ডার্ক এম্পাথি: মিথ্যা সহানুভূতির অন্ধকার দিক
কিভাবে মিথ্যা সহানুভূতি আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে এবং এর থেকে বাঁচার উপায়
প্রবন্ধের বিষয়বস্তু: মনোবিজ্ঞানের অন্ধকার দিক নিয়ে ১২তম কিস্তি। আজকের এই প্রবন্ধে আমি মনোবিজ্ঞানের ডার্ক এম্পাথি (মিথ্যা সহানুভূতি) এর কৌশল তুলে ধরবো। তাই প্রথমেই সতর্কতা, এই কৌশল সম্পর্কে জানানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, আপনি সতর্ক থাকুন এবং সতর্ক হোন যাতে করে কেউ আপনাকে ব্যবহার বা অপব্যবহার করতে না পারে। মনোবিজ্ঞানের এই অন্ধকার কৌশল কারো প্রতি প্রয়োগ করবেন না। এই কৌশলগুলো জানার পরে নিজ স্বার্থ হাসিলে তা ব্যবহার করবেন না।
আজকের আলোচনার বিষয়: ‘আমি (I)’ থেকে ‘আমরা (We)’ প্রেক্ষাপটে
বোবার কোনো শক্রু নাই: বোবার কোনো শক্রু নাই মানে হলো যিনি কথা বলতে পারেন তার কিন্তু শক্রুও আছে। “বোবার কোন শক্রু নাই” – প্রবাদটি আমাদেরকে জানান দেয়, ভাষার মত আর কোনো শক্তিশালী টুল নাই যা আমাদেরকে যোগাযোগ ক্ষমতা বা ধোকা একই সাথে দিতে সক্ষম।
নেতা ও অভিনেতার ভাষা: একটু খেয়াল করে দেখবেন নেতা থেকে অভিনেতা বেশিরভাগ সময় ‘আমরা (We)’ শব্দ ব্যবহার করেন কেন? এক নেতা হঠাৎ কোনো এক তাদের পার্টির মহাসমাবেশে এসে বলছেন, “আমরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। আসুন আমরা সবাই মিলে দেশ গড়ি।” আপনি সেদিন কোন এক কাজে উল্লেখিত মহাসমাবেশের পাশ কেটে যাচ্ছিলেন। ধরে নিচ্ছি, বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং আপনার ঐ মহাসমাবেশ বা ঐ পার্টি বা ঐ পার্টির নেতা থেকে অতিথি; কারো প্রতি-ই আপনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই, শ্রদ্ধা নাই। কিন্তু ঐ নেতা ‘আমরা’ কেন বলছেন? ঐ ‘আমরা’ এর মধ্যেও কি এই আপনি পড়েন? নিশ্চয় নয়।
অযাচিত ‘আমরা’ এর ব্যবহার: তাহলে কেন অযাচিত ও জোরপূর্বক এই ‘আমরা (We)’ উনার বক্তব্যে আপনার অনুমতি ছাড়াই ঢুকে গেল? উনি কি ‘আমরা (We)’ বলার সময় আপনার থেকে অনুমতি নিয়েছিলেন? নিশ্চয় নেন নি। তাহলে কি আপনি দেশের নাগরিক নন? মানে আপনার ‘সম্মতি’ ছাড়াই আপনাকে নিয়ে উনি এই যুক্ত ‘আমরা (We)’ নিয়ে দেশ গড়তে চাইছেন। না, উনার বক্তব্যের কারণে আপনার নাগরিকত্বের কিছুই যাবে বা আসবে না। কিন্তু ঐ মহাসমাবেশের ভীড়ের মধ্যে যারা আছেন তারা নিজেদেরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করার অনুরোধ পাবেন। পার্টি উদার, তাই সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চায়। আচ্ছা, কোন পাগল এসব মানবে বলুন তো? কোনো দল/পার্টি এত উদার কি চাইলেও হতে পারে! নাহ্।
মিথ্যা অনুরোধ ও সহানুভূতি: কিন্তু যারা যারা মহাসমাবেশে উপস্থিত হয়েছেন তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ অনুভব করানো, পার্টির কাজ করিয়ে দেবার জন্য নির্দেশ নয়, অনুরোধ করা; যা অবশ্য মিথ্যা অনুরোধ। এছাড়াও “আমাদের জীবন… আমাদের কষ্ট… আমাদের দীনতা… আমাদের সমস্যা…” – এই সবখানে ‘আমরা/আমাদের (We/Us)’ লাগিয়ে একধরণের মিথ্যা বা মায়ার সহানুভূতি অর্জন করা সম্ভব। ব্যক্তি নিজেকে এই ‘আমরা’ শব্দের মধ্যে দিয়ে ঐ পার্টির সাথে একধরণের যোগাযোগ ও সম্পৃক্ততার তার খুঁজে পেতে পারেন। আবার জরুরী নয় দেশে একজনও সহীহ্ নেতা নাই। অবশ্য তাঁদের ‘আমরা (We)’ শব্দ শুনলেই গায়ে কাঁপুনি দেবে। নেমে পড়বেন মাঠে, এবং সবাইকে নিয়ে চিন্তা করার মত উদারতা আপনার মধ্যেও তৈরি হবে। কিন্তু ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হতে পারে না।
ব্যক্তিজীবনে ডার্ক এম্পাথি
কর্মক্ষেত্রে মিথ্যা সহানুভূতি: ব্যক্তি পর্যায়ে, কেউ যদি ‘আমরা (We)’ বলেন তাহলে সাবধান হওয়া আরো বেশি জরুরী। ধরা যাক, আপনার কোম্পানির ম্যানেজার খুবই ভালো। একদিন আপনি খুব চেষ্টা করেও একটি কাজ করতে পারছেন না। ওদিকে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখছেন, সময় বিকেল ৪টা। মানে আপনার ছুটির ঘন্টা বেজে গেছে। ম্যানেজার অফিস থেকে বের হবার আগে আপনার কানে কানে বললো, “জনাব ক, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমরা আগামীকাল পুরো প্রজেক্টের ম্যাপিং একসাথে করে সন্ধ্যার দিকে সবাইকে দেখাতে পারবো না, অবশ্য দেরি না-হোক সেটাই আমাদের চাওয়া।” আপনি সাধারণ কর্মী, হয়তো ঐ প্রজেক্টের পুরো ম্যাপের জন্য আরো কিছু হিসাব-নিকাশ ও তথ্যের দরকার।
কিন্তু ম্যানেজার যখন আপনাকে সহানুভূতি দেখালো তখন আপনি আরো অতিরিক্ত ১ ঘন্টা কাজ করে উক্ত প্রজেক্টের ম্যাপিং আগামীকাল সন্ধ্যায় দেখানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু আপনার কাজের ডেডলাইন তো আগামীকাল নয়। আবার অতিরিক্ত ১ ঘন্টা খাটার কারণে আপনি অতিরিক্ত পয়সাও পাবেন না। এখন ঐ এম্পাথি বা সহানুভূতি যদি মিথ্যা সহানুভূতি হয়, তাহলে? কেমন লাগবে? খুব সম্ভবত মোটেই ভালো লাগবে না। আরো বেশকিছু বিষয় থাকে, যেমন, ম্যানেজার নিজে এসে আপনার সাথে বসে আর আধা ঘন্টায় কাজটা শেষ করলেন না কেন?
মিথ্যা সহানুভূতির প্রভাব: ম্যানেজারের নিজের ডেডলাইন আগামীকাল, আপনার নয় তাহলে ম্যানেজার একাই বাকি কাজটুকু সামাল দিলে পারতেন না? এরকম আরো হাজারো সম্ভাব্য সমাধান বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত ১ ঘন্টা খাটলেন আপনি। বাসায় দেরি করে ফিরলেন আপনি। বাজার করতে দেরি হলো আপনার। হয়তো সেদিন রাতের বিশেষ ডিনার মিস! ইত্যাদি ইত্যাদি…
কর্পোরেট উদাহরণ
কর্পোরেটে যারা আছেন তাদের কাছে নিশ্চয় এরচেয়ে ভালো ভালো উদাহরণ আছে। তারা অবশ্য এসব মিথ্যা সহানুভূতি কে মোটেই পাত্তা দেন না। কারণ এসব মিথ্যা ও মায়া। কিন্তু আমি-আপনি নিয়মিত এসব সমস্যার মধ্যে পড়তে পারি। আর অনেক লঘু মানের উদাহরণ ছিলো। ব্যাপক ডার্ক এম্পাথি দেখা যায় আজকাল। সেগুলো আবার এত জটিল আমি আপনাকে পুরোটা বুঝাতে হয়তো সক্ষম হবো না।
নিশ্চয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘আমি (I)’ মানে কি? ‘আমরা (We)’ মানে কি? এসব বুঝা যায়। কিন্তু ব্যক্তিজীবনেও এমন হাজারো ‘ফেইক এম্পাথি (মিথ্যা সহানুভূতি)’ থাকে যা আমরা বেশিরভাগ সময় টেরই পাই না।
ডার্ক এম্পাথির প্রতিকার
সচেতনতা বৃদ্ধি: ডার্ক এম্পাথি থেকে বাঁচার প্রথম ধাপ হলো সচেতনতা বৃদ্ধি। যখনই কেউ ‘আমরা’ শব্দ ব্যবহার করে আপনার সাথে কথা বলবে, তখন একটু ভেবে দেখুন, এই ‘আমরা’ আসলেই কি আপনাকে অন্তর্ভুক্ত করছে? নাকি এটি শুধুমাত্র একটি কৌশল?
নিজের সীমা নির্ধারণ: কর্মক্ষেত্রে বা ব্যক্তিজীবনে, নিজের সীমা নির্ধারণ করুন। ম্যানেজার বা সহকর্মী যদি অতিরিক্ত কাজের জন্য আপনাকে চাপ দেয়, তবে বিনয়ের সাথে নিজের সীমা জানিয়ে দিন।
মিথ্যা সহানুভূতি চিহ্নিত করা: মিথ্যা সহানুভূতি চিহ্নিত করার জন্য কিছু লক্ষণ রয়েছে। যেমন, কেউ যদি সবসময় ‘আমরা’ শব্দ ব্যবহার করে এবং আপনাকে অতিরিক্ত কাজের জন্য চাপ দেয়, তবে এটি হতে পারে মিথ্যা সহানুভূতির একটি উদাহরণ।
নিজের মূল্যায়ন: নিজের কাজের মূল্যায়ন করুন এবং দেখুন আপনি কতটুকু কাজ করতে সক্ষম। অতিরিক্ত কাজের চাপ নিলে আপনার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে।
সহানুভূতির প্রকৃত অর্থ: সহানুভূতি মানে হলো অন্যের কষ্ট বুঝতে পারা এবং তাদের সাহায্য করা। কিন্তু মিথ্যা সহানুভূতি মানে হলো অন্যের কষ্টকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা। তাই প্রকৃত সহানুভূতি এবং মিথ্যা সহানুভূতির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে শিখুন।
ডার্ক এম্পাথির উদাহরণ
ব্যক্তিগত সম্পর্ক: ব্যক্তিগত সম্পর্কেও ডার্ক এম্পাথি দেখা যায়। যেমন, একজন বন্ধু যদি সবসময় আপনার সমস্যাগুলোকে নিজের সমস্যা হিসেবে উপস্থাপন করে এবং আপনাকে সাহায্য করার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল করে, তবে এটি ডার্ক এম্পাথির একটি উদাহরণ হতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই ডার্ক এম্পাথি ব্যবহার করে। যেমন, কেউ যদি সবসময় নিজের পোস্টে ‘আমরা’ শব্দ ব্যবহার করে এবং আপনাকে তার মতামতের সাথে একমত হতে বাধ্য করে, তবে এটি ডার্ক এম্পাথির একটি উদাহরণ হতে পারে।
পরিবারে: পরিবারের সদস্যরাও ডার্ক এম্পাথি ব্যবহার করতে পারে। যেমন, একজন পরিবারের সদস্য যদি সবসময় নিজের কাজের জন্য আপনাকে সাহায্য করতে বলে এবং আপনার কাজের গুরুত্বকে উপেক্ষা করে, তবে এটি ডার্ক এম্পাথির একটি উদাহরণ হতে পারে।
ডার্ক এম্পাথি থেকে বাঁচার উপায়
সীমা নির্ধারণ: নিজের সীমা নির্ধারণ করুন এবং অন্যদের সাথে স্পষ্টভাবে যোগাযোগ করুন। যদি কেউ আপনার সাথে ডার্ক এম্পাথি ব্যবহার করে, তবে বিনয়ের সাথে তাদেরকে জানিয়ে দিন যে আপনি এই ধরনের আচরণ মেনে নেবেন না।
সচেতনতা বৃদ্ধি: ডার্ক এম্পাথি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করুন এবং অন্যদেরকেও সচেতন করুন। যখনই কেউ আপনার সাথে মিথ্যা সহানুভূতি দেখাবে, তখন তা চিহ্নিত করুন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন।
নিজের মূল্যায়ন: নিজের কাজের মূল্যায়ন করুন এবং দেখুন আপনি কতটুকু কাজ করতে সক্ষম। অতিরিক্ত কাজের চাপ নিলে আপনার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে।
সহানুভূতির প্রকৃত অর্থ: সহানুভূতি মানে হলো অন্যের কষ্ট বুঝতে পারা এবং তাদের সাহায্য করা। কিন্তু মিথ্যা সহানুভূতি মানে হলো অন্যের কষ্টকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা। তাই প্রকৃত সহানুভূতি এবং মিথ্যা সহানুভূতির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে শিখুন।
উপসংহার
ডার্ক এম্পাথি বা মিথ্যা সহানুভূতি আমাদের জীবনের একটি বাস্তবতা। এটি থেকে বাঁচার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, নিজের সীমা নির্ধারণ এবং মিথ্যা সহানুভূতি চিহ্নিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃত সহানুভূতি এবং মিথ্যা সহানুভূতির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে শিখুন এবং নিজের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল থাকুন।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.