বিশ্বের ৫টি ভয়ঙ্কর স্থান: যেখানে প্রকৃতি তার ভয়ঙ্কর রূপ দেখায়
অয়মিয়াকনের শীতলতা থেকে স্নেক আইল্যান্ডের বিষধর সাপ পর্যন্ত, জানুন পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক স্থানগুলোর গল্প
বিশ্বের সেরা ৫টি ভয়ঙ্কর স্থান সম্পর্কে জানুন। অয়মিয়াকনের শীতলতা, স্নেক আইল্যান্ডের বিষধর সাপ, নেট্রন লেকের পাথর হয়ে যাওয়া প্রাণী, কঙ্কাল উপকূলের তিমির কঙ্কাল এবং ডোর টু হেলের জ্বলন্ত গর্ত – সবই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বিপদের এক অদ্ভুত মিশ্রণ।
১. অয়মিয়াকন (Oimyakon)
ডীপ ফ্রীজের চেয়ে বেশি ঠান্ডায় বসবাস করে এমন একটি স্থানের নাম হলো, অয়মিয়াকন যা সাইবেরিয়ার একটি শহর। এখানে ডিপ ফ্রীজের চেয়ে তিনগুন বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করে। এটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল শহর বলা হয়। এখানে এতোটায় শীতের প্রকোপ যে গরম জল ছুড়ে মারলে তা মাটিতে পড়ার আগেই বরফে পরিণত হয়। এর মধ্যেও এখানে কিছু মানুষ বসবাস করে।
দুর্গম যাত্রা
সবচেয়ে কাছের শহর থেকে এই দুর্গম অয়মিয়াকন শহরে পৌঁছাতে সময় লাগে দু’দিন। আর সেখানে যাওয়ার রাস্তাটিও পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক রাস্তা। দশ লাখেরও বেশি মানুষ মারা গেছে এই বিপদজনক রাস্তাটি তৈরী করতে।
শীতের প্রকোপ
বছরে নয় মাস এই অয়মিয়াকন শহরের বাসিন্দাদের ডিপফ্রীজের চেয়ে তিনগুন বেশি ঠান্ডার মধ্যে কাটাতে হয়। এখানকার তাপমাত্রা এতোটাই শীতল যে পানির পাইপে বরফ জমে সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। তাই এই বাসিন্দাদের শীতকালে পানির হাহাকার লেগে যায়। তারা খাবার রান্না ও ঘর গরম রাখার সময় সেই আগুনে বরফ গলিয়ে পানি পান করে থাকেন।
খাদ্যাভ্যাস
ঘোড়ার মাংস অয়মিয়াকন শহরের মানুষের প্রধান খাদ্য। এরা ‘-৫০ ডিগ্রী’ তাপমাত্রায় খোলা আকাশের নিচে সহজেই চলাফেরা করতে পারলেও ঠান্ডায় তাদের শরীরে বরফ জমাট বেধে যায়। এখানে ঠান্ডার কারণে এতো দ্রুত যেকোন খাবার বরফে পরিণত হয়ে এমন শক্ত হয় যে, সেটি দিয়ে হাতুরির কাজও করা যায়। আর এই বিপদজনক অয়মিয়াকন শহরে শীতকালে ‘-৭২ ডিগ্রী’ পর্যন্ত তাপমাত্রা নেমে যায়।
রোড অফ বোনস্
সোভিয়েত আমলে জোসেফ স্ট্যালিন অয়মিয়াকনের রাস্তা তৈরী করেন জেলে থাকা রাজ বন্দীদের দিয়ে। এতে প্রায় দশ লাখ মানুষ মারা গেছে। তাদেরকে সমাহিত করা হয়েছিলো রাস্তার বরফের মধ্যে। আর সেই মৃতদের হাড় রাস্তার বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যবহার করা হয়েছিলো বলে এই সড়কের নাম করণ করা হয় “রোড অফ বোনস্”।
২. স্নেক আইল্যান্ড বা সাপের দ্বীপ (Snake Island)
ব্রাজিলের সাও পাওলোর উপকূলে রয়েছে এমনই এক দ্বীপ, যেখানে প্রতি এক বর্গমিটারের মধ্যে ৫টি করে বিষধর সাপ পাওয়া যায়। আর একারণেই এই দ্বীপটিকে বলা হয় স্নেক আইল্যান্ড বা সাপের দ্বীপ। তবে এটিই এই দ্বীপের আসল নাম নয়।
আসল নাম
এই দ্বীপের আসল নাম ইলহা ডা কুইমাডা গ্র্যান্ডি (Ilha da Queimada Grande)। এখানে এমন সব ভয়ঙ্কর সাপের বসবাস, যার জন্য ব্রাজিল সরকার বাধ্য হয়ে দ্বীপটিতে সাধারণ মানুষের ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এত ভয়ঙ্কর দ্বীপটি বাইরে থেকে দেখে মনে হবে যেন কি অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি। অথচ এর ভেতরে ভয়ঙ্কর মৃত্যু অপেক্ষা করছে।
গোল্ডেন ল্যান্সহেড
এই দ্বীপটিতেই পৃথিবীর সবচাইতে বিষধর সাপ গোল্ডেন ল্যান্সহেডেরও বাস। আর এই বিষধর গোল্ডেন ল্যান্সহেড এ দ্বীপটি ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। গোল্ডেন ল্যান্সহেডের বিষ এতটাই ভয়ঙ্কর যে তা শুনলেই শরীর শিউরে ওঠে। এই সাপের বিষ মানুষের শরীরে যাওয়ার সাথে সাথেই সে মারা যাবে এমনকি কিছুক্ষণের মধ্যেই তা শরীরের মাংস পর্যন্ত গলিয়ে দিতে পারে।
অন্যান্য সাপ
এছাড়াও এই দ্বীপের অন্যান্য সাপগুলোও কম নয়। এরা উড়ন্ত পাখি ধরে দিব্যি খেয়ে ফেলতে পারে। এই ভয়ঙ্কর দ্বীপ ইলহা ডা কুইমাডা গ্র্যান্ডির আয়তন ৪ লক্ষ ৩০ হাজার বর্গমিটার। ভয়ঙ্কর এ দ্বীপে যাওয়া আর সাক্ষাত মৃত্যুদূতের মুখোমুখী হওয়া একই বিষয়।
৩. নেট্রন লেক (Lake Natron)
আফ্রিকার তানজানিয়ায় (Tanzania) অবস্থিত একটি লেকের নাম হলো নেট্রন লেক (Lake Natron)। একে বলা হয় যেন সাক্ষাত মৃত্যুর ফাঁদ, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না। এটি এমনই একটি লেক যার জলে পশু পাখিরা বসলেই পাথর হয়ে যায়। এই লেকের ছবি দেখলে বোঝা যাবে না এত সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিশিষ্ট লেক এরকম মৃত্যুপুরী হতে পারে।
লেকের বৈশিষ্ট্য
দেখতে অপরূপ সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর এই লেকটি অবস্থিত আফ্রিকার তানজানিয়ায়। এর দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ প্রায় ৫৭ কিলোমিটার ও ২২ কিলোমিটার। এই নেট্রন লেকের রহস্য কি? বিজ্ঞানীরা বলছেন এই লেকের জলে রয়েছে অতিরিক্ত পরিমাণে সোডিয়াম কার্বনেট এবং সোডা। যার ফলে এই হ্রদের জল অস্বাভাবিক ক্ষারধর্মী। এর পিএইচ-এর মাত্রা ১০.৫। ফলে এটি চামড়ায় লাগলেই তা পুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
লেকের রং
শুধু তাই নয় এই সোডিয়াম ও কার্বনেট এর জন্য এই লেকে এমন এক অণুজীব জন্ম নেয় যার জন্য এই লেকের জলের রং হয় লাল। তাদের মতে, পশুপাখিরা এই রঙে আকৃষ্ট হয়েই মূলত লেকে নামে। পাখিগুলো ঠিক নিজেরাই নামে না বরং তারা পড়ে যায়।
পাখিদের মৃত্যু
এর কারণ হলো লেকের জলের পরিবর্তে লাভা থাকায় সূর্যের রশ্মি লেক থেকে বেশি পরিমাণ প্রতিফলিত হয়। আর এতে যখন পাখিগুলো এর ওপর দিয়ে উড়ে যায় তখন তাদের চোখে তীব্র আলোর ঝলকানির জন্য বিভ্রান্ত হয়েই তারা লেকেই পড়ে যায়।
এদের মধ্যে কেউ যদি অতি কষ্টে উঠেও আসে তবুও তারা আর বাঁচতে পারে না। কারণ লেকের জলের সোডা আর লবণ পাখি বা প্রাণীটির শরীরে শুকোনোর সঙ্গে সঙ্গে শরীর টেনে ধরতে থাকে। এবং আস্তে আস্তে তা পাথরে পরিণত হয়। আর এভাবেই একসময় পাখিগুলোর শরীরও পূর্ণাঙ্গ চুনাপাথরের মূর্তির রূপ নেয়।
৪. কঙ্কাল উপকূল (Skeleton Coast)
বিপুল সংখ্যক আটকে পড়া তিমির কঙ্কাল যা নামিবিয়ার আটলান্টিক উপকূলের সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে সেখান থেকেই সম্ভবত এই কঙ্কাল উপকূল নামটির উদ্ভব। এই কঙ্কাল উপকূল নামিবিয়ার আটলান্টিক উপকূলের সবচেয়ে উত্তরের অংশ। এবং এটি দেশের অন্যতম বন্য এবং সবচেয়ে প্রতিকূল উপকূলীয় অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। যা সম্পূর্ণ বালুময় এবং জনশূন্য।
উপকূলের বৈশিষ্ট্য
এটি প্রায় ৬,৫০০ বর্গ মাইল অত্যাশ্চর্য একটি কঙ্কাল উপকূল জাতীয় উদ্যান। এই জায়গাটি মূলত জল শক্তিশালী স্রোত, ঘন কুয়াশা এবং অবিরাম গতির বিশ্বাসঘাতক বালির তীরগুলির জন্য বিখ্যাত। এই ভয়ঙ্কর জলবায়ু পরিস্থিতি এবং শক্তিশালী বালির ঝড় এক হয়ে যায় তখন এক হাজারেরও বেশি জাহাজ ডুবে যাওয়ার ক্ষমতা তৈরি হয়। সেখানে এখনও অনেক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ, একত্রে বৃহৎ জলজস্তন্যপায়ী প্রাণীর কঙ্কাল সমুদ্র সৈকতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত।
নরকের সৈকত
আফ্রিকা মহাদেশের উষ্ণ স্রোতের সাথে ঠান্ডা আটলান্টিক স্রোত মিলিত হওয়ার কারণে এই জনশূন্য উপকূল অঞ্চলটি হুমকিস্বরূপ এবং প্রায় সময়ই বিশাল ঝড় দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। এজন্য এই অঞ্চলটিকে অভিজ্ঞ পর্তুগিজ নেভিগেটররা ‘নরকের সৈকত’ বলে অভিহিত করেছেন।
৫. ডোর টু হেল, তুর্কমেনিস্তান (Darvaza gas crater)
তুর্কমেনিস্তানের ড্রাভা শহরে রয়েছে একটি জ্বলন্ত গর্ত। যার নাম হলো, ‘ডোর টু হেল’ যাকে বাংলায় বলা যায় নরকের দরজা। নামটা শুনতেই অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর লাগে। প্রায় ৭০ মিটার ব্যাস এবং ৩০ মিটার গভীর এই গর্ত কয়েক দশক ধরেই জ্বলছে। রাতের বেলা এই নরকের দরজাটি দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। তবে এই স্থানের উত্তাপ এত বেশি যে, কেউই সেখানে ৫ মিনিটের বেশি থাকতেই পারে না।
গর্তের উৎপত্তি
তুর্কমেনিস্তানের ড্রাভা শহরের এই গর্তটি কোনো প্রাকৃতিক গর্ত নয়। ১৯৭১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রাকৃতিক গ্যাসসমৃদ্ধ দারউয়িজি এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান করেন। তখন সেই অনুসন্ধানের সময় অনুসন্ধানকারীরা গ্যাসবহুল গুহার মধ্যে মৃদু স্পর্শ করলেই সেখানে দুর্ঘটনাক্রমে মাটি ধসে পুরো ড্রিলিং রিগসহ পড়ে যায়।
গর্তের আগুন
পরিবেশে বিষাক্ত গ্যাস প্রতিরোধ করার জন্য ভূতত্ত্ববিদরা তখন সেই গ্যাস উদ্গিরণ মুখটি জ্বালিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। গবেষকদের ধারণা ছিলো এই বিষাক্ত গ্যাস অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে এবং আগুন নিভে যাবে। কিন্তু গবেষকদের অবাক করে দিয়ে এখন পর্যন্ত সেখানে আগুন জ্বলছে।
তথ্যবহুল টেবিল
স্থান | অবস্থান | বৈশিষ্ট্য | বিপদ |
---|---|---|---|
অয়মিয়াকন | সাইবেরিয়া | পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল শহর | তাপমাত্রা -৭২ ডিগ্রী |
স্নেক আইল্যান্ড | ব্রাজিল | প্রতি বর্গমিটারে ৫টি বিষধর সাপ | গোল্ডেন ল্যান্সহেড সাপ |
নেট্রন লেক | তানজানিয়া | পশু পাখি পাথর হয়ে যায় | সোডিয়াম কার্বনেট ও সোডা |
কঙ্কাল উপকূল | নামিবিয়া | বিপুল সংখ্যক তিমির কঙ্কাল | শক্তিশালী স্রোত ও ঝড় |
ডোর টু হেল | তুর্কমেনিস্তান | জ্বলন্ত গর্ত | বিষাক্ত গ্যাস ও তাপ |
উপসংহার
বিশ্বের এই ভয়ঙ্কর স্থানগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বিপদের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। প্রতিটি স্থানই তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং বিপদের কারণে পরিচিত। অয়মিয়াকনের শীতলতা, স্নেক আইল্যান্ডের বিষধর সাপ, নেট্রন লেকের পাথর হয়ে যাওয়া প্রাণী, কঙ্কাল উপকূলের তিমির কঙ্কাল এবং ডোর টু হেলের জ্বলন্ত গর্ত – সবই আমাদের প্রকৃতির অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর দিকগুলোকে তুলে ধরে। এই স্থানগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতির সৌন্দর্যের পাশাপাশি তার বিপদও রয়েছে, যা আমাদের সতর্ক থাকতে শেখায়।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.