ছোটগল্প

শেষ পুনরাবৃত্তি – একটি বাস্তব রহস্য গল্প

অন্ধ নায়কের নাটক দেখতে গিয়ে স্বামীর রহস্যময় অনুপস্থিতি এবং স্বপ্নের জালে একাকীত্বের বাস্তবতা।

- Advertisement -

প্রথম রহস্য: রবীন্দ্রসদনে একটি নাটক দেখতে গিয়ে স্বামী দীপংকর রহস্যময়ভাবে অদৃশ্য হয়ে যান। শ্যামলী তাকে খুঁজে বেড়ান কিন্তু খুঁজে পান না। অবশেষে ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারেন সবকিছুই স্বপ্ন ছিল।

দ্বিতীয় রহস্য: একটি গহনার দোকানে দীপংকর আবারো রহস্যময়ভাবে অদৃশ্য হয়ে যান। শ্যামলী তাকে ফোন করেন কিন্তু তার আওয়াজ খুব ক্ষীণ শোনা যায়। শেষে ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারেন সবকিছুই স্বপ্ন ছিল।

বাস্তবতা: আট বছর আগে ‘হেপাটাইটিস-সি’ রোগে আক্রান্ত হয়ে দীপংকর মারা যান। শ্যামলী এখন একা, তার দুই ছেলে দূরে থাকে।

রবীন্দ্রসদনে চমৎকার একটি নাটকের শো হচ্ছে। দু’খানি টিকিট নিয়ে এলো দীপংকর। শ্যামলীর হাতে দিয়ে বলে, “তুমি চলে যেও, আমি পরে জয়েন করবো।”

 

- Advertisement -

এমনটি প্রায়শঃ হয়। শ্যামলী আগে চলে যায়, দীপংকর পরে অফিস থেকে যায়। আজকের শো বাংলাদেশ এর একটি নামকরা শো, কলকাতায় বেশ ক’দিন ধরে চলছে।

 

প্রথম রহস্য

 

রবীন্দ্রসদনে শ্যামলী ঠিকঠাক নিজের সীটে বসলো। কিন্তু এ কি! তার দু’পাশের সিট তো ভর্তি! তাহলে দীপংকর কোথায় বসবে? ওর সীট কোথায় পড়লো? আলাদা জায়গায় কি?

- Advertisement -

 

ভাবতে ভাবতেই আলো নিভে গেলো। ঘোষণা শোনা গেলো- “নমস্কার, শো শুরু হচ্ছে। আপনাদের কাছে বিনীত নিবেদন, শো চলাকালীন কেউ দয়া করে কোন কথা বলবেন না আর বাইরে যাবেন না। সময় সীমা একঘন্টা সাতাশ মিনিট। শুভসন্ধ্যা ও স্বাগত।”

 

নাটক আরম্ভ হলো। একটি অন্ধ ছেলের কাহিনী বোঝা যাচ্ছে। চমৎকারভাবে কাহিনি এগোচ্ছ। দর্শকরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছে। অন্ধ নায়ক এতো ভাল অভিনয় করছে! হলভর্তি দর্শক, কিন্তু ছুঁচ পড়লে শোনা যাবে।

 

- Advertisement -

শ্যামলীও একাগ্র হয়ে দেখছে। কিন্তু মনে মনে তার একনাগারে চিন্তা হয়ে চলেছে দীপংকর কোথায় রয়েছে! ও কখন পৌঁছলো! এসেছে তো? ওঠা তো যাবে না! একরাশ মুগ্ধতা ও একরাশ চিন্তা সহ – তার মনটা দ্বিধায় দুলতে লাগলো।

 

হাততালির মধ্যে শো শেষ হলো। পর্দা পড়লো আবার উঠলো। পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রীরা এসে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ালেন ও দর্শকের অভিনন্দন গ্রহণ করলেন। দর্শক অতি তৃপ্ত হয়ে বাইরে বেরোলেন।

 

শ্যামলীও দু’পাশ দেখতে দেখতে প্রধান গেইটে দাঁড়ালো, উঁহু! দীপংকর কোথাও নেই। রাত হয়ে যাচ্ছে, লাস্ট মেট্রোর ছাড়বার সময় হয়ে যাচ্ছে! কিংকর্তব্যবিমূঢ় শ্যামলী গুটি গুটি রবীন্দ্রসদন মেট্রো স্টেশনে এলো। বার বার পিছনে ফিরেও দেখা গেল না, কোথাও নেই তার বর!

- Advertisement -

 

ভেতরের দিকে পাবলিক বুথ দেখে মনে হলো একটা ফোন করবে কি? কিন্তু দীপংকরের মোবাইলের পাঁচটি সংখ্যা মনে পড়ছে, বাকি পাঁচটি তো মনে পড়ছে না! কি করে সে?

 

কিছু ভেবে না পেয়ে ধরধর করে এসে যাওয়া ট্রেনে সে উঠে পড়ে মনে ভীষণ চিন্তা নিয়ে।

 

- Advertisement -

তারা থাকে লেকটাউন, কালিন্দি। শেষ স্টপ দমদম না নেমে পূর্ববর্তী স্টেশন বেলগাছিয়ায় নামে, সুবিধা ওখান থেকে বাড়ী পৌঁছতে।

 

বেলগাছিয়ায় নেমেও এদিক ওদিক কোথাও দেখলো না দীপংকরকে। সেই জন সমুদ্রে কিভাবে বা দেখবে?

 

কালিন্দিতে অটো থেকে নেমে দেখলো…. নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলো, দীপংকর দাঁড়িয়ে রয়েছে।

 

দেখা মাত্র স্বাভাবিকতায় কথা কাটাকাটি হলো খানিকটা। পরে দীপংকর বললো, “এবার তোমায় একটা মোবাইল কিনে দিতে হবে!”

 

যাক। প্রথম রহস্য জমতে জমতে জমাট বাঁধলো না।

 

দ্বিতীয় ও ফাইনাল রহস্য

 

আজ আবার দুজনে বাইরে বেরিয়েছে। ছেলেরা কলেজে। তারা যে যার সময় মতো বাড়ী ফিরে খেয়ে নেবে খ’ন। তাদের ঠাকুমা ও কাজের সহকর্মী আছেন। দুজনে মিলে দক্ষিণাপন গেছে একটি গহণা পছন্দ করতে। তাদের এক বন্ধুর বোনের বিয়ে। উপহার দেবে। পছন্দ হচ্ছে না তেমন। দীপংকর বলে, “তুমি দেখো, আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।”

 

শ্যামলী আরও দু’চারখানা দেখলো, একটা পছন্দ হলো- সরু ডিজাইনের একটি কংগন-বেশ রুচিসম্মত- দামটাও সাধ্যের ভেতর। কিন্তু কি হলো!- দীপংকর এখনো এলো না! এতো দেরী কেন? বার বার দেখছে সে দোকানের বাইরের দিকে। নাঃ! দেখা যাচ্ছে না। শ্যামলী দোকানদারকে বলে, “উনি তো এলেন না এখনো, আমি একটু দেখি, এই কংগন আলাদা করে রাখুন, ওটাই নেবো।”

 

“হ্যা, হ্যাঁ, চিন্তা নেই, আলাদা রাখছি।”

 

শ্যামলী বাইরে এলো। চারিদিক দেখতে লাগলো। কী হলো কি? মানুষটা গেল কোথায়! সে এ পাশ ও পাশ চাইতে চাইতে এগোতে লাগলো। নাঃ! কোথাও নেই। আচ্ছা মুশকিল তো! এবারে কি করে সে! চিন্তায় পড়লো। কোথায় খুঁজবে এই ভীড়ে! একটু পরে দেখে এক ওয়াশরুম, ওখানে যাবে বলে তো বেরোলো! দূর থেকে ‘জেন্টস’ এর দিকে নজর রাখলো, পেট, টেট খারাপ হলো? তাই এতো দেরী! কিন্তুু এতো দেরী!

 

হঠাৎ তার খেয়াল হলো, আরে! তার ব্যাগে তো মোবাইল আছে! সেটা বের করে দীপংকরের নঃ মেলালো। না, এখন তার নঃ ভালোই মনে থাকে, অনেক দিন ব্যবহার করছে তো! ওদিকে রিং হচ্ছে। রিং হয়ে বন্ধও হয়ে গেলো। কেউ ধরলো না, কেন? কি ব্যাপার? আবার করলো রিং। আবার বন্ধ হয়ে গেলো। কি করে সে এখন!

 

বাড়ীতে বড়ো ছেলেকে ফোন করে, সে ধরে বলে, “হ্যাঁ মা বলো, হলো তোমাদের কেনাকাটা?”

 

“না রে দোকানে ঢুকে জিনিষ পছন্দ করতে করতেই তোর বাবা ওয়াশরুমে গেলো তারপর এখনো এল না আমি তো দাঁড়িয়ে আছি!”

 

“সে কি মা, কত ক্ষণ গেছে?”

 

“ও রে অনেক ক্ষণ হয়ে গেছে, আমি যে এখন কি করি!”

 

“আর একটু দেখো মা। চিন্তা করো না, চলে আসবে বাবা।”

 

শ্যামলী উদভ্রান্তের মতো ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রাস্তায় অতো লোকজন, লাইট, বাস, ট্রাম, ট্যাক্সির আওয়াজ- এর মাঝে কোথায় চলে গেলো মানুষটা!

 

ভাবতে লাগলো কি করা উচিত, কি করবে? বাড়ী ফিরে যাবে? না আবার সেই গহণার দোকানে ফিরবে! না, ওখানে যাবার আগে আর একবার ফোন করে দেখা উচিত।

 

আচ্ছা! ফোন করার কথা সে-ই শুধু ভাবছে কেন? দীপংকরের কি একটা ফোন আসা উচিত ছিল না? তার কি একবারও মনে হচ্ছে না তাকে এতোটা সময় একলা রেখে একটা ফোন করে খবর নেওয়া দরকার!

 

ফোনে আবার সে নঃ, এবার মেলালো এবার রিং হচ্ছে- সে শুনলো, “হ্যালো……”

 

জবাবে হ্যালো বলবে কিন্তু দীপংকরের আওয়াজ অনেক ক্ষীণ শোনালো যেন অনেক দুর থেকে আওয়াজ…..কেন? দীপংকর কি অসুস্থ বোধ করছে? হঠাৎ শুনলো বহু দুর থেকে যেন দীপংকরের আওয়াজ এল- “শ্যামলী- ই- ই- ই- ই……”

 

সে ধড়ফড় করে উঠে বসে। কি হলো! বুঝতে পারে না কোথায়! চারিদিকটা দেখে! এটা তার শোবার ঘর, তার বিছানা, সে উঠে বসেছে শোয়া থেকে! বাইরে ভোরের আলো ফুটি ফুটি করছে! সে কি সারাটা রাত দীপংকরকে খুঁজে বেড়ালো!

 

আট বছর হলো দীপংকর চলে গেছে। পৃথিবী ছেড়ে, তাকে ছেড়ে। তার ‘হেপাটাইটিস-সি’ হয়েছিলো। সিরিয়াস অবস্থায় ‘এস এস কে এম’ (পিজি) হসপিটালে ২৮ দিন এডমিট থেকে বাড়ীতে এসে আবার ভর্তি হতে হয়েছিলো তাকে, সেখানে এবং মৃত্যু।

 

এখন সে একা। যে ছেলেকে ফোন করেছিলো সে এই সময়ে চিন্নাইয়ে এমবিএ পাঠরত। ছোট ছেলে ব্যাঙ্গালোরে গ্র‍্যাজুয়েশন। শাশুড়ি মা মারা গেছেন।

- Advertisement -
- Advertisement -

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- Advertisement -
Back to top button