সমরেশ মজুমদারের অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস ‘কালবেলা’য় মাধবীলতা চরিত্রের গভীর বিশ্লেষণ
এক নারীর অদম্য সাহস এবং প্রেমের গল্প
সমরেশ মজুমদারের অমর সৃষ্টি অনিমেষ সিরিজে ‘কালবেলা’য় পাঠকের মনে ভেসে উঠবে অনিমেষ কে ছাপিয়ে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র, মাধবীলতা কে। সেই মেয়ে এই পৃথিবীর কাউকে তোয়াক্কা করে না, অথচ একটুও উদ্ধত নয়, সে অকারণে কোথাও মাথা নোয়ায় না অথচ একটুও দাম্ভিক নয়।
সমরেশ মজুমদারের অমর সৃষ্টি ‘অনিমেষ সিরিজ’
একটা সুখের পরিমন্ডল ছেড়ে শুধু ভালবাসার জন্য একা একা লড়ে গেলো, কখনো কোনো আপস করলো না। সমরেশ মজুমদার এই বিষয়ে বলেছেন, এই কলকাতায় একা অল্পবয়সী এক মেয়ে সেই শান্তিনিকেতনের এক রাতের! ফসল দশ মাস শরীরে ধারণ করে নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেছে। আইনের কোন অধিকার ছাড়াই।
মাধবীলতার মুখ দিয়ে একবার বলানো হয়েছে, হয় তো আমি অনেক কিছু বুঝি না, কিন্তু এইটুকু বুঝি, আমায় যা করতে হবে, তা আমি আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে করবো। যে জানবে সে জানবে, আমি কিন্তু কাউকে জানতে দেব না।
এই জন্য উপন্যাসের জনকের মনে হয়েছে, অর্থাৎ তিনি অনুভব করেছেন, অনিমেষের কর্মে যে দেশ গড়ার বিপ্লবের নিষ্ফল হতাশায় ডুবে যেতে যেতে তাঁর মনে হয়েছে (তাঁর লেখক মনের অনবদ্য চরিত্র অনিমেশের নজরে, বিপ্লবের আর এক নাম ‘মাধবীলতা’।
জন্ম, শিক্ষাজীবন ও থিয়েটার
সমরেশ মজুমদার জন্ম ডুয়ার্স চা-বাগানে ১৯৪৪ সালে। শৈশবও ওখানে কেটেছে। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে ছাত্র। কলকাতায় আসেন ১৯৬০ এ। শিক্ষা- স্কটিশ চার্চ থেকে বাংলায় অনার্স। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ। প্রথমে গ্রুপ থিয়েটার করতেন। তারপরে নাটক লিখতে গিয়ে গল্প লেখা। প্রথম উপন্যাস – ‘দৌড়’। ১৯৭৫ এ ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
তাঁর উপন্যস – দৌড়, এই আমি রেনু, উত্তরাধিকার, বন্দীনিবাস, বড় পাপ হে, উজান গঙ্গা, বাসভুমি, সিংহবাহিনী, লক্ষীর পাঁচালী, উনিশ বিশ, সওয়ার, কালবেলা, কালপুরুষ ভালবাসা, টাকা পয়সা, দিন যায় রাত যায়, গর্ভধারিনী, কলকাতার নবকুমার।
সন্মান ও পুরষ্কার
১৮৮২ সালে আনন্দ পুরস্কার, দৌড় চলচ্চিত্রে কাহিনীকার হিসেবে বি.এফ.জে.এ, দিশারী এবং চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে ‘কালবেলা’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। সমরেশ মজুমদার এক ডিকেকটিভ চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। নাম, অর্জুন। এই নিয়ে ফিল্ম- কালিম্পং য়ে সীতাহরণ- ২০১৩ সালে।
‘বুনো হাঁস’ মুক্তি পায় ২০১৪ সালে তাঁরই লেখা থেকে মুভিটি নির্মিত হয়েছে – যেটি প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দলোক পুজাবার্ষিকী তে।
সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ উপন্যাসের বিশ্লেষণ
অনিমেষ প্রথম কলকাতায় পা রেখেছিলো, তখন সে হয়েছিল দুর্ঘটনার শিকার, রাস্তায় ট্রাম জ্বলছে, গুলি চলছে, তারপর আর পাঁচটা মানুষের মতো গা বাঁচিয়ে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ মোড় পাল্টালো ছাত্র রাজনীতিতে। সে এক জটিল আবর্ত।
এরপরে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে কমিউনিস্ট পার্টির পতাকার তলে আসা। কিন্তু মনুষ্যত্ব ও মানবিক মুল্যবোধ তাকে টেনে আনলো উগ্র রাজনীতি তে। সত্তরের সেই আগুনে ঝাঁপ দিয়ে সে নিজেকে নিঃশেষ করে দগ্ধ হয়ে দেখলো দাহ্য বস্তুর কোনো সৃষ্টিশীল ক্ষমতা নেই।
পুলিশের নির্মম অত্যাচারে সে বিকলাঙ্গ হয়ে দেখলো বিপ্লব দলের বাকিরা যে যার আখের গুছিয়ে নিয়েছে নয় তো নিঃশেষ হয়েছে। উপন্যাসের নারী চরিত্র যা শুরু তেই উল্লেখিত হয়েছে সেই মাধবীলতা কখনো রাজনীতি করেনি, শুধু তাকে ভালবেসে তার পাশে আলোকবর্তিকার মতো দাঁড়িয়ে থেকেছে।খরতপ্ত মধ্যাহন্যে সে শুধু এক গ্লাস জল শীতল জল যেন!
সে এক বাংলাদেশের মেয়ে নিজেকে শুধু ধুপের মতো পুড়িয়েছে আাগামীকাল কে সুন্দর করতে। কালপুরুষ- সত্তর দশকের অগ্নিস্রাবী রাজনৈতিক পথ পরিক্রমা শেষ প্রান্তে অনিমেষ আশা করেছিলো তার উত্তর পুরুষ, তার পুত্র অর্ক তার সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পতাকা ঠিকঠাক বহন করবে।
কিন্তু অন্তসারহীন কুটিল রাজনীতি আর পঙ্কিল সমাজ ব্যবস্থা অর্ক কে করে তুলেছিল অসামাজিক রাজত্বের প্রতিনিধি। তবু যে হেতু তার মধ্যে তার রক্তের বীজ ও সুস্থ আদর্শবোধ এবং মাধবীলতার দৃঢ়তা ও পবিত্রতা সংমিশ্রিত উপাদান তার বোধোদয় ঘটতে দেরী হয় নি।
সুযোগ সন্ধানী রাজনৈতিক দল ও সমাজের কিছু সুবিধাবাদীদের বলি হওয়া মানুষ কে উদ্বুদ্ধ করেছিলো নিজের পাশে দাঁড়াতে কিন্তু ক্ষমতা লোভী অ-রাজনৈতিক দল ও সমাজ অর্ককে অর্গল বদ্ধ করে ও তার পবিত্র পৃথিবীর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করেছিল কিন্তু সহজ অতো নয়, অর্ক যার নাম না কি তার অপর নাম সুর্য তার আবির্ভাব কে কি রুদ্ধ করা যায়!
সাতকাহন
এই উপন্যসের সাহসী কেন্দ্রবিন্দু চরিত্র ‘দীপাবলী’। যার নামের মধ্যে বিদ্রোহের আভাস অন্ধকারের বিরুদ্ধে। উত্তর বাংলার চা-বাগান, গাছ গাছালি আর আঙরা ভাসি নদী (সমরেশ মজুমদার -এর শৈশব জীবন) দিয়ে যে চালচিত্র এর সূচনা। ক্রমান্বয়ে পঞ্চাশের কলকাতা, শহর তলি, রাজনৈতিক পটভুমি, কো-এডুকেশন কলেজ মেয়েদের হোস্টেল, কফি হাউস, ছাত্র আন্দোলন, সর্বভারতীয় কর্ম পরিবেশের জীবন্ত চিত্রন।
বন্দী নিবাস – উপন্যাস সম্পর্কে সমরেশ মজুমদারের উক্তি
আমার লেখা ‘কম্পন’ নামে একটি লেখা পড়ে বদলে গেলো লেখাটা। তাই নামও বদলাতে হলো। রাখলাম – বন্দী নিবাস। বাংলা ভাষায় মৌলিক চিন্তার থ্রিলার বড় একটা কেউ লেখেন নি। সেই চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম ব্যাপারটা মোটেই সহজ সাধ্য নয়। সবাই কি সব কিছু কল্পনা করে সাজাতে পারে! আমি তো পারি না। তা ই বলে এই উপন্যাসের কোন চরিত্র বা ঘটনাই ফটোগ্রাফ নয়।
লক্ষীর পাঁচালি
উপন্যসের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ‘শ্রী শ্রী মা লক্ষী’। ইংরেজদের আমলে রায় সাহেব খেতাব পাওয়া চুঁচুড়া শহরের এক ব্রাহ্মণ পরিবার নিজ গৃহে লক্ষী দেবী প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, ধনৈশ্বর্যৈর আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু সে ব্যাপারে আরোপিত শর্ত তার বংশ কে ঝঞ্ঝার মুখে ফেলে দিয়েছিলো।
আরও বহু উপন্যাস সমরেশ মজুমদারের পাঠক মহলে সমাদৃত। আজ এই পর্যন্তই।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.