জীবনী

বুদ্ধদেব বসু: বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়

জীবন, সাহিত্য ও সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য গল্প

- Advertisement -

১৯০৮ সালের ৩০ নভেম্বর বুদ্ধদেব বসুর জন্ম। মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ও মাতামহী স্বর্নলতার নিকট তৎকালীন কর্মস্থল কুমিল্লায়। আদি নিবাস ঢাকার বিক্রমপুরে মালখান গরে। তাঁর মাতৃকুল ও শ্বশুর কুলও বিক্রমপুর। বুদ্ধদেব বসুর মাতা বিনয় কুমারী ষোলো বছর বয়সে সন্তান জন্মের সময় ধনুষ্টঙ্কার রোগে মারা যান। মাতামহ, মাতামহীর কাছেই মানুষ হয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু।

পিতা ভুদেব চন্দ্র বসু ছিলেন ঢাকার উকিল। ১৯৩৪ এর ১৯ জুলাই প্রতিভা সোম ও বুদ্ধদেব বসুর পরিণয় হয়। তাঁদের দুই কন্যা মীনাক্ষী দত্ত ও ড. দময়ন্তী সিং, একমাত্র পুত্র শুদ্ধ শীল (১৯৪৫-৮৮)।

বুদ্ধদেব বসু এর শিক্ষা জীবন

বুদ্ধদেব বসুর শৈশব, কৈশোর ও যৌবন কাটে কুমিল্লা, নোয়াখালি ও ঢাকা শহরে। দারোগা মাতামহ তাঁকে শৈশবে কোন স্কুলে ভর্তি করেন নি। খুব যত্ন করে দৌহিত্রকে ইংরেজি শিখিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসু নিজের স্মৃতি চারণে বলেছেন, বাংলার শিক্ষক ছিলেন লেখকরা, যোগীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর, রবীন্দ্রনাথ এর মতো জাদুকর গণ। দাদা মশায় সংস্কৃতটাও ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

নোয়াখালিতে নিজের তত্ত্বাবধানে বাড়ীতেই গণিতও কঠোরভাবে চর্চা করিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ -এ প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন।

১৯২৫ – এ ঢাকা সরকারি ইনটারমিডিয়েট কলেজে আই. এ ক্লাসে। আই. এ পরীক্ষায় ১ম বিভাগে ২য় স্থান অধিকার করেছিলেন। ১৯২৭ – এ জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৩১ – এ বুদ্ধদেব বসু এম.এ পরীক্ষায়। ১ম শ্রেণীতে উত্তীর্ন হন।

- Advertisement -

বুদ্ধদেব বসুর কর্মজীবন

১৯৩৪ এ কলকাতায় রিপন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। তখন কলকাতায় ঢাকার ডিগ্রির প্রতি একটা বিতৃষ্ণা ছিল। কলেজের মধ্যে কর্তৃপক্ষ তাঁর প্রতি যে অবিচার করেছিলেন তার তুলনা হয় না।

ক্ষীণ দেহ, ক্ষীণ কন্ঠ নতুন অধ্যাপক কে সব চেয়ে বাজে ক্লাস গুলি দেওয়া হতো। বুদ্ধদেবের অস্বস্তির সীমা ছিল না। উচিত কাজ হতো তাঁকে ছোট ছোট অনার্স ক্লাস গুলি দেওয়া। ওঁকে দিনাজপুরের শাখা কলেজে পাঠাবার কথা যারা ভেবেছিলেন তাঁদের দুর্মতির কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। স্বাভাবিকভাবে বুদ্ধদেব পদত্যাগ করলেন।

১৯৪৫ – এ তিনি রিপন কলেজের চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৪৪ – কলকাতার দৈনিক “দি স্টেটসম্যান” পত্রিকায় ফ্রিলান্স সাংবাদিকতা এবং ১৯৪৯ – এ তৃতীয় সম্পাদকীয় রচনার চাকরিতে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৫১ তে স্টেটসম্যানের চাকরিও ছেড়ে দেন। ১৯৫২ তে ছ’মাসের জন্য ইউনেস্কোর প্রকল্পে উপদেষ্টা পদে দিল্লি ও মহীশূরে কাজ করেন।

১৯৫৩ যুক্তরাষ্ট্রে পিটসবার্গের পেনসিলভ্যানিয়া কলেজ ফর উইমেন – এ এক বছরের অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৬ তে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন ও পদত্যাগও করেন ১৯৬৩ তে। এবং দু’বছরের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বক্তিতার সফরে আমন্ত্রিত হন।

অশ্লীল লেখক তকমার কারণ

১৯৩১-৫২ তে কলকাতা অবস্থানকালে তাঁর কপর্দকশূন্য অবস্থা ছিল প্রায়। তাঁর রোজগারের প্রধান অবলম্বন ছিল লেখা। ‘অশ্লীল লেখক’ – এই অভিযোগের দরুণ বুদ্ধদেব বসু’র কর্ম সংগ্রহে অনেক বাধা বন্ধ এসেছিল।

- Advertisement -

তাঁর কথায়, “আমার দৈনিক খাদ্য আপসে চলে আসবে না। আমাকেই তা জোগাড় করতে হবে। দু’বেলা খেতে বসে নিজেকে অভিনন্দন জানাই। কেননা আমি নিজে লিখে অর্জন করছি। …কিন্তু এই খাটুনি – তাতে আমি সর্বদাই রাজি, কিন্তু প্রকাশক সন্ধান ও পাওনা টাকার জন্য ধন্না… পাঁচ বা দু টাকা হাত পেতে নেওয়া… সবচেয়ে তেতো অংশ সেটাই।”

অনুকূল নয় সময় জগৎজুড়ে ব্যবসা মন্দাা। গান্ধীজীর উপবাস, ঢাকা-চাঁটগাঁর সন্ত্রাসবাদ সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়লো। আমার তো কোনো আশা নেই আমার ডিগ্রি ঢাকার এবং আমার লেখা অশ্লীল অন্ততো লোকেরা তাই বলে।

এ অবস্থায় বাড়ী ভাড়া নিয়ে একজন ভৃত্য রেখে, নির্ভরশীল দুজনসহ, প্রতিদিন তিন প্যাকেট গোল্ডফ্লেক আর সবান্ধবে ১২/১৪ পেয়ালা চা উড়িয়ে চাল চুলোহীন সংসার চালানো যে সহজ হয়নি তা বলাই বাহুল্য।

বুদ্ধদেব বসু এর সংসার জীবন

ঢাকার আশুতোষ সোম ও সরযুবালা গায়িকা কন্যা প্রতিভাা (রাণু) সোমের কথা বুদ্ধদেব ঢাকায় শুনেছিলেন, কিঞ্চিত দেখাশুনাও হয়েছিল। ১৯৩৪ – এ একদিন জানালেন বন্ধুকে, রাণু এসেছে কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

আমি গেলাম সেদিন গেলাম পরদিন হঠাৎ আমার রুটিন বদলে গেলো। …আমার নিজের জীবন ও তার জীবন ও মনের কথা লুকনো রইলো না। আমরা পুর্বরাগের সব ধাপ গুলো পেরিয়ে এলাম। কন্যার মাতা প্রথমে বলেছিলেন, অঘ্রান মাস কিন্তু বোধহয় পাত্র-পাত্রীর প্রণয় পরিণতি লক্ষ করে দ্রুত এগিয়ে দিলেন লগ্নটা। আমাদের বিয়ে হলো পুরো হিন্দুমতে, জুলাই মাসের উনিশ তারিখ, ১৯৩৪।

- Advertisement -

বুদ্ধদেব বসু প্রতিভা কে বিয়ে করার পর সংসার জীবনের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন ‘গৃহশল্পী’ প্রতিভা বসু। বুদ্ধদেব বসু কখনো সাধারণ বাঙালী মধ্যবিত্তের সংসার জীবন যাপন করেন নি। তিনি সাহিত্যজীবন যাপন করেছেন।

এ বিষয়ে লেখিকা নবনীতা দেব সেন লিখেছেন – বহির্জগত বুদ্ধদেব বসু কে ধরতে ছুঁতে পারেনি আমৃতু। পাশে তাঁর ছিলেন সর্বদা তাঁর রক্ষয়িত্রী। তিনি ছিলেন তাই জীবন ভর বুদ্ধদেব বসুর পক্ষে অমন দুর্দান্ত শিল্পকর্মে বুঁদ হয়ে থাকা সম্ভবপর হয়েছিল।

তাঁর (প্রতিভা বসু) মানুষী প্রেম কল্যাণে ২০২ রাসবিহারি এভেনিউ ছিল চির যৌবনা। মাত্র দুটি ঘরে একটি তপোবন, অন্যটি উপবন তাঁরা তৈরি করেছিলেন। একটি ঘরে জ্ঞনের লীলা, অন্যঘরে নিত্যলীলা। কবির যে টুকু পার্থিব সম্পদ তা সবই লক্ষীস্বরুপা প্রতিভা বসুর কঠোর পরিশ্রমের ফল।

বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যজীবন

বুদ্ধদেব বসু’র সমগ্র জীবন সাহিত্যজীবন। নোয়াখালিতে একটি কবিতা লিখলেন সন্ধেবেলায় হঠাৎ তাঁর কথায় –

কবিতা ছ’সাত স্ট্যানজা ইংরেজি –

- Advertisement -

Adieu, adieu, Dolency hose dear, We Leave you because the sea is near

And the sea will swallow you, we fear

Adieu, Adieu

ইংরেজিতে কেন?

আমি জানিনা- ইংরেজীতে এসেছিলো, এ ছাড়া আমার কোনো উত্তর নেই। কিন্তু ইংরেজিতে কেন এসেছিলো তারও কোনো কারণ আছে নিশ্চয়? আমার বয়স তখন নয় হবে বা কিছু বেশী, হেম, নবীন, মধুসূদনের সঙ্গে চেনা শুনা হচ্ছে, আমি জানি এবং মানি এঁরা বড় কবি, মহাকবি।

কিন্তু আসলে হয়তো অনেক বেশী ভাল লাগছে , ‘ওয়ান থাউজেন্ড এন্ড ওয়ান জেমস অব ইংলিশ’, ‘পোইট্রি’; নামে লাল মলাটের মোটা বইটা – আমার পুরনো এক সঙ্গী যার ছোট ছোট অক্ষরে আমি প্রথম পড়েছিলাম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কুপার, টমাস গ্রে।

- Advertisement -

আসলে তখন আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথের আবিভার্ব হয়নি, শেশবোত্তর বাংলা কবিতার অমৃত স্বাদ পাইনি তখনো। ঐ ইংরিজি কবিতা বিশুদ্ধ এক দৈব দূর্ঘটনা। ভাবিনি কবিতা লিখবো, কিন্তু প্রথম পাপ কার্যটি করে ফেলে আর কোনোদিন কবিতকে ছাড়তে পারিনি বা বলা যায় কবিতাই আর নিস্তার দিলোনা আমায়।

কিন্তু এরপর থেকে যা কিছু লিখেছি সবই বাংলায়। তিনি বলেছেন – আমি বেঁটে, রোগা, দুর্বল তার ওপর আমি তোতলা। এই সব প্রকৃতি দত্ত বঞ্চনার এই ক্ষতি পূরণের এক মাত্র উপায় সাহিত্যচর্চা। নোয়াখালিতে ‘বিকাশ’, ‘পতাকা’ হাতে লেখা মাসিক পত্রিকার প্রধান লেখক, লিপিকার ও সম্পাদক হলেন ‘তোষিনী’, ‘অর্চনা’ ও ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় মুদ্রিত হলো তার লেখা।

১৯২৬ এর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম দেখেন রবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় এই উপলক্ষে লেখা কবিতা সংবর্ধনা সভায় পাঠ হয়। আই.এ. পরীক্ষবার পর রচিত ‘বন্দীর বন্দনা’ সম্পর্কে কবি বলেছেন, হঠাৎ একদিন দুটো লাইন ভেসে উঠলো –

“যৌবনের উচ্ছসিত সিন্ধুযতটভুমে

বসে আছি আমি।

অমাবস্যা পুর্নিমার পরণয়ে আমি পুরোহিত।”

লিখেই আমার অনুভুতি হলো – এটা ঠিক, এটা হয়েছে, এটা সত্যি। আমি যেন পায়ের তলায় মাটি পেলাম। আমার বয়স তখন সতেরো পেরিয়ে আঠারো চলছে। এতো স্বল্প পরিসরে তাঁর গ্রন্থসমুহ নিয়ে আলোচনা করাতে বিরত থেকে বরঞ্চ তাঁর শেষ জীবন ও মৃত্যুকাল নিয়ে কিছু লেখা যাক।

জীবনের শেষ দশকে বুদ্ধদেব বসু কলকাতা শহরের উপকন্ঠে নাকতলায় প্রতিভা বসুর উদ্যোগে নির্মিত বাড়ীতে বাস করেন।

১৯৬৬ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থাবলী

১৯৬৬ সালের জুন থেকে ২০২ রাসবিহারী এভেনিউর ভাড়া ফ্ল্যাট ছেড়ে নেতাজী সুভাষ বসু রোডের (কলকাতা – ৪৭) কবিতাভবনে ওঠেন ১৯৭৪ মার্চ ১৮ পর্যন্ত এখানেই থাকেন। তপস্বী ও তরঙ্গনী, মরচে পড়া পেরেকের গান, পাতাল থেকে আলাপ, রাত ভরে বৃষ্টি, তুমি কেমন আছো, হোল্ডালিনের কবিতা, গোলাপ কেন কালো, কলাকাতার ইলেকট্রা ও সত্যসন্ধ আয়নার মধ্যে একা, কালসন্ধ্যা, বিপন্নবিষ্ময়, পুনর্মিলন, রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা, অনান্মী ও প্রথম পার্থ একদিন, রুকমি, চিরদিন ও অন্যান্য কবিতা, স্বাগত বিদায় ও অন্যান্যকবিতা, প্রেমপত্র, আমার ছেলেবেলা, ইত্যাদি।

কলকাতায় মৃত্যুবরণ

১৮ মার্চ তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন মস্তিস্কের রক্তক্ষরণে রাত তিনটেয়৬৫ বছর ৩ মাস ১৭ দিন অবসানে ক্যালকাটা হসপিটালে। প্রতিভা বসু তাঁর ‘জলছবি’ -তে এই ভাবে শেষ লগ্নের ছবি এঁকেছেন – দেখলাম, কার্তিক পাঁজাকোলা করে তার বাবুকে শুইয়েদিচ্চে। …বুদ্ধদেব চাকা ওয়ালা চেয়ারের শব্দে আমার দিকে পুর্ন দৃষ্টিতে তাকালেন বললেন – ‘রানু’।

এই ‘রানু’ শব্দই শুধু শুনতে পেলাম। তারপর জড়িয়ে জড়িয়ে কি যেন বললেন। বোঝা গেল না। আমি কোনোরকমে নিজেকে সংযত রেখে তাঁর বুকে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম – এখন কথা বলো না। পরে শুনবো।

তথাপি আরো দু’বার ডাকলেন – রানু রানু। তারপরেই চোখ বুজে নিঃশব্দ হলেন। …দেখতে দেখতে মিমি, জ্যোতি এসে গেল, নরেশ চিনু এলো সুবীর এলো চিনু কাকে ফোন করলো। তারপরেই ঘরের আলো নিভে গেলো। দেখতে দেখতে রাত ঘন হলো। গভীর হলো, কখনো বসছি, কখনো শুচ্চি, যখন ভোর হয়ে এলো, তখন মিমি আর অমিয় নত মুখে ঘরের মধ্যস্থলে এসে দাঁড়ালো।

কিছু বলতে হলোনা, কিছু শুনতে হলো না, আমি জানলাম যে চলৎশক্তি থেকে বঞ্চিত হয়েও আমার অন্য দুটি চলমান পায়ের জন্য আমি যথেস্থ শাস্তি ভোগ করছি না, সে দুটি পা-ও কেড়ে নিয়ে ঈশ্বর আমাকে সত্যি পঙ্গু করলেন।

- Advertisement -
- Advertisement -

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- Advertisement -
Back to top button