ছোটগল্প

তিলোত্তমার ছায়ায়: ফুটপাথের আগুন ও অশ্রুর গল্প

কলকাতার ফ্লাই-ওভারের নিচে এক পরিবারের যন্ত্রণা ও সমাজের নির্মম প্রতিচ্ছবি

কলকাতার গোলপার্কের পাশ দিয়ে ওদিকে বিবেকানন্দ পার্ক বরাবর ফুটপাথ পেরিয়ে এক ফ্লাই-ওভারের নিচে এক পরিবার। তাদের ঘর নেই। ঐ ফুটপাথ তাদের আস্তানা। পরিবারে বাবা, পাঁচটা মায়ে পোয়ে, ঝিয়েরা। তারা যেন এই তিলোত্তমার এক আবর্জনা!

বাপে ও বেটা দুজনেই অর্ধনগ্ন মেয়েগুলো বাবুদের বাড়ীর বৌদের বাতিল উচ্ছিষ্ট কাপড়গুলো পরিধান করে নগ্নতা ঢাকবার বৃথা চেষ্টা করে। বাপের পরনের এক ময়লা কাড়ের ফালি তার নিম্নাঙ্গ কোনো রকমে ঢেকে রাখলেও উর্ধ্বাঙ্গ পুরো উদোম। ছেলেটারও চোলাই খেয়ে বেহুঁস, আধনাঙ্গা।

এরা এই তিলোত্তমার যেন এক আড়ালে পড়ে থাকা সমাজ। সন্ধ্যেতে অন্ধকার নেমেছে সামান্য উজ্জ্বল ল্যামপোস্টের বাতি দুটো। দুটো ইটের উনোন জ্বেলে মাটির হাঁড়িতে জল চাপিয়েছে বড় ছেমড়ি। ছোট গুলো ঘিরে রয়েছে সেখানে অমৃতের অভিলাষে। বাপের কোন কাজ নেই। সে মিটমিট করে চায় সকলের দিকে। তারও অপেক্ষা কখন পাবে খাদ্য!

বৌকে একটু সাহায্য করতে পারে, মাঠের দিকে গিয়ে চারটি কাঠকুটো এনে। কিন্তু তার ক্ষুধার্ত পেটে অবচেতন এ সব কথা। সেই কাজ সারতে বললো ছোট ছেমড়িকে।

ছেমড়ি বলে: মা তো গেছে মাঠের দিকে… আনবে খ’ন কাঠ।

সেখানে কিছু আগন্তুক এর জমায়েতের নজর পড়েছে হাঁড়িতে জল চাপানো ছুঁড়িগুলোর দিকে। জানা কথাই। কারুর ক্ষিধে পেটে, কারুর চোখে। নেশাগ্রস্ত বড় ছেমড়া নারীজাতির প্রতি এক নিম্ন সম্বোধনে বলে, কোথায় খাবার! এখনো ভাত চাপালি না! বড় ছেমড়ি পনেরো। সে বলে, আগুন টা ধরুক। দাদার বয়স উনিশ, মেজো ও ছোট ছেমড়ি যথাক্রমে এগারোও নয়।

সেই পনেরো বছরের মেয়েটা হাঁড়িতে জল চড়িয়েছে, তাতে জলটাও গরম হয় কি না সন্দেহ, ভাত তো দুর। কিন্তু জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস যেন তাদের পেটের ভিতর আগুন হয়ে জ্বলছে যেমন জ্বলছে সেখানে জমা হওয়া গুটি কয়েক লোকের চোখে। ওদের লালসা জিভ দিয়ে ঝরে পড়ছে যেন। ওদের চোখে ভিসুভিয়াসের আগুন।

উনিশ বছরের ছেলেটা হঠাৎ ধেয়ে গেলো মাটির হাঁড়ির দিকে, কোন জ্ঞান গরিমা নেই, হুঁস নেই তার। ঝাঁপিয়ে পড়লো হাঁড়ির ওপর। এদিক-ওদিক চেয়ে দেখলো না সে, হাঁড়ি চৌচির হয়ে গেলো। গরম জল গায়ে পড়ে সে একটা বীভৎস চিৎকার করে উঠলো। বড় ছেমড়িরও কোন দিকে খেয়াল নেই, দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো বড় ছ্যামড়ার ওপর। আর চিৎকারে গগন ফাটালো যেন। সঙ্গে সঙ্গে ছোটগুলোও দিদির পথ অনুসরণ করে দৌড়লো দাদার দিকে।

অনাহারী পনেরো বছর জ্বলন্ত রাগে উনিশ বছর রের গলা টিপে ধরলো, নয় ও এগারো চিল চিৎকারে দাদাকে কিল, চড়, ঘুঁসি মারতে লাগলো। সবাই ভাই বোন একসঙ্গে ঘপাস করে পড়লো আধকাঁচা ভাত, কিছু টা চাল ও ধুলোর ওপরে।

দাদা ও বোনেরা একে অপরকে ছাড়বে না – যেমন ডাস্টবিনে বড় মানুষদের ফেলে ছড়ার অবহেলা ভরা মাংসের টুকরো গুলো জন্য নেড়ি কুত্তা গুলো একে অপরকে ছিঁড়ে খায় – তেমনি চারিদিকের মানুষ জন ঘিরে রয়েছে – এখনো।

সেই প্রাচীন যুগের রোম সাম্রাজ্যের স্পার্টাকাসের যুগে গ্লাডিয়েটরে বসে মানুষ, পশুর লড়াই উপভোগ করা গ্যালারির সেই হিংস্র মানুষ নামক বর্বর জন্তু তো এখনো আছে!

ছেমড়িরা এতোক্ষনে উঠে দাঁড়ালো লেংচাতে লেংচাতে এলো-জান্তব আওয়াজে ভয়ংকর চেঁচালো – শালা কে আজ মার্ডার করে দেবো। বুড়ো লোকটাও এবারে উঠে দাঁড়িয়ে তার একমাত্র লাঠি নিয়ে ছুটে গেলো ছেলের দিকে – লাঠির এক ঘা দিলো ছেলের মাথায়। হয়তো সে লাঠির ঘা টা মারতে চায় নি, কিন্তু ঘটনা যা ঘটবার ঘটে গেলো।

বড় ছেমড়িটা বাপ কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, বাপ, একি! করলি তুই বাপ!

আধসিদ্ধ ধুলো মাখা চালের ওপর অভুক্ত রক্তাক্ত ছেলেটির লাশ পড়ে রইলো। বাপ, ভাই, বোনেরা সেই দিকে সবাই মিলে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকলো। মা তো তখনো ফেরেনি কাঠ কুড়িয়ে!

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button