হাসান আজিজুল হক: ষাটের দশকের কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক
বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবন ও কর্মের বিবরণ
হাসান আজিজুল হক ছিলেন ষাটের দশকে আবির্ভূত একজন বিখ্যাত বাংলাদেশী কথাসাহিত্যিক। তিনি তার সুঠাম গদ্য এবং মর্মস্পর্শী বর্ণনাভঙ্গির জন্য প্রসিদ্ধ। অর্থাৎ তিনি একজন বাংলাদেশী ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার। জীবনসংগ্রামে লিপ্ত মানুষের মুখের কথাই তার গল্প এবং উপন্যাসের প্রধানতম অনুষঙ্গ। রাঢ়বঙ্গ তার অনেক গল্পের পটভূমি।
তিনি আর অন্য কেউ নন, তিনি হলেন আগুনপাখি (২০০৬) উপন্যাসের লেখক শ্রদ্ধেয় স্যার হাসান আজিজুল হক। আগুনপাখি তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস।
প্রারম্ভিক জীবন
হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এক সম্ভ্রান্ত এবং একান্নবর্তী পরিবারেই তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ দোয়া বখশ্ এবং মাতার নাম জোহরা খাতুন।
হাসান আজিজুল হক তার জীবনের অধিকাংশ সময় রাজশাহীতেই কাটিয়েছেন। তার নিজস্ব বাসভবন ‘উজান’ রাজশাহীতেই। এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব দিকে ‘বিহাস’ এ।
শিক্ষাজীবন
- ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৬ সালে খুলনার শহরের অদূরে দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন হাসান আজিজুল হক।
- ছাত্র রাজনীতিতে তিনি প্রথম যৌবনেই জড়িয়ে পড়েছিলেন। আর এই রাজনীতি করার কারণেই তিনি চরম নির্যাতন ভোগ করেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে।
- হাসান আজিজুল হক দর্শন-এ সম্মান সহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন রাজশাহী সরকারি কলেজে থেকে ১৯৫৮ সালে।
- এরপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি অস্ট্রেলিয়াও গিয়েছিলেন পিএইচডি অধ্যয়নের জন্য। এমনকি তিনি মেলবোর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু দিন অধ্যয়নও করেছিলেন।
- কিন্তু অধ্যয়ন শেষ না-করেই তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশের প্রতি হাসান আজিজুল হক এর গভীর ভালোবাসা এবং টানের কারণে বিদেশের পরিবেশ তাঁর ভালো লাগেনি।
কর্মজীবন
- হাসান আজিজুল হক ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন। এর মধ্যে ছিলো রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ এবং সরকারি ব্রজলাল কলেজ।
- এরপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে। একনাগাড়ে ৩১ বছর অর্থাৎ ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।
- তারপর তিনি ২০০৯ সালে মনোনীত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদের জন্য। এবং সেই দায়িত্ব তিনি পালন করেন।
- ২০১৪ এর আগস্ট এ বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ এর সভাপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিনি সেখানে নির্বাচিত হন।
সাহিত্য জীবন
রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় হাসান আজিজুল হক এর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। রাজশাহী কলেজের উদ্যমী তরুণ মিসবাহুল আজীমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ভাঁজপত্র ‘চারপাতা’ তে হাসান আজিজুল হক এর সেই লেখাটি ছাপা হয়। রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য ছিল সেই লেখার বিষয়বস্তু। তবে হাসান আজিজুল হক সাহিত্যাঙ্গনে তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ১৯৬০ সালে ‘শকুন’ শীর্ষক গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এটি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। তবে তার সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি কৈশোর জীবনেই।
- তিনি যখন কাশীশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন তখন একটি সম্বর্ধনাপত্র রচনার মধ্য দিয়ে তার লেখালেখি জীবনের শুরু হয়। সম্বর্ধনাপত্রটি ঐ স্কুলে রাজা সৌমেন্দ্র চন্দ্র নন্দী’র আগমন উপলক্ষ্যে লিখেছিলেন তিনি।
- এছাড়াও তিনি প্রবেশিকা পাশের পরপরই ‘মাটি ও মানুষ’ নামে শীর্ষক একটি উপন্যাস লিখেন। যে রচনাটি এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত।
- ১৯৫৬ সালে নাসির উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ‘মুকুল’ পত্রিকায় তাঁর রচিত ‘মাটি ও পাহাড়’ শীর্ষক একটি গল্পও প্রকাশিত হয়েছিল। যা ‘শকুন’ গল্পটি প্রকাশের বেশ আগে।
- তার ‘লাঠি’ শীর্ষক একটি ছোটগল্প এবং ‘সাগর পারের পাখিরা’ শীর্ষক একটি কবিতা বিএল কলেজবার্ষিকীতে প্রকাশের কথাও জানা যায়। এ সময় অন্য একটি কলেজবার্ষিকীতে ‘পাষাণ বেদী’ নামে তাঁর একটি গল্পও প্রকাশ পেয়েছিল।
- হাসান আজিজুল হক সাহিত্যচর্চার প্রথম দিকে কবিতা রচনাতেও আগ্রহী হয়েছিলেন। যেমন; ‘বিনতা রায়: আমি’, ‘নিরর্থক’, ‘গ্রামে এলাম’, ‘দিনাবসান’, ‘কথা থাক’, ‘রবীন্দ্রনাথ’ ইত্যাদি কবিতাগুলো তারই রচিত। তিনি ১৯৫৭ সালে এই কবিতাগুলো রচনা করেছিলেন।
- ১৯৫৭ সালে ‘শামুক’ শীর্ষক একটি উপন্যাস রচনা করে ‘মানিক স্মৃতি উপন্যাস প্রতিযোগিতা’য় অংশগ্রহণ করেন হাসান আজিজুল হক। সেই ‘শামুক’ উপন্যাসের আংশিক প্রকাশিত হয়েছিল রাজশাহীর পূর্বমেঘ ত্রৈমাসিক পত্রিকায়। এটি সম্পাদনা করেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। এর ছয় যুগ পর অর্থাৎ ২০১৫ সালে এই ‘শামুক’ উপন্যাসিকাটি ঢাকা থেকে আবার প্রকাশিত হয়।
পুরস্কার
১৯৬৭ সালে হাসান আজিজুল হক আদমজী সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। শুধু পুরস্কারই নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আরও অনেক পুরস্কার, পদক এবং সম্মানে ভূষিত হয়েছেন এই বিখ্যাত ব্যক্তি।
বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ১৯৯৯ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়াও ২০১২ সালে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সন্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি পান।
অন্যান্য পুরস্কার ও সম্মাননা:
পুরস্কার/সম্মাননা | বছর |
---|---|
বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার | ১৯৭৩ |
অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার | ১৯৮১ |
আলাওল সাহিত্য পুরস্কার | ১৯৮৩ |
অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার | ১৯৮৪ |
ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার | ১৯৮৮ |
কাজী মাহবুবউল্লাহ ও বেগম জেবুন্নিসা পুরস্কার | ১৯৯৪ |
খুলনা সাহিত্য মজলিশ সাহিত্য পদক | ১৯৮৬ |
রাজশাহী লেখক পরিষদ পদক | ১৯৯৩ |
সাহিত্য রত্ন পুরস্কার | ২০১৮ |
সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার | ২০১৯ |
এমন আরও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক।
পারিবারিক জীবন
গল্পকার হাসান আজিজুল হক এর স্ত্রীর নাম শামসুন নাহার। তিনি ২০১৩ সালে মৃত্যু বরণ করেন। এই দম্পতি মোট চার সন্তানের জনক-জননী। তাদের মধ্যে তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তান।
মৃত্যু
কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক দীর্ঘদিন বিভিন্ন অসুস্থতায় ভোগেন। এরপর তিনি ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর তার রাজশাহীর বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে সমাধিস্থ করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে।
মজার মানুষ হাসান আজিজুল হক
বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক শুধু লেখনীতেই দুর্দান্ত ছিলেন এমনটা নয়। তিনি বেশ মজার মানুষও ছিলেন। তিনি তার কাছের মানুষগুলোর সাথে বেশ রসিকতা করে কথা বলতেন। তার সম্পর্কে এমনই কথা বলেন তার সহকর্মী মহেন্দ্রনাথ অধিকারী।
তারা একই বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। এজন্যই তাদের মধ্যে একটা বেশ ভালো সখ্যতা গড়ে ওঠে। মহেন্দ্রনাথ অধিকারীর বাসা বিহাস এর পাশেই। সেজন্য হাসান আজিজুল হক তাঁকে রসিকতা করে বলতেন যে, তিনি বিহাস এলাকায় থাকেন আর সে উপহাস এলাকায় থাকে। তার বাড়ি হচ্ছে উপবিহাসে। আর এই ‘উপবিহাস’ শব্দ থেকে ‘বি’ বাদ দিলেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ এতে শব্দটি হয়ে যায় উপহাস। এমনই মজা করে করে কথা বলতেন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক।
উপসংহার
হাসান আজিজুল হক ছিলেন একজন অসাধারণ কথাসাহিত্যিক, যিনি তার লেখনীর মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। তার গল্প ও উপন্যাসে জীবনের বাস্তবতা, সংগ্রাম এবং মানবিক অনুভূতির প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি শুধু একজন লেখকই নন, বরং একজন শিক্ষক, গবেষক এবং সমাজসেবকও ছিলেন। তার জীবন ও কর্ম আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
হাসান আজিজুল হক এর সাহিত্যকর্ম আমাদের সমাজের বিভিন্ন দিককে আলোকিত করেছে এবং আমাদের চিন্তাভাবনাকে সমৃদ্ধ করেছে। তার লেখনীতে আমরা পেয়েছি জীবনের গভীরতা, মানবিকতার মর্ম এবং সমাজের বাস্তব চিত্র। তার মৃত্যুতে আমরা একজন মহান সাহিত্যিককে হারিয়েছি, কিন্তু তার সাহিত্যকর্ম আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.