বেথুন সাহেব ও বিদ্যাসাগর: নারীশিক্ষার অগ্রদূতদের গল্প
প্রথম নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আজকের প্রজন্মের জয়যাত্রা
বেথুন সাহেব বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ করেছিলেন, “আমি থাকবো না, কিন্তু আমার মেয়েরা আমার স্কুল যেন না মরে পন্ডিত তুমি দেখো।”
কবি ঈশ্বর গুপ্তের মন্তব্য
কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখলেন, “আগে মেয়ে গুলো ছিল ভালো/ব্রত কর্ম করতো সবে/একা বেথুন এসে শেষ করেছে/আর কি তাদের তেমন পাবে!”
স্কুলের প্রতিষ্ঠা
সময় ১৮৪৯ সাল। ৭ মে ২১ জন শিশু (কন্যা) কে নিয়ে পথ চলা। স্কুলের ঠিকানা – ৫৬ নং সুকিয়া স্ট্রীট। স্কুলের নাম ক্যসলকাটা ফিমেল স্কুল। স্কুলটি চালু করেছেন তখনকার শিক্ষা সংসদের সভাপতি বেথুন সাহেব।
দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের অবদান
৫৬ নং সুকিয়া স্ট্রীটের বাড়িটি দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর বৈঠকখানায় স্কুল শুরু। শুধু বৈঠকখানা নয়, দক্ষিণারঞ্জন নিজের লাইব্রেরী ও পাঁচ হাজার টাকা অর্থমূল্যের বইও স্কুলকে দান করেছিলেন।
বেথুন সাহেবের শিক্ষাদান পদ্ধতি
বৈঠকখানায় ছোট ছোট মেয়েরা পড়ছে, বেথুন সাহেব স্কুলের খোঁজ খবর নিতে এসে দেখেন মেয়েরা একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। সব সময় কি পড়াশোনা ঐ ছোট্ট মেয়েদের ভালো লাগে! লেখাপড়ায় কত মনোযোগ দিতে পারে! তিনি প্রথমে এ পকেট তার পরে ও পকেট থেকে বের করেন মনোরম খেলনাপাতি। তাদের হাতে দিয়ে বলেন, “খেলবি পরে। আয় আগে ঘোড়ায় চড়। আমার পিঠের ওপর চড় তো, আমি ঘোড়া হচ্ছি!”
নারীশিক্ষার অগ্রযাত্রা
বেথুন সাহেব আর দক্ষিণারঞ্জন ১৭৫ বছর আগে আমাদের দেশে নারীশিক্ষার যে প্রদীপ জ্বেলেছিলেন তা দ্বিগুণ প্রজ্বলিত হয়েছিলো দীপের ‘ঘি’ সম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তরকালংকার, রামগোপাল ঘোষ প্রমুখের সাহচর্যে।
বেথুন সাহেবের আগমন ও রামগোপাল ঘোষের সঙ্গে পরিচয়
বেথুন সাহেব কলকাতায় আসেন ১৮৪৮ সালে গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের একজন লিগাল মেজর হিসেবে। পরে শিক্ষা সংসদের সভাপতি হলে আলাপ হয় আর এক শিক্ষা সংসদের সদস্য এবং ডিরোজিও এর আদর্শ ও ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ রামগোপাল ঘোষের সঙ্গে। তাঁকে বেথুন সাহেব মেয়েদের স্কুল গড়ার প্রসঙ্গ তুললে তিনি নিয়ে যান আর এক উৎসাহী দক্ষিণারঞ্জনের কাছে।
দক্ষিণারঞ্জনের প্রোপৌত্রের কথা
দক্ষিণারঞ্জনের প্রোপৌত্র কলকাতায় থাকেন, তাঁর কথায়- দক্ষিণারঞ্জন জন্মেছিলেন পাথুরেঘাটা ভাবনা চিন্তার দিক দিয়ে অনেক আধুনিক ছিলেন। তাঁর বিবাহ হয়েছিলো বর্ধমানের বিধবা মহারাণী বসন্তকুমারীর সঙ্গে। বিবাহ হয়েছিলো পুলিশ কোর্টে রেজিস্ট্রী করে। এই ধরণের বিয়ে তখন স্বপ্নের অগোচরে। সমাজে আলোড়ণ সৃষ্টি হয়েছিলো প্রচুর পরিমাণে। এক খ্রীষ্টান বন্ধু কে বাড়ীতে থাকতে দেওয়া নিয়ে নিজের পিতার সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করা হয়। তখন থেকে এই ৫৬ নং সুকিয়া স্ট্রীট তাঁর বসবাস।
স্কুল খোলার স্থান ও সমস্যা
মেয়েদের স্কুল খোলার প্রস্তাবে বেথুন সাহেব কে রাম গোপাল ঘোষ দক্ষিণারঞ্জনের নিকট নিয়ে আসলে কোথায় স্কুল খোলার স্থান পাওয়া যায় প্রসঙ্গ উঠেছিলো। দক্ষিণারঞ্জন বলেছিলেন, “আমার বাড়ীর বৈঠকখানায় এই স্কুল খোলা যায়, ভালো ভাবেই। পরে ছাত্রী সংখ্যা বাড়লে অন্য কথা ভাবা যাবে।”
শিক্ষকের অভাব ও সমালোচনা
স্কুল স্থাপিত হলেও সমস্যা, ছোট ছোট মেয়েদের পড়াবে কারা? মেয়েদের স্কুলে পাঠানো নিয়েও চারিদিকে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বেথুন সাহেব বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মদনমোহন তরকা লঙ্কার কে বললেন, “পন্ডিত, তুমি বই লিখে ওদের পড়াও। মাতৃভাষায় ওরা পড়বে। তাতে কোন ধর্ম থাকবে না।”
বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের প্রতিষ্ঠা
রাতদিন স্কুলের চিন্তাভাবনা নিয়ে থাকতেন। কখনো নিজের নামে নাম হোক স্কুলের চাননি। নানা দোলা চলের মধ্যে ১৮৫০ সালে হেদুয়ার এখানকার বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের ভিত্তি স্থাপন করলেন বেথুন সাহেব। সে দিনও কিন্তু নাম বলেছিলেন “ক্যসলকাটা ফিমেল স্কুল”। এখানে পঠন পাঠন শুরু হয় ১৮৫১ সালে, সেপ্টেম্বরে। বেথুন সাহেব তা দেখে যেতে পারেন নি, ঐ বছরেই ১২ আগষ্ট তিনি দেহ রক্ষা করেন।
বিদ্যাসাগরের অবদান
বেথুন সাহেবের অন্তিম অনুরোধ উপেক্ষা করেননি বিদ্যাসাগর। আঠারো বছর ধরে বেথুন স্কুলের সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৮৬২ সালে সরকারের কাছে স্কুলের রিপোর্ট পেশ করবার সময়েও তিনি নাম বলেছিলেন বেথুন স্কুল। বিদ্যাসাগর সর্বদা “বেথুন” নাম উপযুক্ত মনে করেছেন। ১৮৭১ সালে বেথুন কলেজ স্থাপিত হলে নামকরণ হলো “বেথুন কলেজিয়েট স্কুল”।
বেথুন সাহেবের দান
বেথুন সাহেব তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি মায় তাঁর ঘোড়ার গাড়িও দান করেছিলেন স্কুলকে। সেই গাড়িতেই মেয়েদের নিয়ে আসা ও নিয়ে যাওয়া হতো। সেই গাড়িকে লক্ষ করে জনতা পাথর ছুঁড়তো, জুতোও ছুঁড়ে মারা হতো। ব্যঙ্গবানের বিদ্রুপ তো শতধারে চলতো। কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখলেন,
“যতো ছুঁড়ী গুলো তুড়ি মেরে কিতাব হাতে নিচ্ছে পরে/এ বি শিখে বিবি সেজে বিলাতী বোল কবেই কবে/আর কিছুদিন থামরে ভাই/পাবেই পাবি দেখতে পাবে/আপন হাতে হাঁকিয়ে বগী গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।”
প্রথম স্কুলের ঠিকানা হারিয়ে যাওয়া
এতো পাথর, জুতো ছোঁড়া, এতো ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মাঝেও যে দক্ষিণারঞ্জনের গৃহে ২১ জন মেয়ে নিয়ে স্কুল খোলা, তা বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় সংখ্যা ১০০ ছুঁয়েছিলো। এতো কান্ড করে যে বাড়ী থেকে শুরু, সেই ৫৬ নং সুকিয়া স্ট্রীট এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। কাছাকাছি এককালের বাসিন্দা সুবল মিত্র, শংকরলাল সিংহ, শিক্ষিকা শর্বরী ভট্টাচার্য এঁরা বলেন তাঁরাও চেষ্টা করেও খুঁজে পাননি সেই বাড়ি। নাতির নাতিও খুঁজেছেন, পাননি। সুকিয়া স্ট্র্বীটের ৫৬ নং বাড়ীটা হারিয়ে গিয়েছে কোন বাড়িতে প্রথম মেয়েদের স্কুল খোলা হয়েছিলো তো কেউ মনে রাখেননি। এ বিষয়ে কি পুরসভার দায়িত্ব নেই এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে সুরক্ষিত রাখার!
বর্তমানের নারীশিক্ষা
পথে ঘাটে আজ শত শত স্কুল কলেজের মেয়েদের স্বতঃস্ফুর্ত অবাবিল রুপে বিদ্যায়তনে যেতে দেখা যায়, সে দিকে চেয়ে মনে হয় না কি! বেথুন সাহেব জয়ী হয়েছেন! এবং তাঁর সহযোদ্ধারা ও! তাঁদের মাধ্যমে বয়ে চলা আজকের প্রজন্মের মেয়েরা! শুধু হারিয়ে গেছে লড়াই করার প্রথম ঠিকানা!
কৃতজ্ঞতা
আর্যভট্ট খান
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.