনক কাজ করেছিলো যা প্রভূত খ্যাতিও অর্জন করেছিল।

বর্তমান সময়ের ইয়ং বেঙ্গল

যাই হোক, সে সব দিন পেরিয়ে গেছে। এখন আর ‘ইয়ংবেঙ্গল’ দলের কেউ যুবক নন। তাঁরা মধ্যবয়স্ক এই সময়। ধীর স্থির, সবাই দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন। নগরের বিচক্ষণ ব্যক্তি তাঁরা কেউ সরকারি চাকুরে, কেউ নামী ব্যবসায়ী, কেউ কোনো উচ্চ দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত। তবে একেবারে যে প্রদীপ নিভে গেছে এমনটি নয়, প্রত্যেকটি সামাজিক কাজে কখনো কখনো এঁদের কাউকে কাউকে যোগ দিতে দেখা যায়।

রামগোপালের সান্ধ্য আসর

এঁদের মাঝে ঘোষের ‘পো’ রামগোপাল অতি বন্ধুবৎসল এক মহান ব্যক্তি বলে নাম কিনেছেন। ইংরেজের সঙ্গে যুগ্মভাবে ব্যবসা করে ঐশ্বর্যশালী হয়েছেন। তাঁর বাড়ীর সান্ধ্য আসরে শেরি ও শ্যাম্পেন থাকে কিন্তু কেউ নেশাগ্রস্ত হয়ে কোন কুৎসিত আচরণ করে না। সান্ধ্য আসরে আত্মোন্নতি ও জ্ঞান অর্জন মূল লক্ষ্য এই দলটির। এবার বহুদিন বাদে রামগোপালের গৃহে সব একত্রিত হওয়া। উদ্দেশ্য এক ‘নির্ভেজাল আড্ডা’।

বিজ্ঞাপন

বন্ধুদের পরিচয়

এঁদের মধ্যে আছেন মল্লিক ‘পো’ রসিককৃষ্ণ, তিনি বর্ধমানের ডেপুটি কালেক্টর। আছেন লাহিড়ি ‘পো’ রামতনু, তিনি কৃষ্ণনগর কলেজের শিক্ষক। আছেন শিকদার ‘পো’ রাধানাথ, তিনি দেরাদুনে সরকারের জরিপ বিভাগের এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী। চলছে গল্পগাছা, পানীয়ের সদব্যবহার তবে তা সীমিত মাত্রায়।

রাধানাথের বিস্ময়

বন্ধুদের একটা ব্যবহারে রাধানাথ যারপরনাই অবাক হয়ে গিয়েছেন এঁদের মুখের ভাষা শুনে। ছাত্র বয়সে সবাই তো ইংরেজিতে কথা বলতেন, বাংলা ভাষার কোন স্থানই ছিল না। নেহাৎ বাড়ীতে বাবা মায়ের সঙ্গে জোর করে বাংলা বলা! এবারে দেরাদুনে থাকতে রাধানাথ বাংলা কে জীবন থেকে পরিত্যাগ করেছিলেন।

চায়ের আবিষ্কার

কিন্তু এখন কি দেখছেন, প্যারি, রামতনু, রামগোপাল, রসিক সব পাক্কা ইংরেজবাজদের মুখে বাংলা! এরা কি আবার দেশটাকে অশিক্ষার অন্ধকারে নিয়ে যাবে বাংলা কে নিয়ে!

গোল টেবিলে আড্ডা চলছে। ভৃত্য সাজিয়ে দিয়েছে গেলাস ও সুরার বোতল, শুধ রামগোপালের সামনে একটি পোরসিনেলের বাটি। কেন?

সেই বাটিতে রামগোপাল কালো উষ্ণ তরল ঢেলে চামচ তিন চিনি, চামচ তিন দুধ ঢেলে একটি চামচ সহকারে ‘ঠুনঠুন’ শব্দে মিশ্রিত করে বাটিটি নিজের অধরের নিকটে এনে ‘সুরুৎ’ করে বিচিত্র আওয়াজে গিলে ফেলে বলেন, “আহ!”

বিজ্ঞাপন

চায়ের স্বাদ

একি! রাধানাথ কৌতূহল চাপতে পারলেন না, “হোয়াট ইজ দ্যাট স্ট্রেঞ্জ কনেকশন?” রামগোপাল পরিহাসে বলেন, “দিজ ইজ ফেবারিট পয়জন, একটু স্বাদ নাও।” রসিককৃষ্ণ তখন বলেন, “দিজ ইজ ‘টি’, নাম শোনোনি ভায়া! এ তো চীন দেশের মাল, এখন ভারতে আসামে হয়।”

চায়ের প্রভাব

প্যারিচাঁদ মদ্যপান করেন না, তাঁর আসক্তি ধূমপানের দিকে। বলেন, “আমি একটি চাখবো ভাবছি।” রামতনু বললেন, “মনে হয় এতে মাদক দ্রব্য কিছু নেই, নেশাভাং হয় না।”

শিবনাথ মুখ বেঁকান, “নেশা না হলে আর ঐ জিনিস কেন পান করা?”

রামগোপাল প্যারির জন্য বাটিতে চা ঢালতে ঢালতে বলেন, “আরেহ না! নেশা হয় বৈকি! এর এক চুমুকেই পঞ্চেন্দ্রিয়ে একটা আলাদা এলার্টনেস এসে যায়। লাইক কিসিং এ ড্যামজেল… এন্ড ইউ ওয়ান্ট টু কিস এগেইন… এই নাও প্যারি।”

চায়ের প্রশংসা

রামগোপাল জিজ্ঞাসা করেন, “কি ব্রাদার, লাগলো কেমন?”

বিজ্ঞাপন

প্যারি বলেন, “একটু তিক্ত, একটু কষায়।” সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। আরও একটু চিনি মিশিয়ে রামগোপাল বলে, “এবার খেয়ে বলো।” প্যারি এবারে পান করে বলেন, “বাঃ! দিব্য! আহা!”

আবারও রামগোপাল জিজ্ঞাসা করেন, “বেশ চনমনে একটা ভাব এসেছে না?”

প্যারি বলেন, “বিলকুল!”

আবারও জিজ্ঞাসা রামগোপালের, “মনে হয় না আবার চুম্বন করি, আবার আবার!”

প্যারিচাঁদ বললেন, “ভাই, এবার থেকে আমরা এটি পান করবো। শুধু শুধু সুরাপানে দেশ রসাতলে যাচ্ছে!”

বিজ্ঞাপন

রাধানাথের প্রতিক্রিয়া

কিন্তু রাধানাথ বলেন, “এই ফিলদি লুকিং লিকুইড নিয়ে তুমলোগ এত কিঁউ শোর মচাতা?”

শিবচন্দ্র বলেন, “শোর মচাতা? তার মানে কি ভাই?”

রসিককৃষ্ণ বলেন, “রাধা তো একেবারে বাংলা ভুলে গেছে। বাবাকে বলে, পিতাজী আর জলকে বলে পানি।”

রাধানাথ রেগে বলেন, “এণ্ড ইউ? তোমরা একেবারে অচানক বাংলা লাভার হয়ে যাবে হাউ কুড আই নো দ্যাট? ইন আওয়ার কলেজ ডেজ ইউ অল ইউজড টু হেট দিজ ল্যাঙ্গুয়েজ!”

বাংলা ভাষার পরিবর্তন

প্যারি বলেন, “না ভাই, বাংলা ভাষা এই সময়ের মধ্যে অনেক বদলে গেছে। তখন ভাবতাম বাংলা ভাষায় কোনো ভাব প্রকাশ হয় না। কিন্তু এখন অনেক ভালো ভালো লেখক এসে গেছেন।” একখানি ‘তত্ত্ববোধিনী’ কাগজ এনে তার হাতে দিয়ে বলেন, “এই কাগজ দেখে আমরা চমকে গেছি ভাই!”

বিজ্ঞাপন

রসিক বলেন, “দেবেন ঠাকুর, অক্ষয় দত্ত যা সব বাংলা লিখছেন কোনো অংশে সেই প্রোজ কার্লাইল বা মিল এর চেয়ে হীন নয়।”

নতুন লেখকদের আবির্ভাব

এবার প্যারিচাঁদ বলেন, “আর জানো, এক বামুন পণ্ডিত তার নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সে কি লিখেছে জানো ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’। রাধানাথ বিমূঢ় বোধ করলেন, “এরা কারা?”

নতুন যুগের সূচনা

সবাই বললেন, “রাধানাথ ভায়া, এঁরা এক যুগান্তকারী কাজ করছেন। তুমি আরও জেনে রাখো এঁরা স্ত্রী শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ নিয়েছেন যার জন্য দরকার বাংলা ভাষা!”

রাধানাথ চমকে বলেন, “কি বললে ফিমেল এডুকেশন! এ দেশে পসিবল?”

বিজ্ঞাপন

তখন দক্ষিণারঞ্জন বলেন, “কেন নয়? নারীদের আমরা কতকাল অন্ধকারে রাখবো?”

নতুন লেখকদের অবদান

রসিককৃষ্ণ বলেন, “দেবেন ঠাকুর, অক্ষয় দত্ত যা সব বাংলা লিখছেন কোনো অংশে সেই প্রোজ কার্লাইল বা মিল এর চেয়ে হীন নয়।”

বিদ্যাসাগরের অবদান

এবার প্যারিচাঁদ বলেন, “আর জানো, এক বামুন পণ্ডিত তার নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সে কি লিখেছে জানো ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’। রাধানাথ বিমূঢ় বোধ করলেন, “এরা কারা?”

সমাজের পরিবর্তন

সবাই বললেন, “রাধানাথ ভায়া, এঁরা এক যুগান্তকারী কাজ করছেন। তুমি আরও জেনে রাখো এঁরা স্ত্রী শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ নিয়েছেন যার জন্য দরকার বাংলা ভাষা!”

রাধানাথ চমকে বলেন, “কি বললে ফিমেল এডুকেশন! এ দেশে পসিবল?”

বিজ্ঞাপন

তখন দক্ষিণারঞ্জন বলেন, “কেন নয়? নারীদের আমরা কতকাল অন্ধকারে রাখবো?”

কৃতজ্ঞতা

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাধানাথ শিকদার

উপসংহার

এই আর্টিকেলটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সমাজের পরিবর্তন এবং উন্নতি কেবলমাত্র কিছু অগ্রণী ব্যক্তির প্রচেষ্টার ফলেই সম্ভব। ইয়ং বেঙ্গল যুব সম্প্রদায়ের মতো সাহসী এবং উদ্যমী যুবকদের প্রচেষ্টায় সমাজে নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল। তাদের অবদান এবং সংগ্রাম আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

ছবি: Designed by Freepik


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading