লতা মঙ্গেশকর, একজন অনন্যা গায়িকা যিনি সুরের জগতে এক অমর নাম রেখে গেছেন। তাঁর জীবন ও কর্মের গল্প শুনুন এই নিবন্ধে।
আমাদের সুরময় লতা
জন্ম ও শৈশব
লতা মঙ্গেশকর ১৯২৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন একজন প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও নাট্যকার। লতার নামকরণ হয়েছিল ‘লতিকা’ নামের একটি নাটকে অভিনয়ের পর।
সঙ্গীতের শুরু
লতা মাত্র নয় বছর বয়সে প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৪২ সালে মরাঠী ফিল্ম ‘ইতিহসান’ এর জন্য প্রথম গান গেয়েছিলেন, কিন্তু সেটি মুক্তি পায়নি। একই বছর তাঁর পিতার মৃত্যুর ফলে পারিবারিক দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়ে।
নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া
সুরের যাত্রা
লতা মঙ্গেশকর তাঁর ৯২ বছরের জীবনে ৩০ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন। তাঁর অসংখ্য গানের মধ্যে কিছু অমর গান হলো:
- অজীব দাস্তাঁ ইয়ে
- নীলা আসমাঁ সো গয়া
- পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া
পিতৃহারা লতা
লতা মাত্র ১৩ বছর বয়সে পিতৃহারা হন। এই সময় নবযুগ চিত্রপট সিনেমা কোম্পনির মালিক ‘বিনায়ক দামোদর’ তাঁকে সাহায্য করেন। লতা মরাঠী ছবিতে কাজ করেন এবং ১৯৪৩ সালে ‘গাজাভাত’ নামে একটি হিন্দি গান করেন।
বলিউডে প্রবেশ
১৯৪৬ সালে লতা সঙ্গীত পরিচালক বসন্ত দেয়াইয়ের সাথে পরিচিত হন। ১৯৪৮ সালে সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হৈদারের সুরে ‘দিল মেরা তোরা’ গেয়ে বলিউডে প্রথম পরিচিত হন। ১৯৪৯ সালে ‘মহল’ ছবিতে লতার গাওয়া ‘আয়েগা আনেবালা’ গানটি উপ-মহাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
পঞ্চাশের দশকে যুগান্তকারী কাজ
পঞ্চাশের দশকে লতা অনিল বিশ্বাস, শংকর-জয় কিষাণ, শচীন দেব বর্মন, নৌশাদ আলি, সি-রামচন্দ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মদন মোহন, কল্যাণ-আনন্দজী, সলিল চৌধুরীর মতো সংগীত পরিচালকদের সাথে কাজ করেন।
ষাটের ও সত্তরের দশকে নতুন জয় যাত্রা
১৯৬০ সালে ‘মুগল-এ-আজম’ ছবিতে মধুবালার ঠোঁটে লতার ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া’ গানটি এক নতুন জয় যাত্রা শুরু করে। সত্তরের দশকেও লতার অধিকাংশ গান লক্ষীকান্ত-পেয়ারেলাল ও রাহুল দেব বর্মনের সঙ্গে।
তিনবার জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ গায়িকা লতা মঙ্গেশকর
নব্বইয়ের দশকেও লতা জ্বলজ্বল করছেন। কাজ করেছেন আনন্দ-মিলিন্দ, যতীন-ললিত, অনু মালিক, উত্তর সিং, এ আর রহমান এর সঙ্গে। লতা পরিচালনাও করেন – মরাঠী ছবি ‘রাম রাম পরহন’। প্রযোজনাও করেন কিছু ছবির।
সম্মাননা
- ভারত রত্ন
- দাদাসাহেব ফালকে
- ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সনমান ‘লেজিয়ঁ দঁ নরঁ’
- তিনবার জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ গায়িকা রুপে
১৯৯৯ সালে রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন। প্রথম ভারতীয় শিল্পী যিনি রয়াল এলবার্ট হলে কনসার্ট করেন। দীর্ঘ সময় ধরে গিনেস বুক অব রেকর্ডে ছিলেন সর্বোচ্চ স্থানে। ছত্রিশটি ভারতীয় ভাষায় লতা গান গেয়েছেন।
বাংলা গানে লতা
লতার বাংলা গানের সংখ্যা দু’শো প্রায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, ভুপেন হাজারিকা, সুধীন দাশগুপ্ত, কিশোর কুমার ইত্যাদির সুরে তাঁর গান গাওয়া। হেমন্ত তাঁকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইয়েছেন।
কিছু বাংলা গান
- না যেও না
- প্রেম একবারই এসেছিলো জীবনে
- আকাশ প্রদীপ জ্বলে
- চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়
- কে যেন ডেকেছে আমায়
বিশ্লেষণের ঊর্ধ্বে লতা
লতার গলায় বেনারসী ঠাট, গজলের অংগে গাওয়া ‘বৈয়াঁ ন ধরোঁ’ ছোট খেয়াল উধাও হচ্ছে গজলের মুড়কি। ‘নদীয়াঁ কিনারে’-তে কে বলবে লতা গ্রাম বাংলার মানুষ নন, যেন কত যুগ ধরে বয়ে চলেছে তাঁর ঘরের পাশে মেঘনা-পদ্মা!
লতার নিজস্ব স্টাইল
লতা জানতেন কোথায় লাগবে গমক, সুরতান কোথায় আর মুড়কি কোথায়। তিনি এক সাবেক সিন্দুক – “ইয়ে জীন্দগী উসিকা হ্যায়”, “মেরে পনঘট মে”, “অপলম”, “চপলম”, “ইয়ে কঁহা আ গয়ে হম”, “আ জা রে পরদেশী” – কত ধন রত্ন ভরা সিন্দুকে।
এক মাইল ফলক লতা
১৯৬৩ সালে “এয় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ” – জাতীয়তাবাদের সমার্থক “ঝিলমিল সিতারে প্রেম সাগর”, “সত্যম শিবম সুন্দরম” – ভক্তিমার্গের। সজ্ঞীতজ্ঞের মতামত – উস্তাদ বরে গোলাম আলি – ‘ওস্তাদোঁ কে ওস্তাদ’। সুরিলী লতা চেষ্টা করেও ভুল গাইতে পারবে না। পন্ডিত ভীমসেন যোশী ডাকতেন – ‘ভারত রত্ন’। দুই দিকপাল বলেছেন- লতা তোমায় ঈশ্বর খানিক পক্ষপাতিত্ব করেছেন।
লতার ভাষা শিক্ষা
দিলীপ কুমারের কটাক্ষ – লতার উচ্চারণ উর্দুর মতো, নুরজাহানের নকল শুনে লতা বাড়ীতে উর্দু শিখেছিলেন ও নুরজাহানের আয়ত্ব হতে বেরিয়েছিলেন। আবার বাংলা গান গাইতেও বাড়ীতে বাংলা শিখেছিলেন। শিক্ষক প্রখ্যাত পরিচালক বাসু ভট্টাচার্য।
বাঙালীর আত্মীয় লতা মঙ্গেশকর
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রিয় লেখক। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের পথেয়। ঝকঝকে বাংলা উচ্চারণে বলতেন – বাংলা ভাষা খুব প্রিয় কিন্তু ভাল বলতে পারি না। বাঙালীর আত্মীয় যেন লতা মঙ্গেশকর। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক বিছানায় শুয়ে গল্প করা, হেমন্তের পুত্র বধুকে সাধ খাওয়ানো।
কিছু বাংলা গান
- না যেও না
- প্রেম একবারই এসেছিলো জীবনে
- আকাশ প্রদীপ জ্বলে
- চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়
- কে যেন ডেকেছে আমায়
রবীন্দ্রসঙ্গীত
- মধু গন্ধে ভরা
- তোমার হলো শুরু
- শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা
- হৃদয় আমার নাচেরে তুমি রবে নীরবে
নিচে লতা মঙ্গেশকরের জীবন ও কর্মের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংবলিত একটি তথ্যবহুল টেবিল দেওয়া হলো:
বিষয় | তথ্য |
---|---|
জন্ম তারিখ | ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ |
জন্মস্থান | মধ্যপ্রদেশ, ইন্দোর, ভারত |
পিতার নাম | দীননাথ মঙ্গেশকর |
প্রথম অভিনয় | ৯ বছর বয়সে |
প্রথম গান | ১৯৪২ সালে মরাঠী ফিল্ম ‘ইতিহসান’ এর জন্য (মুক্তি পায়নি) |
প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত গান | ১৯৪৩ সালে মরাঠী ছবি ‘গাজাভাত’ এর একটি হিন্দি গান |
বলিউডে প্রথম গান | ১৯৪৮ সালে ‘দিল মেরা তোরা’ |
প্রথম হিট গান | ১৯৪৯ সালে ‘আয়েগা আনেবালা’ (‘মহল’ ছবিতে) |
গানের সংখ্যা | ৩০,০০০ এর বেশি |
গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গীত পরিচালক | অনিল বিশ্বাস, শংকর-জয় কিষাণ, শচীন দেব বর্মন, নৌশাদ আলি, সি-রামচন্দ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মদন মোহন, কল্যাণ-আনন্দজী, সলিল চৌধুরী |
গুরুত্বপূর্ণ গান | ‘অজীব দাস্তাঁ ইয়ে’, ‘নীলা আসমাঁ সো গয়া’, ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া’ |
পরিচালনা | মরাঠী ছবি ‘রাম রাম পরহন’ |
প্রযোজনা | কিছু ছবির প্রযোজনা |
সম্মাননা | ভারত রত্ন, দাদাসাহেব ফালকে, ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সনমান ‘লেজিয়ঁ দঁ নরঁ’, তিনবার জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ গায়িকা রুপে |
রাজনৈতিক পদ | ১৯৯৯ সালে রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত |
গিনেস বুক অব রেকর্ড | দীর্ঘ সময় ধরে সর্বোচ্চ স্থানে |
গানের ভাষা | ৩৪টি ভারতীয় ভাষা |
বাংলা গানের সংখ্যা | প্রায় ২০০ |
বাংলা গানের সঙ্গীত পরিচালক | হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, ভুপেন হাজারিকা, সুধীন দাশগুপ্ত, কিশোর কুমার |
রবীন্দ্রসঙ্গীত | ‘মধু গন্ধে ভরা’, ‘তোমার হলো শুরু’, ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’, ‘হৃদয় আমার নাচেরে তুমি রবে নীরবে’ |
বাংলা গানের উল্লেখযোগ্য গান | ‘না যেও না’, ‘প্রেম একবারই এসেছিলো জীবনে’, ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’, ‘চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়’, ‘কে যেন ডেকেছে আমায়’ |
সমাপ্তি
লতা মঙ্গেশকর একজন অনন্যা গায়িকা যিনি সুরের জগতে এক অমর নাম রেখে গেছেন। তাঁর গানের মাধ্যমে তিনি আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর গানের মাধ্যমে তিনি আমাদের জীবনে আনন্দ এনেছেন এবং আমাদের সুরের জগতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। লতা মঙ্গেশকরের গান আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে এবং তাঁর গানের মাধ্যমে তিনি আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।