জীবনী

লীলা মজুমদার: কল্পনার রসে ভরা জীব

লেখিকা, বক্তা, সাহিত্যিক, রসিক, রান্না বিশেষজ্ঞ - একাধিক পরিচয়ে পরিপূর্ণ ছিলেন তিনি

বিজ্ঞাপন

গৃহের ঘরণীরা যদি আপিসে বেরোন, তাহলে ঘরকন্না সমলাবে কে? উত্তর লীলা মজুমদারের, “কেন, পুরুষরা। তারাই শুনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দর্জি, রাঁধুনি, শিশু পালক বিশেষজ্ঞ! এতে তো মেয়েদের অপমানিত হবার কিছু নেই! গৃহবধু যদি সম্মানের আখ্যা হয়, ঘর জামাই কেন নয়!”

অফুরন্ত বলার ভাষা, অনবদ্য তাঁর অনুভব লীলা রায় (মজুমদার)। বিষয়বস্তু যাই হোক, গভীর কিংবা হালকা, তাত্ত্বিক বা সামাজিক, সবটা এমন অনাবিল কৌতুকদীপ্ত রসের মিশেল যে কখনও ভারী হয়ে ওঠেনা আবহাওয়া বা পরিবেশ! থাকে তা মজলিসী – চট করে আসর ছেড়ে ওঠা খুব মুস্কিল।

লীলা কখনও শুনিয়েছেন গুপ্তধনের কথা, কখনো ভুতের গল্প, কখনো কোন গুজব কথা, কখনো কি করে রোগা হওয়া যায়, তাঁর বিষয় কোনো সময় পুলিশ, কোনো সময় ডাক্তারি, আবার কখনো নারী মুক্তি, কখনো দেশ ভ্রমণ, কখনো ভাষা, কখনো ভালবাসা, কখনো বন্যা, কোন সময় শিলং, কোন সময় কলকাতা, কখনো সে কাল, কখনো একাল। তাঁর বিষয়বস্তু অজস্র।

লীলা মজুমদার এর জন্ম ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯০৮, কলকাতায় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গৃহে। সত্যজিৎ রায় তাঁর পিতা সুকুমার রায় তাঁর পিতা উপেন্দ্রকিশোর যথাক্রমে লীলা মজুমদার এর ভাইপো, জেঠতুতো ভাই (বড়দা) ও জ্যাঠামহাশয়।

লীলার পিতা প্রমদারঞ্জন রায় ছিলেন ভারতীয় জরিপ বিভাগের কর্মী। কাজের যোগ্যতা হিসেবে প্রথমে তিনি পান রায় সাহেব, পরে রায় বাহাদুর খেতাব। প্রমদারঞ্জনের বড় পরিচয়, তিনি ‘বনের খবর’ নামে এক অসামান্য গ্রন্থের প্রণেতা। ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় বেরুত, পরে বই হয়ে প্রকাশিত হয়।

বিজ্ঞাপন

লীলা মজুমদার এর শৈশব কাটে পিতার কর্মস্থল শিলং পাহাড়ে। পরবর্তী সময়ে ১৯২০ সালে চলে আসেন কলকাতায়, ভর্তি হন ডায়সেসন স্কুলে, পরে সেই কলেজে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলেন তিনি মেট্রিকে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান। ইন্টারমিডিয়েটে সকলের মধ্যে দ্বিতীয় বি.এ ও এম.এ. তে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম।

অধ্যাপনা কিছুকাল দার্জিলিং, কিছুকাল শান্তিনিকেতনে, কিছুকাল কলকাতার আশুতোষ কলেজে মেয়েদের বিভাগে। তারপর সারাটা জীবন সাহিত্য উপাসনা। মাঝে মাঝে বেতার বিভাগে প্রযোজক ছিলেন কিছুকাল। ছবি আঁকতেন, তালিমও নেন। কংগ্রেস অধিবেশন মেলায় ছবির প্রদর্শনীতে রৌপ্যপদক লাভ।

প্রথম গল্প ‘লক্ষ্মী ছেলে’ সুকুমার রায় সম্পাদিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকা নবরুপে বেরুনোর সময় প্রকাশিত। বহুবছর সহ-সম্পাদক ছিলেন, প্রায় ২৫ বছর সন্দেশ পত্রিকায়। ছোটদের প্রথম বই ‘বদ্যিনাথের বাড়ী’। বড়দের প্রথম বই ‘শ্রীমতী’।

তাঁর অসংখ্য বই – পাকদন্ডী, আর কোনোখানে, আমিও তাই, আমি নারী, খেরোর খাতা, ঠাকুমার ঠিকুজি, রান্নার বই, ঘর কন্নার বই বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

বহু পুরস্কারে সম্মানিত – রবীন্দ্র পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, লীলা পুরস্কার, ভারতীয় শিশু সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপন

তাঁর কলম যেন কৌতুক বিদ্যুতে ঝলসে উঠতো। কল্পনাকে তা হার মানায় তাঁর ‘খেরোর খাতা’র অনবদ্য রম্যরচনার সংকলন টিতে মনে হয় এক আড্ডা। তিনি বলে যাচ্ছেন, আমরা শুনে যাচ্ছি। খাওয়া দাওয়া আর ঘড়ির কাঁটা ভুলিয়ে তাঁর বর্ণনা – ভূত, ডাক্তার, মেয়ে চাকুরে, পাড়াপড়সী, ছেলে মানুষ করা, ম্যাজিক, দজ্জাল মেয়ে, কুকুর, সাপ, চোর, ধাপ্পাবাজ, নেশাখোর, কোন বিষয় নেই!

কখনো শান্তিনিকেতনের স্মৃতি, কখনো বোলপুরের উপজীব্য, কখনো লেখকদের খোশগল্প। ব্রাহ্মসমাজ ভুক্ত লীলার বিয়ে হয়েছিলো হিন্দু পাত্রের সঙ্গে তাঁর পিতার মতের বিপক্ষে। লীলা মজুমদার এর নিজের কথায়,

সে এক বিয়ে বটে! কনের বয়স প্রায় পঁচিশ, বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়া লোকের কথায়, দেখায় আঠারো, উনিশ, রোগা, শ্যামা, মাথা ভরা লম্বা চুল দেখতে খারাপ নয় কিন্তু কোনো মতেই রুপসী নয় আর পাত্র ছত্রিশ বছর বয়সের দেখায় ছেচল্লিশ কারণ কুড়ির আগেই চুলে পাক ধরেছিলো, সদ্য আমেরিকা ফেরত, সুদর্শন, ছ’ফুট লম্বা, সংস্কৃত জানা, সাহিত্যসঙ্গীত রসিক দাঁতের ডাক্তার।

আমার আশুতোষ কলেজের ছাত্রীরা বললো, লীলাদির বাবা কি নিষ্ঠুর, এই বুড়ো বরের গলায় তাঁকে ঝুলিয়ে দিলেন! আহা! তারা কি করে জানবে লীলাদির মনের কথা! কত আবেগপূর্ন আর ভালোবাসার বিয়ে এ!

কিন্তু পিতার সঙ্গে তো সম্পর্ক একেবারে শেষ। প্রমদারঞ্জন যতদিন বেঁচে ছিলেন, কন্যার সাথে বাক্য বিনিময় করেননি। লেখক লীলা মজুমদার প্রথমত শিশু সাহিত্যিক রুপে বিখ্যাত হয়েছিলেন পরবর্তীকালে সাবালকদের জন্য কলম ব্যবহার। শিশুদের জন্য বই লিখলেই শিশুসাহিত্যিক পদবাচ্য হওয়া যায় না। ব্যাপরটা গভীর।

বিজ্ঞাপন

উপেন্দ্রকিশোর এর রচনায় আছে বিশ্ব প্রকৃতির রস গ্রহণ করে বৃহৎ হয়ে ওঠা। বইতে কোন শিক্ষা প্রদান হচ্ছে এমন প্রকাশ হয় নি। তাঁর পুত্র সুকুমার রায় (লীলার জেঠতুতো বড় ভাই, ‘বড়দা’ – মাত্র ৩৬ বছর বয়সে) আর পরে সুকুমার পুত্র সত্যজিৎ রায় – এই তিনজন মানুষ বাংলা শিশুসাহিত্যর জন্য করা কাজ অবধান যোগ্য। লেখিকা লীলা অনুধাবন করেছিলেন এই চলার পথটি তাঁর নিজেরও চলার পথ। যদিও এর আগের তিনি বহু রচনা করেছেন কচি কাঁচাদের জন্য।

তাঁর চেয়ে তেরো বছরের কনিষ্ঠ ভাইপো সত্যজিৎ বাংলা সাহিত্য কে যে মৌলিক, অভিনব, চমকময়, অতিশয় উত্তেজনাময় কাহিনী তলায় তলায় সরসতার নদী বইয়ে দিইয়েছিলেন তা ইতিহাস স্বরুপ হয়ে থাকবে অনন্তকাল। মাণিকের পাঠকরা ১৮ বছরের, তাতে ভাষা কখনো ক্ষুন্ন মনে হয় নি অভিভাবকদের কাছে।

লীলা মজুমদার কে-ও বহুকাল সাবালক গল্প রচনার অবকাশে ছোটদের লেখা জন্যর সময় স্বল্পতা বেদনায় ভুগিয়েছে। এক ব্যপ্তি পরিচয় তাঁর ‘রান্নার বই’ ও ‘ঘরকন্নার বই’ রচনা। অভূতপুর্ব! তাঁর বিদগ্ধ প্রকাশকরাও তাঁকে বলে গেছেন –

আপনার মধ্যে কি সম্পদ আছে, আপনি জানেন না। সব উজাড় করে দিন। লীলা মজুমদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে পুজো করার সঙ্গে বলেছেন একটি চীনে প্রবাদ –


“Keep a green bough in your heart and the singing bird will come.”

বিজ্ঞাপন

(নিভৃতি হৃদয়ে একটি সবুজ গাছের ডাল পুতে দাও, গানের পাখী নিজেই আসবে)

লীলা বলেছেন তাঁর ‘ঠাকমার ঠিকুজিতে – ৮২’ বছর বয়স হলো। সব কথা কেমন গুলিয়ে যায়, যা ঘটেছিলো বা ঘটতেও পারতো, আর যা ঘটলে আমি খুব খুশী হতাম মাঝে মাঝে তার তফাৎ করতে পারিনা। ৮২ বছরে পাথেয় নয়, ভারাক্রান্ত হওয়া নয়, ডাক এলেই খালি হাতে চলে যাবো।

লীলা মজুমদার ৫ এপ্রিল ২০০৭ সালে দেহাবসান করেছিলেন।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading