বুদ্ধদেব বসু’র অতর্কিতে অকাল প্রয়াণের পর পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছিলেন, এক একটা মানুষ থাকেন চওড়া উঠোন। তাতে রোদ, আলো, হাওয়া প্রচুর। অনেক লোক সেখানে হই হই করে মিলতে পারে। একবারে অতিশয়োক্তি নয়।
বুদ্ধদেব বসু নিজের বিষয়ে এক জায়গায় লিখেছেন,
“আমি যে রচিব কাব্য এ উদ্দ্যশ্য ছিল না স্রষ্টার
তবু কাব্য রচিলাম, এই গর্ব বিদ্রোহ আমার।”
একটি পিছনে ফিরে তাকালে দেখি কিশোর বয়সে সমবয়সীদের তুলনায় শারীরিক দুর্বলতাবশত তিনি মুক্তির পথ হিসেবেই ঢুকে পড়েছিলেন মনোজগতে। মাত্র তেরো বছর বয়সেই লিখে ফেলেছেন অজস্র গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ।
স্নাতকোত্তর পরীক্ষার পর ১৯৩১ সালের এক ভাদ্রের বুদ্ধদেব তাঁর স্মৃতিময় শহর ঢাকা শহর থেকে স্থায়ী চলে আসেন কলকাতায়। পেশাদার সাহিত্য জীবনের ঝুঁকি সহ নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন।
পত্র পত্রিকায় তখন কবিতার কোনো মর্যাদা ছিলো না। সব পত্রিকাতেই গুরুত্বপূর্ণ লেখার তলায় একটু জায়গা খালি থাকছে, তাতে স্থান পূরণের জন্য কবিতা। এই দৈন্যদশায় বুদ্ধদেব ছটপট করে উঠলেন।
ঐ সময়ে কলকাতার রিপম কলেজে চাকরীতে যোগ দিয়ে প্রণয় বিবাহে আবদ্ধ হলেন ঢাকার বিখ্যাত গায়িকা প্রতিভা সোম কে। যিনি পরবর্তীকালে স্বনামধন্য লেখিকা ও সাহিত্যিক প্রতিভা বসু হয়ে উঠবেন।
তখনকার বাস ভবন ভবানীপুরের ১২, যেগেশ মিত্র রোড। সেখানেই জন্ম নিলো “কবিতা” পত্রিকা। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলো ১ অক্টোবর ১৯৩৫। নিয়মিত আড্ডার আসরেই বুদ্ধদেব জানিয়েছিলেন, তাঁরা একটি কবিতা পত্রিকা বের করবেন। তাতে থাকবে নতুন নতুন কবিতা ও শুধু কবিতারই আলোচনা। একটি ত্রৈমাসিক বাংলা পত্রিকায় এ দেশের পক্ষে একেবারে নতুন।
সম্পাদক থাকবেন বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র। সহ-সম্পাদক সমর সেন। মূল্য ধার্য হলো ছ’আনা, বার্ষিক চাঁদা দেড় টাকা। প্রথম দিন ১০ কপি “কবিতা” নিয়ে সহ সম্পাদক সমর সেন চৌরঙ্গীর বুক স্টলে গেলে বিক্রেতা অবাক হয়ে বললেন, “ঐ টুকু কাগজের দাম ছ’আনা? চার পয়সা হলে না হয় বিক্রি করা যেত।”
কিন্তু দু’দিনেই পত্রিকা বিক্রি হয়ে গেলো- ১০ কপি। পরে বুদ্ধদেব জানিয়েছিলেন, গৃহ ভৃত্যের হাতে পত্রিকা ও কাগজপত্র পাঠালেন কিছু বিশিষ্ট মানুষ কে। সে ফিরে এলো সন্ধ্যেয়, দেখা গেলো সব পত্রিকা বিক্রি হয়ে তার হাতে রুপোর টাকা। আর প্রায় সকলে পত্রিকার গ্রাহক হয়ে গেছেন। প্রথম বছরে ৭০ জন গ্রাহকের বেশীর ভাগ ছিলেন রাজবন্দী।
প্রথম সংখ্যাটির একটি কপি বুদ্ধদেব পাঠালেন কবি রবীন্দ্রনাথ কে। রবিঠাকুর কে আগে কল্লোল গোষ্ঠীর কবি সাহিত্যিকরা বাস্তববিমুখ বলে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তাঁকে কবিতা পাঠিয়ে একটু অস্বস্তিতে পড়েছিলেন বুদ্ধদেব – কি জানি কি প্রতিক্রিয়া আসবে না কি একটা সার্টিফিকেট দু’চার লাইন আসে কি না!
কিন্তু অপার আনন্দ এলো এক স্বস্তি সংবাদে- বিরাট তুলট কাগজে স্বতস্ফুর্ত লেখন- তোমার কবিতা পত্রিকাটি পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। সব ক’টি বিশিস্ট রচনা। এরা সবাই পাঠকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছেন। সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজের একটি আনকোরা লম্বা কবিতা “ছুটি” পাঠিয়েছেন।
এর কিছু দিনের মধ্যে ভবাণীপুরেই আর একটি ঠিকানাতে চলে এলেন। ৫৪/১ গিরিশ মুখার্জি রোড। এইখানে তাঁর “কবিতা ভবন” প্রকাশনা সংস্থা স্থাপিত হয় ১৯৩৬ সালের অক্টোবর মাসে। পরে আবারও কবিতা পত্রিকার সম্পাদকের স্থানান্তর হয় এবং এবার চিরস্থায়ী ঠিকানা হয়, “২০২ রাসবিহারী এভিনিউ” । ইতোমধ্যে প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদনা পদ ছেড়ে দিলে সম্পাদক রুপে বুদ্ধদেব বসুর একক নাম মুদ্রিত হতে থাকে।
এরপর ১৯৩৭ সাল। এর জুন থেকে একটানা বাইশ বছর “কবিতা” পত্রিকা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়েছে ২০২ রাসবিহারি নিউ থেকে। নতুন বাড়ীতে আসার দেড় বছরের মধ্যেই দুশো দুই রাসবিহারির নামকরণ হলো “কবিতা ভবন”।
অন্য কাজ ও রচনার মধ্যে তাঁর মন প্রাণ জুড়ে থাকতো, তাঁর স্বপ্ন ডানা মেলেছিলো ‘কবিতা’র হাত ধরে। তিনি এমনটাই চেয়েছিলেন এমন কোনো পত্রিকা যার মধ্যে দিয়ে কবিতা হতে পারে বিশেষভাবে প্রকাশিত ও প্রচারিত।
শুধু সুনির্বাচিত কবিতার জন্য একটি পত্রিকা, আগে কেউ দেখেনি। ‘কবিতা’র সম্পাদক বুদ্ধদেব আবিষ্কার করেন এমন সব কবি যাঁরা ভবিষ্যতে কবিতার নানা দিক বিজয় করবেন। একজন সৎ সম্পাদকের কি কাজ তা পরবর্তী কালে সবাই অনুভব করেছেন।
‘কবিতা’র প্রথম বছরে প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব বসুর বিখ্যাত সম্পাদকীয় “আধুবনিকতার মোহ” । দ্বিতীয় বছরে ‘কবিতা’র চারটি সংখ্যায় ছাপা হয় জীবনানন্দের তেরো টি কবিতা। দ্বিতীয় সংখ্যায় বুদ্ধদেব অসামান্য একটি প্রবন্ধ লেখেন জীবনানন্দের ‘ধুসর পান্ডুলিপি’ নিয়ে।
বুদ্ধদেবের আধুনিক ঘোষণা – জীবনানন্দকে আমি সাম্প্রতিক কালে একজন প্রধান কবি বলে বিবেচনা করি। বুদ্ধদেবের উষ্ণ সাহচর্য না পেলে জীবনানন্দ হয়তো জলের মতো একা একা ঘুরে কথা কয়ে যেতেন। তাঁর অজস্র গল্পের মতো অজস্র কবিতাও ছাদের ঘরে খাটের তলায় রংচটা টিনের তোরঙ্গে জমা হয়ে থাকতো।
সমর সেন ইংরেজি লিখতেন, বুদ্ধদেবের সমালোচনা “নবযৌবনের কবিতা” সমর সেন কে বাংলায় টেনে আনলো। তৃতীয় বছরে সম্পাদক এক তরুণ কবিকে পোস্ট কার্ডে দেখা করার আহ্বান জানিয়ে ভীত সেই কবিকে, কোথায় কোন শব্দ, কোথায় আর একটু লাগসই হতো বলে কথা শুরু করলেন যে সে ভেবে পেলো না তার মতো অচেনা খোদ সম্পাদক এতো কথা বলছেন! সেই নতুন কবি আনন্দে আটখানা হলো (সুভাষ মুখোপাধ্যায়- পরবর্তী কালে)।
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের “ক্রন্দসী” অমিয় চক্রবর্তীর “খসরা” অজিত দত্তের “পাতাল কন্যা” – প্রত্যেককে সম্পাদকীয় সমালোচনায় তাঁরা প্রকাশ্যে এসেছেন। বুদ্ধদেব বসুর সমালোচনার এটাই বিশেষত্ব লেখক কে সমানে উৎসাহ দেওয়া। অথচ শুধু উৎসাহ নয় কোথাও সামান্য স্খলন তাঁর নজর এড়াতো না।
১৯৫৩ তে প্রথম বিদেশ গেলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপনা। ফের বিদেশ যাওয়া তাঁকে অনেকটা সময় বিহীনতা করে দিলো। সাতাশ বছরের যে প্রাণ চঞ্চল যুবক ‘কবিতা’র মাধ্যমে ইতিহাস রচনায় পা বাড়িয়েছিলেন তিনি তখন তেষট্টি বছরের প্রৌঢ়। এর মাঝখানে তিনি কবি- ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, অনুবাদক হয়ে পরিণত থেকে পরিণতর হয়েছেন। সময় হয়ে গেছে ভাগ।
শেষ পর্যন্ত ১৯৬১ সালে। মার্চ এপ্রিলে কবিতা’র শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। তিনি তখন বিদেশে শান্তিনিকেতনের মতোই ‘কবিতা’র বাগানে প্রথম সব কলি ফুটে উঠেছিলো।