“দু’জন খসখসে সবুজ উর্দিপরা সিপাহী
কবিকে নিয়ে গেল টানতে টানতে
কবি প্রশ্ন করলেন : আমার হাতে শিকল বেঁধেছ কেন?
সিপাহী দু’জন উত্তর দিল না;
সিপাহী দু’জনেরই জিভ কাটা।
অস্পষ্ট গোধুলি আলোয় তাদের পায়ে ভারী বুটের শব্দ
তাদের মুখে কঠোর বিষণ্নতা
তাদের চোখে বিজ্ঞাপনের আলোর লাল আভা।
মেটে রঙের রাস্তা চলে গেছে পুকুরের পাড় দিয়ে
ফ্লোরেসেন্ট বাঁশঝাড় ঘুরে-
ফসল কাটা মাঠে এখন
সদ্যকৃত বধ্যভূমি।”
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (কবির মৃত্যু: লোরকা স্মরণে)
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর ‘কবির মৃত্যু: লোরকা স্মরণে’ তে আছে বিখ্যাত উক্তি – ‘আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না’। ফেদেরিকা গার্সিয়া লোরকার সঙ্গে বাঙালি বৌদ্ধিক সম্পর্ক অনেক দিনের হলেও তিনি বাঙালির কাছে বহুপঠিত নন। তস হলেও তাঁর সৃষ্টির রসে বাঙালি পরিতৃপ্ত। লোরকার পাঠক মজে থেকেছেন তাঁর সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পচর্চা সেই সাথে লোরকার প্রকৃতি, মানবচেতনার সহ অবস্থানে।
তিনি পিয়ানো বাজাতেন, ছবি আঁকতেন দক্ষ হাতে, সঙ্গীতানুরাগী কিন্তু প্রতিভা ছিলো সাহিত্যে। ১৯১৮ সালে তাঁর কুড়ি বছর বয়সে প্রকাশিত হয় ‘ইম্প্রেশন এন্ড ল্যান্ডস্কেপ’। আর ১৯২০ সালে মাদ্রিদ শহরে মঞ্চস্থ হয় দ্য বাটারফ্লাইস ইভিল স্পেস যা নাকি কীটপতঙ্গের রুপকে রচিত এক কমেডি। কবি এবং নাট্যকার লোরকা বা গীতিকার এবং নাট্যপরিচালক লোরকা এই দুই সত্ত্বাতেই তিনি সাবলীল ছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ইউরোপে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন প্রেক্ষিতে স্পেনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন – এই সময়ে লোরকার অধিকাংশ সৃষ্টি। তাঁর রচিত নাটকে পরাবাস্তবতার প্রয়োগে পাঠক বাস্তব ও কল্পলোকের চরিত্রদের নিয়ে ভাবিত হন। যদিও সমালোচক কেউ কেউ তাঁর নাটক কে দুর্বোধ্য বলেছেন। তবু পাঠক অবহিত হয়েছেন লোরকার জীবনদর্শণ এর নেপথ্যে থাকা গভীর মানবিকতা বোধকে।
লোরকা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি গুলির মাঝে আড়াল থেকে সান্নিধ্য পেয়েছেন দালি, বুনুয়ের, নেরুদা প্রমুখের। এই তারকাদের দ্বারা তিনি স্বাভাবিক ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। লোরকা অপেশাদার অভিনেতাদের নাটক করেছিলেন সাধারণের জন্যে। তাঁর বিখ্যাত ‘ট্রিলজি’, ‘ব্লাড ওয়েডিং’, ‘ইয়েরমা’, ‘দ্য হাউজ অব বেরনারাদা আলফা’ তাঁর উল্লেখযোগ্য সর্বোত্তম কৃতি। সুররিয়ালিজমের উপস্থিতি তাঁর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
কবিখ্যাতির আগেই মাদ্রিদ শহরে ‘বিদব্জজন আলোকিত’ ছাত্রাবাসে লোরকা কবিতা শোনাতেন প্রাচীন গ্রামীন পদ্য বা তাঁর প্রকাশিতব্য ‘কবিতার বই’ থেকে। তাঁর দরাজ গলার আবৃত্তি ছাত্রদের মুগ্ধ করতো। তাঁদের মাধ্যমেই ফেদেরিকা গার্সিয়া লোরকার নাম ছড়িয়ে পড়েছিলো দেশ বিদেশে বিশেষত স্প্য্যনিশ-আমেরিকার দেশে দেশে।
মুখে মুখে কবিতা গল্প বলা স্পেনীয় ঐতিহ্যর অঙ্গ। মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চারণ কবির সঙ্গে তুলনা করা হয় লোরকার। স্বরক্ষেপন ও আন্দালুসি ভঙ্গীতে তাঁর আবৃত্তি অনবদ্য। বিশিষ্ট সংগীত রচয়িতা মামিকে মানুয়েল দে ফাইয়ার কে লোরকা বলতেন ‘মায়েস্তো’ অর্থাৎ ‘গুরু’। তাঁর সহযোগিতায় লোরকা পুতুল নাটক পরিবেশন করে গ্রানাদায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। লোরকা বিষয় ও আঙ্গিকে আন্তর্জাতিক নন। বিশেষ ‘ইজম’ এর ভক্ত নন অথচ তাঁর প্রতিভাস্পর্শে আন্দালুসিয়ার মাটি থেকে কবিতস, নাটক বিশ্বজনীন হয়েছিলো।
১৯৩৩ সালে আর্জেন্টিনার বোয়েনেস আইরেশ শহরের প্রেক্ষাগৃহে লোরকার বিখ্যাত বক্তৃতার শিরোনাম ‘দোয়েন্দের খেলা’ এবং ‘তত্ত্ব’, ‘দোয়েন্দে’র আভিধানিক অর্থ ‘প্রেতাত্মা’ কিন্তু আন্দালুসিয়ার লোককথায় এটি রহস্যময়ী জাদিগরী শক্তি। ‘পোয়েট ইন নিউইয়ার’ কবিতার পাঠ শুরুতে লোরকা স্বয়ং ‘দোয়েন্দে’র সাহায্য চান।
লোরকা কে প্রভাবিত করেন সেই সময়ের ব্যতিক্রমী শিল্পী পিকাসো, মার্ক শিগাল ও মানরিকে, কবি কেভেদো, লোপে দেভেগা। এঁদের সঙ্গে পরিচিত না হলে ‘পোয়েট ইন নিউইয়র্ক’ এতো উচ্চাঙ্গের কবিতা হতো কি না সন্দেহ।
১৯২৬ সালে লোরকা বন্ধু হোর্হে গিইয়েন কে বলেছিলেন, এখনো তরবারির মতো বিঁধবার মতো কবিতস লেখা হয়নি, তিনি অবাক হন সঙ্গীত রচয়িতা ‘বাখ’ এর সুরের তরবারি দেখে। লোরকার রচনায় ‘প্রেমে’ লীন হয়ে থাকে ‘মৃত্যু’, পানশালাতেও। তাঁর সময় ঘুরে ঘুরে চলে নিজের নিয়মে। তার পরিচয় আছে ‘Poet in New York (Poeta en Nueva York)’ গ্রন্থে। তাঁর কবিতাশ ‘কুমারী মা’ ও সাধুসন্তের কথাও বলেছেন। তাঁর কোনো ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিলনা।
তাঁর চিঠিতে দেখা যায় মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা তাঁর। তাঁর মতে মুসলিম বিতাড়ন স্পেন থেকে, এক ঐতিহাসিক ভুল। তাঁর সংগ্রহে হিন্দু ও বুদ্ধ ধর্মের গ্রন্থ ছিল। লোরকার মুল প্রেরণার উৎস ‘মাটি (TIERRA)’ – যেখানে শস্য ফলে, বৃষ্টি নামে, মাটি ভেজে প্রাণ পায় বীজ ও যৌনতা।
প্রত্যক্ষ রাজনীতির প্রসঙ্গ তাঁর কবিতায় খুবই কম। একমাত্র আছে ‘মারিয়ানা গিনেদা’ ও স্পেনিশ পুলিশের লোকগাথা। তাঁর কবিতা চিঠি, সাক্ষাৎকারে, আলোচনা, নাটকে বরং এক চাপা কান্না পুলিশের অবিচারের প্রতি ছিলো। নিজে সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন না তবু ফ্রাংকোর ফাসিস্ট সরকার ‘লাল বুদ্ধিজীবী’ বলে দেগে দিয়েছিলো।
ইয়ান গিবসন, লোরকার জীবনীকার চার দশক ধরে তন্নতন্ন করে লোরকার কবিতা পড়ে প্রধান তিনটি শব্দ তুলে এনেছিলেন। ‘টরচারড’, ‘গে’, ‘লভ’। কোনও সন্দেহ নেই লোরকা সমকামী (গে) ছিলেন। আবার বল হয়েছে লোরকা ‘জনগণের কবি’। এটা কি কথার কথা না সত্য!
একটা কাব্য আন্দোলন যেমন ‘বিট’ জেনারেশন – এলেন গিনসবার্গ, আমাদের ‘কৃত্তিবাস’ – শক্তি-সুনীল, ‘শতভিসা’ আলোক সরকার যেমন ‘হাঙরি জেনারেশন’ মলয় রায় চৌধুরী। লোরকার পরাবাস্তবতার কবিতাতে ছিলে বাস্তবতা। বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা দুটিই সত্য। পরাবাস্তবতা সত্যের শিকল খুলে দেয় সত্যের শ্লীলতা হানিতে।
“হাতে একটা ছেলে কে নিয়ে/চাঁদ চলে যায় আকাশ জুড়ে।”
কবিতার অনুবাদে দেখা যায় যে, “শহর ঘুমায় না/আকাশে কেউ ঘুমিয়ে নেই/কেউ না কেউ না/কেউ ঘুমিয়ে নেই… দুরের কবরখানায় একটি মৃতদেহ/তিন বছর ধরে আর্তনাদ করে চলেছে/কেন না তার হাঁটুর ওপর শুকনো গ্রাম মফস্বলে শুয়ে আছে… চুম্বন মুখ আটকে দেয়/স্নায়ুর ভিতরে।”
লোরকাকে ফ্লায়িং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়েছিলো তাঁকে। এমন মৃত্যু কোন কবির ক্ষেত্রে ঘটেনি। তিনি তো আমেরিকা থেকে ফিরে সরকারি কাজ নাট্যবিভাগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাধারনের জন্য নাটক পরিবেশন করতেন।
তাঁকে গুলি করার কারণ কি? স্পেনের গৃহ যুদ্ধের সময় এই ঘটনা গ্রানাদার ছোট একটি গ্রাম, সাত/আটশো লোকের বাস। সেখানে নিয়ে গিয়প গুলি করা! তিনি কি স্পেশালিষ্ট ছিলেন, না সমকামী, যা নাকি ইউরোপের উন্নত দেশে প্রচলিত ছিলো!
তাঁর মৃত্যুর ২৯ বছর পর এই তথ্য উঠে আসে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায়। ২০০৯ সালেও অনেক হাই প্রোফাইল কমিটি তৈরী হয়, কিন্তু কোন কবরে লোরকা ঘুমিয়ে আছেন আজও জানা যায়নি। সুনীল গাঙ্গুলি জানতেন এই সব, তাঁর তরুণ বয়সে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন তখন, আলাপচারিতার মাধ্যমে জেনেছিলেন তবু কি অসাধারণ ভঙ্গিতে লিখেছেন, “আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না।”
লোরকা নিয়ে ধারণা গুলির মধ্যে তাঁর মৃত্যু নিয়ে নিয়ে মুলত আলোড়ন কলকাতায়। সত্তর দশকে কলকাতায় তখন অলিতে-গলিতে বারুদ আর লাশের গন্ধ। বুলেটের ফাঁকফোকর দিয়ে সময় পার করে দিয়ে বলা, “আহ হার্লেম! আহ হার্লেম আহ! হার্লেম/এমন যন্ত্রনা নেই যা তোমার নির্যাতিত রাতের তুলনা…
অমিতাভ দাশগুপ্ত ও কবিতা সিংহ অনূদিত লোরকার এক কবিতা চমকে দেয়, “আমি বুঝতে পারছি খুন করা/হয়েছে আমাকে/তারা কাফে, কবরখানা আর গির্জাগুলো/তন্ন তন্ন করে খুঁজছে/ …তিনটে কঙ্কাল লুট করে নিয়ে/খুলে নিয়ে গেছে/ সোনার দাঁত/আমাকে তারা খুঁজে পায়নি/কখনোই কি পায়নি তারা!”
একটি স্পেনিয় ভাষায়,
“Pero yo ya no soy yo
Ni mi casa es ya mi casa.
But now I am no longer I,
nor is my house any longer my house.”
― Federico Garcia Lorca
বাংলায়, “না আমি আমি নই আর/না আমার বাড়ি আমার বাড়ি।” একজন বড় কবি, সাম্যবাদী কবি, সমাজবাদী কবি প্রগতিশীল কবি যাঁকে ফ্রাংকোর লোকেরা খুন করেছে। তাঁর মৃত্যুর একশো পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছে গত ৫ জুন, ২০২৩। জন্মও হয়েছিলো স্পেনের আন্দালুসিয়া প্রদেশে ৫ জুন, ১৮৯৮ সালে।
কৃতজ্ঞতা
তরুণকুমার ঘটক
সুবোধ সরকার
অরুণ মুখোপাধ্যায়
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.