জীবনী

মোহনদাস ও সরলা: এক অসমাপ্ত প্রেমের গল্প

ছেচল্লিশ বছর পর ফিরে এসে দেশে, স্মৃতিচারণে মোহনদাস

বিজ্ঞাপন

মোহনদাস – এক ছেচল্লিশ বছরের যুবক, বোম্বের এস.এস.আরাভিয়া জাহাজ থেকে নেমে এলো। বোম্বাইয়ের ভীড়বহুল বন্দরে, পিছনে অবগুণ্ঠন বতী স্ত্রী। জাহাজ ঘাটায় নেমে সে একেবারে ফুলের মালায় ঢেকে গেলো সে এই ভালোবাসার বন্দী দশা পেরিয়ে সে বাইরে বেরিয়ে মোটরে বসলো। স্ত্রী সমেত রওনা হলো সে।

এই মোহনদাস প্রায় কুড়ি বছর পর তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। তার মন তো পড়ে থাকে আর এক জায়গায়, কত বছর ধরে। কত বছর আগে দেখেছিলো তাকে কংগ্রেস অধিবেশনে কলকাতায়। আলাপ হয়েছিলো সরলার সঙ্গে। তারপরে তো কত ঘটনা! কত কী! শেষে বিদেশ চলে যাওয়া।

গৃহে এসে বিশ্রামে সেই পুরণো স্মৃতিচারণে মোহনদাস ডুবে গেলো। নিজের তেরো বছর বয়সে বিয়ে কস্তুর এর সঙ্গে। সেই বয়ঃসন্ধির সময় দৈহিক উদ্দীপনায় বার বার উপগত হওয়া স্ত্রীর সঙ্গে। কী ভাবে অনিচ্ছাগত স্ত্রীকে ক্রমাগত মিলনে বাধ্য করা!

আর এই যৌনমিলনের আতিশয্যে সে দারুণ এক অপরাধ করে বসে। আজও তার মনকে কুরে কুরে খায় অপরাধ বোধে। আজও অনুশোচনায় ডুবে থাকে। যৌন মিলনের আতিশয্যেই সে সঠিক সময়ে  পিতার মৃত্যু শয্যায় উপস্থিত হতে পারে নি।

  • কস্তুরের ডাকে সে ধাতস্থ হয়ে বলে, কি বলছো?

– না তেমন কিছু নয়।

বিজ্ঞাপন

– ক্লান্ত হয়ে রয়েছো, এই শরবতটুকু খেয়ে নাও। হাত বাড়িয়ে সে পাথরের গ্লাসটি নেয়। কস্তুর দেখে তার চিন্তামগ্ন স্বামীকে। জিজ্ঞাসা করে চিন্তার কারণটি ঠিক কি!

– না কিছু না। ভাবছি এবারে তো জনসংযোগের জন্য পথে বেরোতে হবে!

কস্তুর চলে যায় পাশের ঘরে। মোহনদাস পুনরায় আনমনা হয়ে যায়। মনে পড়ে সরলার কথা। কত বছর আগে দেখা হয়েছিল তার সরলার সঙ্গে। কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে। সরলা কংগ্রেসের অক্লান্ত কর্মী জেনেরাল সেক্রেটারীর কন্যা, ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক। সেই আলাপচারিতায় মোহনদাস ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারেনি সরলার মৃগপরাযণ চোখ তাকে নিরীক্ষণ করেছিলো।

সরলা বোধহয় ভেবেছিলো ভারতীয় হয়ে বিদেশে চাকুরি করা এক যুবকের নিকট একটি লেখা নেবার আগ্রহ দেখাবে কি না! তো কেমন হবে ব্যাপারটা! মোহনদাস সরলার বাংলার রাজনীতি তে অতি সক্রিয় থাকবার ঘটনা অবগত হয়েছিলো।

বিদেশ থাকা কালীন সময়ে তার কর্নগোচর হয়েছিলো, সরলার বিবাহ লাহোরের রামভুজ দত্ত চৌধুরীর সঙ্গে সমাধা হয়েছে। কিছুদিন বাদে কাজের প্রয়োজনে মোহনদাসের লাহোর গমনের জন্য  তার মনে পড়লো সরলা আছে লাহোরে। তাহলে সে অন্য কোথাও কেন, সরলার কাছে তার গৃহে উঠতে পারে তো! অবশ্য গৃহকর্তা তখন জেলবন্দী দেশের কাজে।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু সরলার ছেলে, সৎ ছেলে, শাশুড়ি ও বহু ভৃত্যসংবলিত সেই গৃহ তাকে অতি সমাদরেই গ্রহণ করলো। দিনে দিনে সরলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেতে লাগলো। কী এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে  তারা জড়িয়ে পড়তে লাগলো।

এই অবস্থায় মোহনদাস একদিন অনুভব করলো, ঘরে এভাবে বন্দী হয়ে নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন মানুষের নাড়ির সন্ধানে তাকে বেরোতে হবে। পথে না বেরোলে মানুষের মনের সন্ধান সে পাবে না। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ভিত মজবুত করতে হবে পদযাত্রার মাধ্যমে।

জিজ্ঞাসা করে সরলাকে – তুমি যাবে সঙ্গে সরলা? আমার সঙ্গী হয়ে?

সরলাও চাইছিলো মোহনদাসের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তে –  সে-ও তো এক বিস্ময় জনক ভাবে সাড়া পাচ্ছিলো মনের দিক থেকে।

– ও সব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি সবাইকে রাজি করাবো।

– আর তোমার স্বামী?

– তাঁকে নিয়েও চিন্তার কিছু নেই। আমার কাজে তিনি কোনদিন বাধা দেননি, দেবেনও না।

– তবে চলো।

বিজ্ঞাপন

বেরিয়ে পড়লো তারা লাহোর থেকে। একে একে তারা পাঞ্জাব, গুজরাটের প্রত্যন্ত গ্রাম হেঁটে হেঁটে পেরিয়ে যাচ্ছে, কৃষকরা অবাক হয়ে দেখছে তার যাত্রাসঙ্গিনী কে। এ যে এক অন্য রকম অভিজাত চেহারা!

তাদের কাছে তো যেন এক স্বর্গের দেবী সরলা! তারা সরলাকে মাথা নত করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছে, ‘মাতাজী’ সম্বোধন করছে। মোহনদাসও অবাক হয়ে দেখছে তাকে যাকে সে কতকাল আগে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো, এই সেই সরলা!

এই সেই সরলা যা তার চেনা পরিচিত মহিলাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা! দুজনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কি নিছক বন্ধত্ব? রোমান্স তো ছিলই, তার সঙ্গে যৌনতা? কামনা, বাসনার নিষিদ্ধ আবেগ! এর পরবর্তী পর্যায়ে সময়ের গতিবেগ গড়িয়ে গেছে কয়েক বছর।

সেই ছেচল্লিশ বছরের যুবক একান্নতে পৌঁচেছেন – প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়েছেন। সেই প্রৌঢ় মোহনদাস লিখছেন – রাশি রাশি পত্র, যে গুলি রক্ষিত হচ্ছে সরলার আখরোট কাঠের সুন্দর বাক্সে। প্রতি চিঠিতে ভালবাসা থাকতো। সরলার বিহনে কতখানি কাতর বোধ করেন জানাতে ভোলেন না তিনি। সম্বোধনে দিনে দিনে নৈকট্য বেড়ে উঠছে – “আমার প্রিয়তমা সরলা।”

লিখছেন, তোমার সঙ্গে আমার জন্মান্তরের যোগ সরলা আমার!

বিজ্ঞাপন

বিবাহ পূর্বের ঠাকুর বাড়ীর সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে সরলা দেবী চৌধুরাণী, বর্তমানেও বহু গুণান্বিতা, রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় সরলা এক সময় স্বেচ্ছায় তুলে নিলেন খদ্দরের আদর্শের প্রচার ভার। বিভিন্ন পার্টিতে খদ্দরের অঙ্গাবরণ তখন মোহনদা কে কিছুটা বিহবল ও বেসামাল করে দিয়েছিলো।

এক সহযোগী বন্ধু কে মোহনদাস লিখছেন – তাকে বিবাহ না করে থাকা যাচ্ছে না। আর এক সুহৃদ কে লিখেছেন – দ্য কিপার অফ মাই সেন্স। কিন্তু আর এক বন্ধু তথা সহযোগীর ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর তিরস্কারে তিনি সরলাকে বিবাহের ইচ্ছা স্থগিত রেখেছিলেন। অথচ কিছুতেই সরলা কে ভুলতে পারেন নি।

“তুমি রাতের স্বপ্নে বার বার ঘুরে ফিরে আসো সরলা আমার। আমাকে জাদু করেছো তুমি (ইউ স্টিল কন্টিনিউ টু হন্ট মি ইভন ইন মাই স্লিপ!)।”

মোহনদাস উপলব্ধি করেছিলেন জাতীয়তা বাদী আন্দোলনে শক্তি স্বরুপিনী হয়ে ওঠার প্রভুত ক্ষমতা রাখে সরলা। তবে সেটা তার স্বামী রামভুজ এর সম্মতিক্রমেই হবে – পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যা প্রত্যাশা!

তারপর নিজের ইচ্ছেমতো গড়ে পিটে খাঁটি সোনায় পরিণত করবেন সরলাকে। সরলার আত্মপ্রকশের চুড়ান্ত নিয়ন্তা স্বয়ং তিনিই। তাই তো প্রতি চিঠিতে লিখতেন – ‘ইয়োর ল’গিভার – তোমার বিধান দাতা!

বিজ্ঞাপন

মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী যখন আসন্ন অসহযোগ আন্দোলনের জন্য অনেক দিন পথে পথে ঘুরছেন। সরলা তাঁর অদর্শে অস্থির হয়ে অশ্রুমোচনের সঙ্গে লিখছেন চিঠিতে –

“যদি ভালবাসাই হয় মনের কথা, তবে সোজা সাপ্টা বলুন, আমায় মিস করছেন। বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ভোগ করছেন আমারই মতো… অপেক্ষা করছেন সেই ভোরের জন্য যখন আমাদের দেখা হবে… আর যদি প্রেমই না হবে স্পষ্ট বলে দিন সে কথা।”

এই হৃদয়ের এ কুল ও কুল দু’কুল ভেসে যাওয়ার কথা কে পারে অনুভব করতে! তবে এই প্রেমপর্বের পরিসমাপ্তি হঠাৎই ঘটে। কিন্তু ধীরে ধীরে! প্রেম ও সংঘাতে দীর্ণ মোহনদাস সরে এসেছিলেন নিজের কক্ষপথে। তারপরে… সে অন্য প্রসঙ্গ।

তথ্য সূত্র

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

বিজ্ঞাপন

রেফারেন্স সমূহ

১. গান্ধী – ডেভিড আর্নল্ড

২. গান্ধী ইন হিজ টাইম এন্ড আওয়ার্স, ডেভিড হার্ডিম্যান

৩. গান্ধী, দ্য ইয়ার্স দ্যাট চেজড দ্য ওয়ার্ল্ড ১৯১৪-১৯১৪৮, রামচন্দ্র গুহ

৪. লাস্ট লেটার্স এন্ড ফেমিনিষ্ট হিষ্ট্রি, দ্য পলিটিক্যাল ফ্রেণ্ডশিপ অফ মোহনদাস কে গান্ধী এন্ড সরলা দেবী চৌধুরাণী, জেরান্ডাইন ফোর্বস।

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিজ্ঞাপন
Back to top button