গণতন্ত্রে ‘আমিই সব’, গড কমপ্লেক্সের ভয়ানক পরিণতি
যখন মানুষ নিজেকে আল্লাহ্/ঈশ্বর মনে করে: একটি মনোবিজ্ঞানী মূল্যায়ন
আমাদের সবার মধ্যেই সৃষ্টি করার একধরনের প্রবণতা থাকে। সৃষ্টি এবং স্রষ্টার মধ্যে একটি গভীরতম সম্পর্ক বিদ্যমান। আমরা সবাই কিছু না কিছু রোজরোজ তৈরি করছি। যিনি একটি বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি নিজেকে উক্ত বাড়ির নির্মাতা বলে থাকেন বা দাবী করে থাকেন। সুন্দর ও গোছানো বাড়ি নির্মাণ করতে পারলে হতে পারে তিনি প্রায়শই ঐ বাড়ি নিয়ে গর্ব করে বলে বেড়াবেন। তিনি চাইলে তার ঐ সৃষ্টির জন্য নিজেকে পার্থিব কোনকিছুর স্রষ্টা বলে দাবী করতে পারেন।
প্রশ্ন হলো, এই প্রবণতা কোন ব্যক্তিকে পুরোপুরি নিজের কব্জায় নিয়ে নিলে কী ঘটতে পারে?
কথা বলছিলাম ‘গড কমপ্লেক্স (God Complex)’ নিয়ে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে এমন অনেক বিখ্যাত ও ক্ষমতাশীল ব্যক্তিবর্গ ছিলেন যারা নিজেকে একেবারে আক্ষরিকভাবেই স্রষ্টা/আল্লাহ্/ঈশ্বর হিসেবে দাবী পর্যন্ত করেছেন (নাউজুবিল্লাহ)। এই ব্যক্তিগণ তাদের সাফল্যকে, ক্ষমতাকে, প্রাচুর্যকে তুলনা করেছেন স্রষ্টার সাথে। তারা নিজেদের ইতিহাসের বিভিন্ন পাতায় আলাদা আলাদা টাইমলাইনে নিজেকে স্রষ্টা বলে দাবীও করেছেন। প্রশ্ন হলো, এই ‘গড কমপ্লেক্স (God Complex)’ শুধু ইতিহাসের পাতায় বিদ্যমান নাকি বর্তমানেও এমন মানুষ আছেন?
বর্তমানে ‘গড কমপ্লেক্স (God Complex)’ এ ভুগছেন এমন মানুষের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরলাম:
১. অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস (Over Confidence): অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং গড কমপ্লেক্সে ভোগা ব্যক্তি নিজেকে নিজের যেটুকু যোগ্যতা বা ক্ষমতা আছে তার চেয়ে বেশি নিজেকে যোগ্য ও ক্ষমতাবান মনে করেন। তিনি প্রায়শই নিজেকে সুপিরিয়র এবং অন্যদের ইনফেরিওর হিসেবে দেখে থাকেন।
২. উচ্চ আত্মসম্মান (High Self-Esteem): গড কমপ্লেক্সে ভোগা এই ধরণের ব্যক্তি নিজেকে অতি মূল্যবান মনে করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, তিনি যা করছেন বা বলছেন সেটাই একমাত্র সহীহ্; বাকিসব ভুল। তিনি আরো মনে করেন, একই কাজ তিনি শুধু অন্যদের চেয়ে একটু নয়, অনেক ভালো করতে পারেন। মানে তার মত পারফেক্ট নেতা বা অভিনেতা কেউ নাই। যোগ্যও কেউ নাই। ক্ষমতাবানও কেউ নাই।
৩. দায়িত্বহীনতা (Lack of Accountability): গড কমপ্লেক্সে ভোগা মানুষ কোন ভুলের জন্য মোটেই নিজেকে দোষারোপ করতে রাজী নন। যত ভুল সব বাকিদের, আর যা কিছুই ঠিক তা তিনি করছেন। দায়িত্ব যখন থাকে তখন সেখানে ভুলও থাকে কিন্তু এই ধরণের মানুষ (নেতা) সেটা স্বীকার করতে রাজী কখনোই হবেন না।
৪. নেতৃত্বের প্রবণতা (Leadership Tendencies): যেহেতু এই গড কমপ্লেক্সে ভোগা ব্যক্তি মনে করেন যে, তিনি সর্বেসর্বা, সর্বোজ্ঞানী, সবচেয়ে বেশি যোগ্যতা এবং ক্ষমতা আছে সুতরাং তিনি নেতা হবার জন্য যথেষ্ট যোগ্য। তাই যে কোন পরিবেশে-ই এই ধরণের মানুষকে নেতা বনে যাওয়ার খুব শখ থাকে। চাই উক্ত কাজ সম্পর্কে এদের ধারণাও যদি না থাকে তবুও তিনি নেতা হবেন, বা হতে চাইবেন।
কেন এই ‘গড কমপ্লেক্স (God Complex)’ ঘটে?
মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী, এর প্রধান কারণ হলো, ‘Narcissistic Personality Disorder (NPD)’। এই ধরণের মানুষ স্রেফ নিজেকে নিয়ে ভাবেন। নিজের যোগ্যতা এবং ক্ষমতাকেও সবসময় উঁচু জায়গায় রাখেন। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে দেখা যায়, প্রাচুর্য এবং বিগড়ে যাওয়া শৈশব। অতিরিক্ত প্রশংসা এবং দায়িত্বহীন ভাবে বেড়ে ওঠা। আবার বড় হবার পর এদের সাফল্যকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো এবং বিশ্বাস করানো যে, তার বিকল্প নাই। তিনি এই সমস্ত প্রশংসা ও সাফল্য ডিজার্ভ করেন। তিনি-ই তো আমাদের মশীহ্! এবং তিনি আমাদের পথ দেখাবেন বা নেতা পর্যন্ত হবেন।
এখান থেকে নতুন আরেকটি প্রশ্নের উদ্ভব হতে পারে। আর তাহলো, কেউ যদি ‘গড কমপ্লেক্স (God Complex)’ ভোগেন তাহলে আমাদের সমস্যা কি? সমস্যা আছে, কেউ যদি গড কমপ্লেক্সে ভোগেন তাহলে বাকিদের জন্য সেটা ভয়ানক ঝামেলার হতে পারে। এদের ‘সমালোচনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি (Critical Perspective)’ জ্ঞানীয় পক্ষপাত দুষ্ট। ফলে সবসময় এরা অন্যদের ভুল ধরে। অন্যদের নিয়ে সমালোচনা করে। এতে করে আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি এবং মোরাল সংকট দেখা দিতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ‘নিয়ন্ত্রণ করা (Controlling)’। মানে এরা সবকিছুই নিজের আইডিয়া মোতাবেক চালাতে চায়। অন্যদের আইডিয়া বা চিন্তাকে খারিজ বা বাতিল করে দেয়। এরা কখনোই চাইবে না যেখানে এরা আছে সেখানে এদের দর্শনের বা ইচ্ছার বাইরে কিছু ঘটুক। সার্বক্ষণিক এই নিয়ন্ত্রণের চিন্তা বাকিদের কাজের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে বাধ্য। তিনি যে কোম্পানিতে কাজ করবেন, তিনি যে রাষ্ট্রে কাজ করবেন সেখানে সবকিছুই তার মোতাবেক হতে হবে।
সর্বশেষ, ‘ম্যানিপুলেশন (Manipulation)’ প্রকৃতির এই ধরণের মানুষ নিজের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে অন্যকে ব্যবহার করার সময় কিন্তু একবারও ভেবে দেখেন না। তিনি সবসময় চাইবেন যে, তার স্বার্থ কীভাবে পূরণ করা সম্ভব? এতে পুরো পৃথিবী জাহান্নামের আগুনে জ্বলুক তাতেও তার কিচ্ছু আসে বা যায় না। তিনি তার উদ্দেশ্য এবং দর্শনে ভয়ানক কট্টর। তিনি স্রেফ এবং স্রেফ নিজেকে নিয়ে ভাবতে পছন্দ করেন।
এখন চিন্তা করুন, এই ধরণের একটি মানসিক রোগী যদি কোন দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান হোন তাহলে আমাদের সাথে কি ঘটতে পারে? আমাদের কে নিয়ে কতটুকু চিন্তা করতে পারবেন? এদের কাছে ক্ষমতার সিট আগে নাকি আমাদের অধিকার আগে? ক্ষমতা, স্বার্থ এবং প্রাচুর্যের বাইরে গিয়ে আপনার কি মনে হয় এরা আমাদের নিয়ে কিছুটা হলেও ভাববে? অথচ যিনি কিনা নিজেই মানসিক সমস্যার সাথে জড়িত! বাকি আপনি সমঝদার।
ছবি: Image by freepik
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.