বাবা আদম শহীদ (রহঃ): ইসলামের আলো ছড়ানো এক মহান সাধক
মুন্সিগঞ্জের মহান সুফী সাধকের জীবন, ইসলাম প্রচার ও ঐতিহ্যবাহী মসজিদের কাহিনী
সবুজ শ্যামল আমাদের এই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য কোন নবী-রাসূলের আবির্ভাব ঘটেনি বলে জানা যায়। তবে যুগে যুগে বিভিন্ন পীর, দরবেশ, ওলী আউলিয়া ও সুফী সাধকদের আগমনের ফলে এদেশে ইসলামের প্রচার ঘটে। সে সকল ওলী আউলিয়াদের মধ্যে বাবা আদম শহীদ (রহঃ) ও একজন। যিনি দ্বাদশ শতাব্দির মধ্যভাগে বাংলাদেশে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি কোথায় কোথায় ইসলাম প্রচার করেছেন? কোথায় তার মাজার শরীফ? ইত্যাদি বিষয়ে আজকে আমরা তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
জন্ম
বাবা আদম শহীদ ১০৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগরীর অদূরে তায়েফ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর সাহচার্য পেতে বর্তমান ইরাকের বাগদাদে আসেন।
ইসলাম প্রচারের ঘটনা
বাবা আদম শহীদ ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে আসেন। তবে একসময়ের পণ্ডিতদের ধারণা ছিল যে, বাবা আদম শহীদ ছিলেন তুর্কি বিজয়ের পূর্বে বাংলায় আগত সুফী সাধকদের একজন। কিন্তু তুর্কি বিজয়ের পূর্বে কোন সুফী সাধক বাংলায় এসেছিলেন এই ধারণার কোন সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে আসার পর সেখান থেকে তিনি ১১৫২ খ্রিস্টাব্দে মুন্সিগঞ্জ সদরের প্রাচীন রামপালনগরে আসেন। মুন্সিগঞ্জ এলাকায় তিনি দীর্ঘ দিন অবস্থান করেন এবং ইসলাম প্রচার করেন। তিনি মুন্সিগঞ্জের কপালদুয়ার, মানিকেশ্বর ও ধীপুরে তিনটি খানকা নির্মাণ করে ইসলাম প্রচার করেছিলেন।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা
সে সময় রামপালের নিকটবর্তী কানা-চং গ্রামের একজন জনৈক মুসলমান ব্যক্তি তার ছেলের জন্ম অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে একটি গরু কোরবানি করেন। সে সময় রামপালের শাসক ছিলেন রাজা বল্লাল সেন। এই খবরটি শুনে রাজা বল্লাল সেন সেই মুসলমান ব্যক্তিটির উপর নির্যাতন করেন। ফলে তিনি দেশ ত্যাগ করে মক্কায় চলে যান। সে সময় বাবা আদম শহীদ মক্কায় একজন সাধু পুরুষ ও ফকির বেশে বসবাস করতেন। মুসলমান ব্যক্তিটি মক্কায় গিয়ে বাবা আদম শহীদের কাছে তার দুর্ভাগ্যের কাহিনী বর্ণনা করেন। স্বধর্মীয় বেদনায় ব্যাথিত হয়ে বাবা আদম শহীদ ছয় থেকে সাত হাজার সৈন্য নিয়ে বাংলায় চলে আসেন।
রাজা বল্লাল সেন এই খবরটি পেয়ে সংকল্পবদ্ধ হয়ে তার সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হন। ইতিহাসের পাতায় এই যুদ্ধের নাম কানাই চং ব্যাটেল। যার একদিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাবা আদম শহীদ এবং অপর দিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজা বল্লাল সেন। যুদ্ধে সেনাবাহিনীরা মুসলমানদের পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারে না।
বাবা আদম শহীদ সংক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন এবং নিকটবর্তী একটি গুহায় ফিরে যান যাতে তিনি আসরের নামাজ আদায় করতে পারেন। রাজা বল্লাল সেন খবর পেয়ে নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতরণ করেন এবং বাবা আদম শহীদকে খুঁজে বের করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তার তরবারি দিয়ে হত্যা করেন। ফলে বাবা আদম শহীদ নিহত হন। এভাবেই তার অনুসারিরা তাকে শহীদ হতে দেখেছিলেন। তাই তাকে শহীদ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে রাজা স্বয়ং ও তার পরিবার অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন।
মৃত্যু ও সমাধি
বাবা আদম শহীদকে রাজা বল্লাল সেন তার তরবারির আঘাতে হত্যা করেন। নিহত হওয়ার পর তাকে মুন্সিগঞ্জ জেলার রামপালের অদূরে বিক্রমপুরের একটি প্রাচীন মসজিদের আঙ্গিনায় সমাহিত করা হয়। সমাহিতের স্থানটি বাবা আদম শহীদের মাজার নামে পরিচিত।
আদম শহীদ মসজিদ
বাবা আদম শহীদ মসজিদটি একটি প্রাচীন মসজিদ। এই মসজিদটি বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার দরগাবাড়ি গ্রামে অবস্থিত। ১৪৪৯ খ্রিস্টাব্দে জালালুদ্দিন ফতেহ শাহের শাসনকালে মালেক কাফুর মসজিদটি নির্মাণ করেন। তার মৃত্যুর প্রায় তিন শতাব্দির পর ১৪৮৩ সালে বাবা আদম শহীদের নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয়।
এই মসজিদের ছাদে ৬ টি গম্বুজ রয়েছে। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তারিত ভিত্তি এলাকা দৈর্ঘ্যে ৪৩ ফুট এবং প্রস্থে ৩৬ ফুট। মসজিদের ইটগুলো লাল পোড়ামাটির যা বাংলাদেশে মসজিদ স্থাপত্যে সুলতানি স্থাপত্যরীতি পরিণত রূপ লাভ করেছে। এই পোড়ামাটির ইটগুলো ১০ ইঞ্চি, ৭ ইঞ্চি, ৬ ইঞ্চি ও ৫ ইঞ্চি মাপের।
মসজিদের ভেতরে প্রবেশের জন্য তিনটি দরজা রয়েছে। মসজিদের ভেতরে দুটি স্তম্ভ রয়েছে। মসজিদের উচ্চতা প্রায় ১৮ ফুট। বাংলাদেশের আবহাওয়ার কথা চিন্তা করে মসজিদের ছাদটি উত্তর-দক্ষিণে ঈষৎ ঢালু করে নির্মাণ করা হয়েছে।
মসজিদটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল চার বছর। ১৯৯১-১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বাবা আদম মসজিদের ছবি সংবলিত ডাকটিকিট প্রকাশ করেন। মসজিদের পূর্ব দেয়ালের মাঝখানে দরজার উপরে একটি আরবি শিলালিপি প্রথিত রয়েছে।
উপসংহার
আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পন্ন বাবা আদম শহীদ বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করতে এসে শহীদ হয়ে নতুন এক ইতিহাসের পুনর্গঠন করেন। তার নামে নির্মিত মসজিদটি ৫৩৫ বছর ধরে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। ভারতবর্ষ প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগ ১৯০৯ সালে একবার মসজিদটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এরপর মসজিদটি সেভাবেই ফেলে রাখা হয়। শুধু ১৯৯১ সালে এর চারপাশে লোহার সীমানা বেড়া নির্মাণ করা হয়।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.