হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহঃ): বাংলার ইসলাম প্রচারক ও আধ্যাত্মিক নেতা
ইয়েমেন থেকে শাহজাদপুর: হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহঃ) এর জীবন ও কর্ম
হযরত মখদুম শাহ দৌলা ছিলেন দ্বাদশ শতকের শেষের দিকের একজন আউলিয়া-দরবেশ। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারকারী আউলিয়া-দরবেশের মধ্যে মখদুম শাহদৌলা খুবই পরিচিত ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যাক্তিত্ব। তিনি ছিলেন ইয়েমেনের তৎকালীন রাজা মুয়াজ বিন জাবালের দ্বিতীয় পুত্র। তারা ছিলেন দুই ভাই ও এক বোন। তিনি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে ইসলাম প্রচার করেন।
বাংলায় আগমন
হযরত মখদুম শাহদৌলা এমন এক সময় বাংলায় আসেন যে সময় হযরত শাহ জালাল (রহঃ) এর আগমন ঘটেনি। তিনি তার পিতার অনুমতি নিয়ে বাংলায় ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। তিনি তার বোন, খাজা কালাম দানিশমন্দ, খাজা নূর, ও খাজা আনোয়ার নামে তিন ভাগ্নে ও বারোজন দরবেশ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন।
তিনি প্রথমে আনুমানিক ১১৯২-৯৬ সালের মধ্যে ইয়েমেন থেকে যাত্রা শুরু করে বোখারা শহরে আগমন করেন। তিনি সেখানে হযরত শেখ জালালউদ্দিন বোখারি এর দরবারে কিছু সময় অতিবাহিত করেন। শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ পথ প্রদর্শনের জন্য শেখ জালালউদ্দিন রুমী মখদুম শাহদৌলাকে ধূসর বর্ণের একজোড়া কবুতর উপহার দিলেন। বোখারা হতে মখদুম শাহের দলটি বজরা নৌকায় করে শাহাজাদপুরের পোতাজিয়া নামক স্থানে এসে অবস্থান করেন। সেই সময় বর্ষার পানিতে পুরো শাহাজাদপুরকে মনে হতো সাগরের মতো।
ইসলাম প্রচারের ঘটনা
হযরত মাখদুম শাহদৌলা (রহঃ) পোতাজিয়াই পৌছে শেখ জালালুদ্দিন রুমীর দেওয়া কবুতর দুটি ছেড়ে দেন। কিছুক্ষন পর কবুতরগুলো পায়ে করে মাটি নিয়ে ফিরে আসে আর তাতেই তিনি বুঝতে পারেন আশেপাশে কোথাও কোন উঁচু জায়গা বা মানুষের বসতি রয়েছে। তারপর তিনি আশেপাশে খোজ নিয়ে বর্তমান মাজারের নিকট গিয়ে তাবু টাঙ্গিয়ে অবস্থান করেন এবং আল্লাহর একমাত্র মনোনিত ধর্ম ইসলাম প্রচার করতে থাকেন।
তিনি সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। আর এই মসজিদই হয়ে উঠে তার ইসলাম প্রচারের একমাত্র মাধ্যম। তিনি শাহাজাদপুরের বিস্তির্ণ এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। তার আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা সে অঞ্চলের মানুষকে ইসলামের আলোয় আলোকিত করেন। তার পীর ও মুর্শীদ হলেন ওস্তাদ শাহ শামসুদ্দিন তাবরেজি।
হিন্দু রাজার সঙ্গে যুদ্ধ
হযরত মাখদুম শাহদৌলা (রহঃ) যখন সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরে আসেন সে সময় সুবাহ বিহারের অধিপতি ছিলেন রাজা বিক্রম কেশরী। রাজা বিক্রম কেশরী মাখদুম শাহদৌলা এর ইসলাম প্রচারের ঘটনা শুনে তার উপর ক্ষীপ্ত হয় এবং তাকে ও তার সঙ্গীদের শেষ করার জন্য সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন কিন্তু সৈন্যবাহিনী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফিরে আসেন।
এভাবে রাজা বিক্রম কেশরী পর পর কয়েকবার সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে কিন্তু প্রত্যেক বারই সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়ে ফিরে যায়। কথিত রয়েছে যে, যুদ্ধে পরাজিত বন্দি সৈন্যদের একজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে মাখদুম শাহদৌলার নৈকট্য লাভ করেন। তবে শেষ যুদ্ধে হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহঃ) সহ তার বহূ যোদ্ধা এবং সঙ্গী শহীদ হন। এই যুদ্ধে শহীদ হওয়ার কারণেই তিনি হযরত মখদুম শাহদৌলা শহীদ ইয়েমেনী (রহঃ) নামে খ্যাতি লাভ করেন। এবং তার বোন নিজের ইজ্জত রক্ষা করার জন্য নদীতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। সেই থেকে নদীটি সতীবিবির ঘাট নামে পরিচিত। এই নদীটি মাখদুম শাহদৌলা এর মাজারের পাশেই অবস্থিত।
মৃত্যুর ঘটনা
শেষযুদ্ধ চলাকালে আসরের ওয়াক্ত হওয়ায় মখদুম শাহদৌলা নামাজ আদায় এর সময় সেজদারত অবস্থায় তার দেহ থেকে মাথা দ্বিখন্ডিত করে ফেলেন। তার মাথা সাবা বিহারের রাজধানী মঙ্গলকোটে মতান্তরে মহলকোটে নিয়ে হাজির হয়। সেই সময়টি ছিলো ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দ।
তবে দেখা যায় যে, মাখদুম শাহদৌলা এর কন্ঠ হতে অলৌকিকভাবে “সোবহানা রব্বী ইয়াল আ’লা” ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। যা দেখে রাজা বিক্রম কেশরী ভয় পেয়ে যায় এবং তার প্রধান সেনাপতি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। পরে রাজা স্থানীয় মুসলমানদের ডেকে হযরত মাখদুম শাহদৌলা এর মাথা সমাহিত করার নির্দেশ দেন। তার মাথা সমাহিত করার স্থানটিকে শেরই মাকাম বলা হয়।
মসজিদ ও মাজার
তৎকালীন মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম কারুকার্যে নির্মাণ করা হয় এই মসজিদটি। পনেরো গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণের দৈর্ঘ্য ১৩.১৯ মিটার এবং পুর্ব-পশ্চিমের দৈর্ঘ্য ১২.৬০ মিটার এবং ছাদের উপরের গম্বুজের ব্যাস ৩.০৮ মিটার। প্রত্যেকটি গম্বুজের মাথায় পিতলের কারুকার্য রয়েছে। মাজার প্রাঙ্গনের এই মসজিদটিতে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ জুম্মার নামাজ অনুষ্ঠীত হয়। প্রত্যেক শূক্রবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার ধর্মপ্রান মুসলমান জুম্মার নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে এই মসজিদে ছুটে আসেন।
হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহঃ) এর মাজার শাহজাদপুরে প্রতি বছর চৈত্র মাসে এক মাসব্যাপী মেলা হয়। মেলার সময় এখানে সকল সম্প্রদায় থেকে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। মাজারটিতে লোকজন চাল, চিনি, মিষ্টি, মোরগ এবং এক ধরনের ব্রত্মূলক বাতি (চেরাগ) উতসর্গ করেন।
হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহঃ) এর জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
ঘটনা | বিবরণ |
---|---|
জন্ম | দ্বাদশ শতকের শেষের দিকে ইয়েমেনে জন্মগ্রহণ করেন। |
বাংলায় আগমন | আনুমানিক ১১৯২-৯৬ সালের মধ্যে ইয়েমেন থেকে বাংলায় আসেন। |
ইসলাম প্রচার | শাহজাদপুরে ইসলাম প্রচার করেন এবং একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। |
যুদ্ধ | রাজা বিক্রম কেশরীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হন। |
মৃত্যু | ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে শহীদ হন। |
হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহঃ) এর উত্তরসূরীদের নাম
- ইউসুফ শাহ
- শাহ হাবিবুল্লাহ
- শাহ বদর
হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহঃ) এর মাজারে উতসর্গীয় বস্তুসমূহ
- চাল
- চিনি
- মিষ্টি
- মোরগ
- ব্রত্মূলক বাতি (চেরাগ)
হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহঃ) এর মসজিদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- গম্বুজের সংখ্যা: ১৫টি
- উত্তর-দক্ষিণের দৈর্ঘ্য: ১৩.১৯ মিটার
- পুর্ব-পশ্চিমের দৈর্ঘ্য: ১২.৬০ মিটার
- গম্বুজের ব্যাস: ৩.০৮ মিটার
- গম্বুজের মাথায় কারুকার্য: পিতলের কারুকার্য
হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহঃ) এর মাজারে মেলার তথ্য
- মেলার সময়: প্রতি বছর চৈত্র মাসে
- মেলার দৈর্ঘ্য: এক মাসব্যাপী
- মেলায় সমাগম: সকল সম্প্রদায় থেকে হাজার হাজার মানুষ
হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহঃ) এর জীবন ও কর্ম বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। তার অসামান্য আধ্যাত্মিক শক্তি ও সাহসিকতার কারণে তিনি আজও হাজার হাজার মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র।
উপসংহার
মখদুম শাহদৌলা ইয়েমেনি (রহঃ) এর মৃত্যুর পর তার অনুচররা ইসলাম প্রচার অব্যাহত রাখেন। তার উত্তরসূরী ইউসুফ শাহ, শাহ হাবিবুল্লাহ, এবং শাহ বদর এর প্রচেষ্টায় দিন দিন ইসলাম ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.