ফেরদৌসী: ইরানের জাতীয় কবি এবং শাহনামার রচয়িতা

অন্যান্য কবি-মনীষীর মতো ফেরদৌসীর জন্মসাল নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ‘পারস্য প্রতিভা’র রচয়িতা মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর রচনা অনুসারে ফেরদৌসী ৯৩৭ সালে পারস্যের তুস নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম মোহাম্মদ আবুল কাসেম। তাঁর পিতা মোহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে শরফ শাহ ছিলেন তুস নগরের রাজকীয় উদ্যানের তত্ত্বাবধায়ক।

ফেরদৌসীর শিক্ষা-জীবন

আবুল কাসেমের প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর পিতার হাতেই শুরু হয় এবং পিতার নিকট তিনি আরবি ভাষা উত্তমরূপে আয়ত্ত করেন। কিন্তু মাতৃভাষা ফার্সিতেই তাঁর দখল জন্মে বেশি। এছাড়া তৎকালীন শিক্ষার ধারা অনুযায়ী তফসির, হাদিস, ফিকাহ্, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি বিষয়েও তিনি প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন।

যৌবনে আবুল কাসেম তুস নগরের রাজকীয় উদ্যানের পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্রনদী রুকনাবাদের তীরে বসে কবিতা রচনা করতেন। তাঁর মেধা ছিল প্রখর এবং স্মৃতিশক্তি ছিল বিস্ময়কর। ইরানি পুরাতত্ত্বে ও লোককাহিনীতে আবুল কাসেমের ঝোঁক ছিল অত্যন্ত বেশি।

সৌভাগ্যক্রমে আবুল কাসেম প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ ও কবি আবু মনসুর আল-মারী (দাকিকি) সংকলিত ‘রাজবংশ চরিতমালা’ নামক পুরাতত্ত্ববিষয়ক প্রামাণ্য গ্রন্থের সঙ্গে পরিচিত হন। এতে করে ইরানি পুরাকাহিনীর প্রতি তাঁর আকর্ষণ দুর্নিবার হয়ে ওঠে। এ সময় তাঁর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি এবং বহু লোকগাথা ও গীতিকবিতা রচনা করে তিনি সুধীসমাজে রীতিমত প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন।

শাহনামা’র প্রথম সংস্করণ ও ইরানি সুধীসমাজ

আবুল কাসেম ‘রাজবংশ চরিতমালা’ গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে ৯৮০ সালে ইরানের জাতীয় মহাকাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রায় বিশ বছর দুরূহ সাধনা করে তিনি ৯৯৯ সালে তাঁর অমর অবদান ‘শাহনামা’র প্রথম সংস্করণ সমাপ্ত করেন। কাব্যখানি ইরানি সুধীসমাজকে মুগ্ধ করে এবং সাধারণ জনগণেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কেননা, এতে তিনি ইরানিদের জাগরণের জয়গান গেয়েছেন।

সুলতান মাহমুদ ও ফেরদৌসী

সুলতান মাহমুদ তখন গজনীর সিংহাসনে সমাসীন। সে আমলের বিখ্যাত কবি, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিকের আগমনে তাঁর দরবার অলংকৃত। লোকমুখে কবি আবুল কাসেম গজনীর সুলতান মাহমুদের বিদ্যোৎসাহিতা ও গুণগ্রাহিতার কথা শ্রবণ করে তাঁর দরবারে স্থানলাভ করতে অভিলাষী হোন। সুলতান মাহমুদের উজীর হাসান মৈমন্দীর সহায়তায় কবি আবুল কাসেম সুলতান মাহমুদের দরবারে হাজির হন। অতঃপর কবি উপস্হিত বুদ্ধি দ্বারা কয়েকটি শ্লোক রচনা করে সভাস্থলে সুলতানের সংবর্ধনা করেন।

তার মধ্যে একটি ছত্র এই হলো,

শিশু মাতৃস্তন্যে রসনা করে,

প্রথমে যে শব্দটি উচ্চারণ করে তা

‘মাহমুদ’।

কবি ফেরদৌসীর সাথে সুলতান মাহমুদের গভীর সম্পর্ক

কবির আবৃত্তিতে সারা দরবার চমৎকৃত হয়। সুলতান মাহমুদ তখন মুগ্ধপ্রাণে কবিকে অভিনন্দন জানান, “হে ফেরদৌসী, তুমি সত্যই আমার দরবারকে বেহেশতে পরিণত করে দিলে।” তুস নগরের কবি তখন থেকে বিশ্বের দরবারে ফেরদৌসী পরিচয়ে ধন্য হলেন।

এরপর থেকে কবি ফেরদৌসী সুলতান মাহমুদের অনুগ্রহ-ছায়ায় গজনীতে বাস করতে থাকেন। এদিকে বিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল ‘শাহনামা’ রচনা করে কবি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি।

ইতোমধ্যে সুলতান মাহমুদ কবিকে ‘শাহনামা’ রচনার কাজ শেষ করতে অনুরোধ জানান এবং প্রতিটি শ্লোকের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর কবি ফেরদৌসী কাব্যখানার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে আরম্ভ করেন এবং এতে আরও নতুন নতুন বিষয় সংযোজিত করেন।

এভাবে ক্রমাগত আরও দশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর শাহনামা রচনার কাজ শেষ হয়। কবি কৃতজ্ঞচিত্তে সুলতান মাহমুদকে ইরানের জাতীয় মহাকাব্য ‘শাহনামা’র পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ উৎসর্গ করেন।

কবি ফেরদৌসীর সাথে সুলতান মাহমুদের গভীর সম্পর্ক এবং রাজদরবারে তাঁর শ্রেষ্ঠ আসন দেখে রাজসভার অন্যান্য কবি ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন। তাঁরা কবিকে রাজদরবার থেকে বের করে দেয়ার জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ষড়যন্ত্রকারীদের কুমন্ত্রণা শুনে সুলতান মাহমুদ শাহনামা রচনার জন্য তাঁর প্রতিশ্রুত ষাট হাজার স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে ষাট হাজার রৌপ্যমুদ্রা কবিকে প্রদান করেন।

কবি ফেরদৌসী সুলতানের প্রতিশ্রুত ষাট হাজার স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে ক্রোধে, ক্ষোভে ও দুঃখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন এবং সুলতানের দেয় অর্থ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। অবশেষে কবি সুলতানের দেয় সমুদয় অর্থ ভৃত্য, স্নানাগারের রক্ষক ও নিকটস্থ গরীব লোকদের মধ্যে ভাগ করে দেন।

এতে করে সুলতান মাহমুদ কবির প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠেন এবং তার ফলে অশীতিপর বৃদ্ধ কবিকে প্রাণভয়ে গজনীর দরবার ত্যাগ করে অন্যত্র পলায়ন করতে হয়।

সুলতান মাহমুদের এই অপ্রত্যাশিত কৃপণতায় ব্যথিত হয়ে কবি ফেরদৌসী যে বিদ্রূপাত্মক কবিতা রচনা করেন, কবি নিজামীর মতে তার মাত্র ছয়টি বয়াত অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বাকি অংশ যা প্রচলিত তা প্রক্ষিপ্ত। কবিতাটির কয়েকটি ছত্র ছিল এরকম,

রাজবংশে যদি হ’ত জনম তোমার

বরষিতে স্বর্ণমুদ্রা মুকুট সোনার।

উচ্চমান নাহি যার বংশের ভিতর

কেমনে সহিবে সেই মানীর আদর?

তিক্তবীজ হতে যেই তরুর জনন,

নন্দন কাননে তারে করহ রোপণ

সিঞ্চন করহ মূলে মন্দাকিনী ধারা,

মধু আর দুগ্ধে ভর খাদ্যের পশরা –

তথাপি ফলিবে তার আপন স্বভাব,

সতত সে তিক্ত ফল করিবে প্রসব।

কবি ফেরদৌসী ও ইউসুফ জোলায়খা কাব্য

গজনী ত্যাগ করে কবি ফেরদৌসী পারস্যের সিরাজ নগরে জনৈক বুয়াইদ সুলতানের আশ্রয়লাভ করেন। নতুন পৃষ্ঠপোষকের মনস্তুষ্টির জন্য তিনি ‘ইউসুফ জোলায়খা’ নামক আঠারো হাজার পদবিশিষ্ট আরও একটি কাব্য রচনা করেন। অতঃপর তিনি সিরাজ নগরীর ত্যাগ করে জন্মভূমি তুসে গমন করেন এবং সেখানেই জীবনের বাকী দিনগুলো শান্তিতে নির্বাহ করেন।

কবি ফেরদৌসীর গজনী ত্যাগের কিছুকাল পর সুলতান মাহমুদ অনুধাবন করতে পারেন যে, কবির প্রতি তিনি ন্যায়বিচার করেন নি বরং ষড়যন্ত্রকারীদের কুপরামর্শে তিনি কবির প্রতি অন্যায় আচরণ করেছেন। সুতরাং নিজের ভুল বুঝতে পেরে সুলতান মাহমুদ কবির প্রতি  সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শনস্বরূপ কবির প্রাপ্য সমুদয় স্বর্ণমুদ্রাসহ কবির জন্মভূমি ইরানের তুস নগরীতে দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু স্বর্ণমুদ্রাসহ দূত কবিগৃহে পৌঁছার পূর্বেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

তুস নগরীতে অবস্থানকালেই ১০২০ সালে কবি ফেরদৌসী পরলোকগমন করেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী কালের অনন্ত স্রোতে মিশে যাচ্ছে, কিন্তু আজও দেশ-বিদেশের। সুধীবৃন্দ ইরানের এই অমর কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে তাঁর সমাধিপার্শ্বে সমবেত হন।

প্রাচীন মহাকাব্যসমূহের মধ্যে শাহনামা’র অমরত্ব

প্রাচীন মহাকাব্যসমূহের মধ্যে বাল্মিকীর রামায়ণ, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মহাভারত এবং গ্রিক কবি হোমারের ইলিয়ড ও অডিসি বিশ্বসাহিত্যে অমর। ফেরদৌসী রচিত শাহনামাও উল্লিখিত প্রাচীন মহাকাব্যগুলোর মতো বিশ্বসাহিত্যে অমরতা লাভ করেছে।

শাহনামায় প্রাগৈতিহাসিক যুগ হতে আরম্ভ করে আরবদের পারস্য বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ ৬৩৪ সালের আগ পর্যন্ত পারস্যের গৌরবময় পুরাবৃত্ত বর্ণিত হয়েছে। প্রাচীন লোকগাথা, গল্প, উপাখ্যান, কিংবদন্তী, ইতিহাস ও ধর্মগ্রন্হসমূহ হতে এর মাল-মশলা সংগৃহীত হয়েছে।

শাহনামার ঘটনাবলীর বিস্তৃতিকাল প্রায় তিন হাজার নয়শো বছর এবং ঊনচল্লিশটি রাজবংশের শাসনকালের বিবরণী এটি। এই সুদীর্ঘ সময়কাল দুটি স্তবকে বিভক্ত। প্রথম তিন হাজার বছরের কাহিনী নিছক উপাখ্যানভিত্তিক। পরবর্তী নয়শো বছরের ঘটনাবলী ইতিহাসের সাথে বিজড়িত।

শাহনামা সাতটি বৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত এবং ইহা ষাট হাজার শ্লোকে সমাপ্ত। ইহা অবিমিশ্র ফারসি ভাষায় রচিত। এতে আরবি শব্দ কদাচিৎ দেখতে পাওয়া যায়। হাজার বছর আগে রচিত ফেরদৌসীর শাহনামা বিশ্বসাহিত্যে এক অমর সৃষ্টি।

জাতীয় মহাকাব্য রচনার জগতে ফেরদৌসী সর্বকনিষ্ঠ হলেও সর্বাধুনিক। শাহনামায় ইরানের প্রাচীন রাজবংশগুলোর যে ধারাবাহিক বিবরণ কাব্যাকারে গ্রথিত হয়েছে তার অধিকাংশই যুদ্ধ-সংক্রান্ত। দিগ্বিজয় ও দর্প ছিল সেকালের নৃপতিদের একমাত্র কাম্য।

ইরানের রাজবংশ ও মহাবীর রুস্তম

ইরানের রাজবংশগুলোও এর ব্যতিক্রম ছিল না। শাহনামায় প্রাচীন ইরানের কায়কাউস বংশের গৌরবময় ইতিহাসের পাশাপাশি চলেছে ইরানের এক পালোয়ান গোষ্ঠীর কাহিনী, যাঁদের ভেতর সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন মহাবীর রুস্তম। রুস্তমের পিতার নাম জাল। জালের পিতা শাম; শামের পিতা নূর-ইমান।

এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ যুগে অপ্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধা ছিলেন। এদেরই বাহুবল ও বিশ্বস্ততার ওপর নির্ভর করতো ইরানের সিংহাসনের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব। শাহনামায় এদের প্রত্যেকের বীরত্বের বহু রোমাঞ্চকর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

বিশেষ করে শাহনামার এক বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে মহাবীর রুস্তম ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তুর্কীবীর ইসপিন্দিয়ারের বিস্ময়কর বীরত্ব-কাহিনী।

শাহনামায় যুদ্ধ-সংক্রান্ত বিবরণের পাশাপাশি মানব-মানবীর চরিত্র বিশ্লেষণ

শাহনামায় যুদ্ধ-সংক্রান্ত বিবরণের সাথে সাথে বর্ণিত হয়েছে মানব-মানবীর বিচিত্র কামনা-বাসনা, আনন্দ-বেদনা আর অশ্রুধারার মর্মন্তুদ কাহিনী। যাঁরা প্রধান চরিত্রে তাঁরা যেমন শাহনামাতে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন, তেমনি যারা অপ্রধান, তাদের কর্মকাণ্ডেও মুখরিত হয়ে আছে এই কাব্য।

মূলত কবি ফেরদৌসী একটি জটিল বিষয়বস্তুকে বিশাল ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন। তাঁর কাব্যে বহু প্রথিতযশা মহাবীরের একত্র সমাবেশ ঘটেছে। কিন্তু তাঁদের একের সঙ্গে অন্যের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রত্যেকেই আপন আপন মহিমায় ও স্বকীয়তায় উজ্জ্বল।

শাহনামার নারী চরিত্রগুলোও মাধুর্যে ভরপুর এবং অতুলনীয়। কবি ফেরদৌসীর রচনাশৈলীতে অভিভূত হয়ে জনৈক সমালোচক বলেছেন, আদিরসে তিনি বিদ্যাপতি, বিরহ-বর্ণনায় তিনি ভারতচন্দ্র এবং করুণরসে তিনি বাল্মিকী।

সোহরাব ও রুস্তম চরিত্র

শাহনামা মহাকাব্যে সোহরাব ও রুস্তম চরিত্র বিশ্ববিশ্রুত। মহাযশস্বী রুস্তম কিরূপে যুদ্ধে তাঁর অজ্ঞাত-পরিচয় পুত্র মহাবীর সোহরাবকে হত্যা করেন, সেই হৃদয়বিদারক কাহিনী শাহনামা মহাকাব্যের হৃৎপিণ্ডস্বরূপ। শাহনামার এই বিয়োগান্ত ঘটনা অবলম্বনে পরবর্তীকালে ফারসি ও বাংলায় বহু খণ্ডকাব্য রচিত হয়েছে।

এমনকি বীর পিতার হাতে যোগ্য বীরপুত্র হত্যার বর্ণনাকবি ম্যাথু আর্নল্ডকে ১৮৫৩ সালে ইংরেজি ভাষায় ‘সোহরাব রুস্তম’ কবিতা লেখায় উদ্বুদ্ধ করেছে। বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রায় পঁয়ত্রিশটি ভাষায় শাহনামা অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে।

ইউরোপীয়ানদের মধ্যে ইংরেজি ভাষায় শাহনামার পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন অধ্যাপক রুবেন লেভী। এই অনূদিত গ্রন্হ লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। এই অনুবাদের মাধ্যমেই সমগ্র পাশ্চাত্য জগতে ফেরদৌসীর শাহনামা পরিচিতি লাভ করে।

বাংলা ভাষায় শাহনামার পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন বিশিষ্ট অনুবাদক ও লেখক মনিরউদ্দীন ইউসুফ। ১৯৯১ সালে বাংলা একাডেমি থেকে এই অনুবাদ ছয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ সতেরো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে নিবিষ্ট সাধনায় তিনি ফেরদৌসী ও তাঁর শাহনামাকে বাঙালির মানস-হৃদয়ে নিত্যপিপাসু করে তোলেন।

মূলত কবি মনির উদ্দীন ইউসুফের এই অনুবাদের মাধ্যমেই বাঙালি পাঠক সমাজ লাভ করে বিশ্বসাহিত্যের অমর মহাকাব্য শাহনামার আস্বাদন।

প্রাচ্যের হোমার ফেরদৌসী

শাহনামা মহাকাব্য হলেও এতে ফারসি সাহিত্যের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী নীতিমালা ও দার্শনিক তত্ত্ব বিদ্যমান। এজন্য ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ একবাক্যে ফেরদৌসীকে ‘প্রাচ্যের হোমার’ নামে অভিহিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষেই ‘এপিক’ বা মহাকাব্য রচনার দিক দিয়ে ভারতীয় রামায়ণ ও মহাভারত ব্যতীত প্রাচ্যজগতের আর কোনো কাব্যই শাহনামার সঙ্গে তুলনীয় নয়।

মূলত, কাব্য-সুন্দরীর স্বর্ণঝাঁপি এ রকম উজার করে আর কোনো কবি দুনিয়ার লোককে নিঃশেষে পরিবেশন করেন নি।

কিন্তু এসবের ঊর্ধ্বে শাহনামার পৃথক পরিচয় আছে, বিশিষ্ট আবেদন আছে। শাহনামা পারস্যের পৌরাণিক ও লোকগাথার জ্ঞানভাণ্ডার। এর বর্ণনায় কালজয়ী ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, যার আবেদন কখনও শেষ হবে না।

মহাকবি ফেরদৌসী বলেন, দীর্ঘ ত্রিশ বছর সাধনা করে এ ফারসি কাব্যের মাধ্যমে আমি ইরানকে পুনরুজ্জীবিত করে গেলাম। অনেক অর্থময় বাণীর মণিমানণক্য দিয়ে শাহনামা রচনা করেছি আমি। ঐতিহাসিক খোদা বখশের ভাষায়, শাহনামা ইরানী জাতীয়তাবোধের বাইবেল, ইরানি গর্ব-গরিমার ধর্ম-সংগীত।

এর পাতায় পাতায় জ্বলে উঠেছে আরব-শাসনের বিরুদ্ধে ইরানিদের পুঞ্জীভূত বিদ্বেষ। তাই ইরানিরা শাহনামাকে নিজেদের জীবনবেদ হিসেবে মর্যাদা দেয়, যেমন ভারত উপমহাদেশীয় হিন্দুরা মর্যাদা দেয় রামায়ণ মহাভারতকে।

পরিশেষ

সুতরাং শাহনামা কেবলমাত্র প্রথম শ্রেণির মহাকাব্য নয়, ইহা ইরানি জতীয় ঐতিহ্যের তাজমহলসম জীবন্ত স্বাক্ষর। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, জাতীয়তার প্রেরণায় কবি ফেরদৌসী তাঁর লেখনীর মাধ্যমে যে ঝংকার তোলেন তা তাঁর দেশবাসীকে নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ করে।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a Reply

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading