অপরাধ, শাস্তি ও আত্মশুদ্ধি: ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কির উপন্যাসের উপর একটি বিশ্লেষণ
রুশ সমাজের প্রতিচ্ছবি: দস্তয়েভ্স্কির উপন্যাসের বিষয়বস্তু
ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কি (১১ নভেম্বর ১৮২১ – ৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৮১)। পিতা মিখাইল আন্দ্রেইয়ে ভিচ মস্কোর পৌর দাতব্য চিকিৎসক। আটটি সন্তানের জননী ফিয়োদরের মা মারিয়ার মৃত্যু হয় সাঁইত্রিশ বছরে ক্ষয় রোগে।
তখন ফিয়োদরের বয়স চোদ্দো, দাদা মিখাইলের পনেরো। আর বাবা আন্দ্রেইয়েভিচ রহস্যজনক ভাবে ভূমিদাসদের হাতে নিহত হন। তখন তাঁরা দু’ভাই আঠারো ও উনিশ। পেতেবুর্গের সামরিক ইঞ্জিনিয়ানিং একাডেমিকে ভর্তি হয়ে যথাসময়ে ড্রাফটস ম্যান পদে নিযুক্ত হয়েও বছর পরে ইস্তফা দিলেন ১৮৪৪ সালে।
১৮৪৫ সালে মে-জুন মাসে পেতেবুর্গে থাকা কালীন একটা কিছু লেখার জন্য তাঁর মন হাঁকপাক করছে। অনেক কাটাকুটি করে সাত আট মাসে লিখে ফেললেন ‘পুওর ফোক’। জানাশোনা কেউ নেই একমাত্র গ্রিগরোভিচ ছাড়া। গ্রিগরোভিচ ‘স্বদেশ বৃত্তান্ত’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক কবি নেক্রাসিভের সঙ্গে দস্তয়েভ্স্কির পান্ডুলিপি পড়তে বসলেন।
তাঁরা ভেবেছিলেন গোটা দশেক পাতা পড়বেন কিন্তু পড়তে পড়তে ১১২ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি সারা রাত ধরে পড়া ছাড়া উপায় রইলো না। দুজনেরই দু’গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে এতো পরিচিত আঙ্গিকের নয়!
সাদামাঠা ভাষা তবু মর্মান্তিক বাস্তবতা! ভোর চারটে তখন। এখনই দস্তইয়েভস্কির কাছে যাওয়া দরকার। ঘুমের সময় তো কি! ব্যাপারটা ঘুমোনের চেয়ে বেশী গুরুত্বপুর্ন। দুয়ারে ঘন্টি শুনে দস্তইয়েভস্কি দরজা খুললে দুজনে অশ্রুসজল চোখে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন অভিনন্দন, আবেগ, উচ্ছাস,আর রুশ সাহিত্য, গোগল…
দুজনে বিদায় নিলে দস্তয়েভ্স্কির ঘুম টুটে গেলো। সেই দিনই, “নতুন গোগলের আবির্ভাব হয়েছে” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে নেক্রাসভ তখন কার দিনের সাহিত্য সমালোচনা জগতের একচ্ছত্র অধিপতি বেলিনস্কির কাছে উপস্থিত হলেন। লেখক অপরিচিত। বেলিনস্কি মজা করলেন – “তোমাদের কাছে তো গোগল ব্যাঙের ছাতার মতো গজাচ্ছে!”
কিন্তু সন্ধ্যেতে যখন বেলিনস্কির কাছে এলেন বেলিনস্কি পান্ডুলিপি পড়ে ফেলেছেন, “নিয়ে এসো নিয়ে এসো… তাড়াতাড়ি লেখক কে নিয়ে এসো।” ১৮৪৬ এর ২১ জানুয়ারী নেক্রেসভের পেতেবুর্গ সাহিত্য বার্ষিকিতে ছাপা হওয়ার আগেই সোৎসাহে বইটির সমালোচনা লিখে ফেললেন বেলেনস্কি।
‘পুওর ফোক’ আবির্ভাবের সঙ্গে রুশ সাহিত্য জগত তোলপাড় হয়ে গেলো ছড়িয়ে পড়লো ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কি সাফল্য। দস্তইয়েভস্কি বলেছেন পরে – কী যে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতো লাগলো। ভক্ত থেকে সবাই স্তাবক হয়ে উঠলো। ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কি এ বলছে, ও বলছে কারো মুখে আর কোন কথা নেই।
এক যশাকাঙ্খী উঠতি লেখকের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া কথা। কিন্তু গোগলের প্রকৃতিবাদী ধারার বাহক হয়ে সাহিত্যজগতে দস্তইয়েভস্কির এই ভাবে প্রবেশ বোধহয় একটা ছলনা ছিলো। নেক্রাসভ যতই উল্লসিত হয়ে, “নতুন গোগলের আবির্ভাব হয়েছে” বলুন দস্তয়েভ্স্কি ‘ওভারকোট’ এই সীমাবদ্ধ্ব থেকে যেতেন গোগলের প্রকৃতি বাদী বিচারমূলক বাস্তবতার ধারক বা বাহক বলে পরিচিত হয়ে থাকতেন।
রচনার অব্যবহিত পরেই কিন্তু দস্তয়েভ্স্কি তাঁর লেখার সুর পাল্টে ফেললেন। এই সময়ের লেখা ‘দ্য ডাবল (১৮৪৬)’ উপন্যাসটি একই মানুষের মধ্যে দুর্বল ও শক্তিমান দুই সত্তার যুগবৎ অবস্থান, দুইযের সংঘাত ও তার শোচনীয় পরিণতি। অতি নাটকীয় হলেও ‘দ্য ডাবল’ ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কির পরবর্তী পরিণত সাহিত্যসৃষ্টির আদিরুপ।
এর পরের রচনাগুলির মধ্যে ‘হোয়াইট নাইটস (১৮৪৮)’ ছাড়া আর কোন লেখা পাঠক মহলে তেমন সাড়া জাগায় নি। বেলিনস্কি এমন কথাও বললেন যে, তিনি ভুল ঘোড়ার ওপর বাজি ধরেছিলেন। তিনি বন্ধু মহলে হাসিঠাট্টার পাত্র হয়ে দাঁড়ালেন। মজার মজার ছড়া তাঁর নামে প্রচলিত হলো। তাঁকে রুশ সাহিত্যের ‘নাকের ডগায় ফুসকুড়ি’ বলে আখ্যা দেওয়া হলো।
১৮৪৬ সালে ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কি বলছেন, “পেতেবুর্গ এখন আমার কাছে নরক। কী ভয়ংকর এখানে বাস করা। খ্যাতি যেমন দ্রুত এসেছিলো, তেমন দ্রুত হাতছাড়া হবার উপক্রম হলো।”
তাঁর একধরণের স্নায়ু দুর্বলতা ছিল বরাবরই। এই সময়ে সাহিত্যিক মহলে যে সমস্ত অপ্রীতিকর ঘটনায় তাঁর খিটখটে মেজাজের ফলে ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পরতেন তা বহু সময় কেলেংকারি পর্যায়ে পৌঁছতো। এই সময় তাঁর মুর্ছার মতো একটা আবেশ তৈরী হতো তবে তা মৃগী রোগ নয়, লেখকের কথায়।
হৃতগৌরব ফিরে পেতে তা থেকে মুক্তিলাভের জন্য তিনি সময় সময় জুয়াখানায় চলে যেতেন, জুয়ারী আর মাতালদের অন্ধকার জগতে ঢুঁ মারতেন, কিন্তু সেখানকার ক্লেদ থেকে মুক্ত হয়ে একটা স্বপ্নের ঘোর তাঁকে সৃষ্টি সুখের উল্লাস তাঁকে অভিভূত করে ফেলতো।
স্নায়ু রোগ ও ফুসফুসের দুরারোগ্য ব্যধির কবলে চিকিৎসকের নিষেধ ছিলো বাড়তি পরিশ্রম। অথচ তিনি সারা রাত জেগে কাজ করতেন। সাহিত্যচর্চা ছিলো তাঁর জীবন চর্চা। সাহিত্য ক্ষেত্রে অসাফল্যর ফলে তিনি যখন উচ্ছৃঙ্খল ও উদভ্রান্ত জীবন যাপন করছেন তখন যেন আরও বেশী বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়লেন, বিষয় টি হয়ে উঠলো তাঁর আত্মানুসন্ধানের একটি উপায়।
১৮৪৭ এর কোনো এক সময়ে তিনি পেতেবুর্গ -এর বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী প্রগতিশীল পাঠচক্রে যাতায়াতের সময় স্বৈরতন্ত্রী বিরোধী সংগ্রামের উদ্দেশ্যে এক গোপন সংঘটনে যোগ দেন। ১৮৪৯ এ এই পাঠচক্রের ওপর রাজরোষ নেমে এলো ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কি গ্রেপ্তার হলেন রাজদ্রোহিতার অভিযোগে কারাদুর্গে বন্দী হয়ে ও প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়।
কিন্তু সেটা একটি সাজানো ঘটনা, একটি প্রহসন। ১৮৪৯ এর সালে। জীবন মৃত্যুর মাঝখানে কবরের মাঝে গুলি নয়, জারের সিলমোহর করা আদেশ। নির্বাসন দন্ড। সাইবেরিয়ার বন্দী শিবিরে। চার বছরের।
বধ্যভুমিতে দাঁড়িয়ে ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কির অনুভুতি – “মানুষের মাঝখানে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা, যতো বড়ো সংকট ই দেখা দিক হতাশ না হওয়া, ভেঙে না পড়া, এই হলো জীবন।” এই চিন্তার বশবর্তী হয়ে তিনি শেকসপিয়ার পড়েন, ফ্রেডরিখ শিলার পড়েন কারাদুর্গের নির্জন কক্ষে!
মাস তিনেক পরে লিখলেন – ‘অ্যা লিটল হিরো’। বললেন, “পড়ে দেখো, এর মধ্যে কোথাও কি ক্রোধের, যন্ত্রণার কোনো চিহ্ন আছে?” বন্দীশ্রম শিবিরে কাটানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখলেন – ‘নোটস ফ্রম আ ডেড হাউস (১৮৬১)’ একটা সম্পূর্ণ বাস্তব চিত্র ধরেছেন জেলখানার।
এরপর নানান টানাপোড়েন পেরিয়ে নিজ দেশে ফেরার অনুমতি পেলেন। ইতোমধ্যে এক বিধবা স্ত্রী কে বিবাহ করেন তিনি। দশ বছর পরে যখন স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পরিবেশে ফিরে এলেন ততো দিনে ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট ছিলো না। ছাপিয়ে উঠেছে আধ্যাত্মিক সমস্যা ও নৈতিক পুনরুজ্জীবনের আইডিয়া।
তাঁর লেখা ‘ডিমনস (১৮৭২)’ সালে উপন্যাসটি বহিরাগত ভাবধারার একটি জাতির আত্মবিনাশের কাহিনী। একে তিনি ‘সতর্কবাণী’ আখ্যাও দিয়েছেন। আলবের কাম্যু একে ‘প্রফেটিক’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
১৮৬৬ সালে লিখলেন ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’। এর নায়ক এক উচ্চাকাঙ্খী যুবক। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি নিখুঁত অপরাধ সংঘটন করে তার মাধ্যমে নিজেকে অতিমানব প্রতিষ্টিত করা। এর ফলে যে সামাজিক এবং সংকট অনিবার্য তা-ই এর প্রতিপাদ্য।
ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট ডিটেকটিভ ধর্মী উপকরণ দিয়ে তৈরী যদিও বলা যায় তাকে ‘Anti Ditective’ বলাই সঙ্গত। যেহেতু অপরাধী কে আমরা জানি, কিন্তু কি করে সে ধরা পড়লো না কি নিজেই ধরা দিলেন মানব মনের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে লেখক তা পরতে পরতে তুলে ধরেছেন। অথচ যখন এই লেখা তখন মনোবিজ্ঞানের জন্ম তো দুর, তার জনক ফ্রয়েড মাত্র দশ বছরের বালক।
এর দু’বছর পর ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কি লিখলেন ‘ইডিয়ট’ উপন্যাস তাতেও আছে একটি খুনের ঘটনা। দস্তইয়েভস্কির সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস তাঁর ‘দ্য ব্রাদার্স কাটমাজভ (১৮৮০)’ অধঃপতিত সমাজ ব্যবস্থার স্বরুপ ও তার যুপকাঠে বলি নবীন প্রজন্মের আত্মবলিদান এর ঘটনা।
মূল বিষয় পিতৃহত্যার ঘটনা। তাকে কেন্দ্রক রে ক’টি যুবকের আত্মজিজ্ঞাসা। তাদের মানসিক পরিবর্তন। অর্ধশতক পরে তাঁর প্রয়াণের পরে দস্তইয়েভস্কির খ্যাতি মনোবিজ্ঞানী সিগমণ্ড ফ্রয়েডের সমান্তরাল হয়ে ওঠে। ফ্রয়েডের দৃষ্ট আকর্ষণ করেছিলো মৃগীরোগ ও তাঁর বাবার শোচনীয় মৃত্যুর যোগাযোগ।
ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্টের আত্মশুদ্ধির ব্রতকথা দ্য ব্রাদার্স কারমাজভ তার পরিসমাপ্তি ঘটালো। ১৮৮১ সালে ফুসফুসের রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু ঘটলে তাঁর প্রয়াণ দিবস জাতীয় শোকের সূচনা করে।
যে বিরল সম্মান রুশ দেশের জাতীয় কবি পুশকিন ও সাহিত্য সম্রাট তলস্তয় এর ভাগ্যে জোটে নি। দস্তইয়েভস্কির তাঁর কোনো লেখাতেই ‘শেষ কথা’ বলে কিছু বলে যান নি। ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কির তাই প্রশ্নাতীত। তাঁকে নিয়ে বলা যায় –
Others Abide Our
Question Thou Art Free.
তথ্যসুত্র
অয়ন সোম
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.