হযরত শাহ আলী বাগদাদি (রাহঃ): ইসলামের আলোকে এক মহান সুফী সাধক
বাগদাদ থেকে বাংলায়: হযরত শাহ আলী বাগদাদি (রাহঃ) এর জীবন, কারামত ও ঐতিহাসিক প্রভাব
হযরত শাহ আলী বাগদাদি (রাহঃ)
আমাদের বাংলাদেশ একদিকে যেমন সুজলা-সুফলা সবুজ দেশ, অন্যদিকে মহান আল্লাহ-তায়ালার অশেষ নেয়ামতের জায়গা। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে অনেক নবী রাসূল ও অলী আউলিয়া পাঠিয়েছেন। ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়ে মানুষকে অন্ধকার হতে আলোকময় জীবন দানে আমাদের বাংলাদেশে অনেক সুফী সাধক ও আউলিয়ার আবির্ভাব ঘটে। হযরত শাহ আলী বাগদাদি ছিলেন তাদের মধ্যে একজন।
জন্ম
হযরত শাহ আলী বাগদাদি (রাহঃ) এর জন্ম কখন, কোথায়, কিভাবে হয়েছে সেটা নিয়ে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তবে অনেকের ধারণা মতে, তার জন্ম হয় বাগদাদের ফোরাত নদীর তীরবর্তী একটি কসবাতে।
বংশ পরিচিতি
তিনি ছিলেন হযরত আলী (রাহঃ) এর বংশধর। তার পিতা ছিলেন বাগদাদের বাদশা সৈয়দ ফখ্রুদ্দিন রাজিব। শাহ আলী বাগদাদি ছিলেন তার পিতার জ্যেষ্ঠপুত্র। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভাবুক ও সংসার বিরাগী। তিনি সবসময় ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। তার পিতার মৃত্যুর পর রাজ্য পরিচালনার ভার তার উপর পড়লে তিনি তা তুচ্ছ করে আল্লাহ প্রেমে পাগল হয়ে আল্লাহ পাকের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন।
তরীকার ধারা
প্রথম থেকেই তিনি কাদেরীয়া তরীকা অনুসরণ করে থাকেন। তবে পরবর্তীতে তিনি যখন ঢাকা ও তৎসংলগ্ন এলাকার প্রসিদ্ধ চিস্তিয়া সুফী শাহ মোহাম্মদ বাহারের আস্তানায় যান, তখন তিনি চিস্তিয়া তরিকা মোতাবেক বায়াত গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি তার পীরের নির্দেশে ঢাকার মীরপুরে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন এবং সেখানে গিয়ে তিনি একটি জরাজীর্ণ মসজিদের সন্ধান পান। সেই মসজিদটিকেই তিনি ইবাদতের স্থান হিসেবে গ্রহণ করেন।
ঐতিহাসিক পটভূমি
শিয়া সুন্নীদের ধর্মবিরোধের সময় তিনি বাগদাদ নগরী ত্যাগ করে দিল্লীতে যান। পরবর্তীতে দিল্লীর শাসকদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলাকালে তিনি দিল্লী ত্যাগ করে ১৪৮৯ সালে বাংলায় পদার্পণ করেন। বাগদাদ থেকে আসার পথে তিনি শেষ নবী মোহাম্মদ (সা:) এর দুই মোবারক (পবিত্র কেশধাম), হযরত হোসাইনের জুলফ, আব্দুল কাদের জিলানীর পীরহান বংশ উত্তরাধিকারসূত্রে সাথে করে নিয়ে আসেন। দিল্লীর তৎকালীন সুলতান শাহ আলীর নিকট এত মূল্যবান জিনিস দেখার সুযোগ পেয়ে তিনি খুশি হয়ে শাহ আলী (রাহঃ) কে ফরিদপুর জেলার ১২ হাজার বিঘা জমি দান করেন। তিনি সেখানে কিছুদিন থাকার পর ঢাকার মিরপুরে চলে আসেন।
শাহ আলী (রাহঃ) এর কারামত
১. হাতের বস্তুকে বৃক্ষে পরিণতঃ হযরত শাহ আলী বাগদাদি তার অলৌকিক শক্তির দ্বারা তার হাতে থাকা বস্তুটিকে একটি বিশাল বট গাছে পরিণত করেন। বর্তমানে এই গাছটি সিন্নি গাছ নামে পরিচিত। গাছটি এখনও বাবার মাজারের পাশে রয়েছে। বহু ভক্ত ও আশিকানরা সেই গাছের নিচে মোমবাতি আগরবাতি জ্বালিয়ে মানত করেন। ২. সুন্নী গাছে আগুনঃ কয়েক বছর আগে এই সুন্নী গাছে হঠাৎ করে আগুন লেগে যায়। টানা তিন দিন চেষ্টা করেও ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে পারেনি। এমতাবস্থায় তৎকালীন খাদেমের নিকট পরামর্শ চাইলে খাদেম শাহ আলীর দরগার পানি দোহাই শাহ বাবা বলে আগুনে নিক্ষেপ করলে আল্লাহ তায়ালার রহমতে আগুন সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায়। ৩. শাহ আলীর মাজারঃ শাহ আলী (রাহঃ) এর মাজার এতোটাই উঁচু যে এমন উঁচু মাজার শরীফ বাংলাদেশে আর একটিও নেই। ৪. রহস্যজনক মৃত্যুঃ শাহ আলী বাগদাদি একদিন মনস্থির করলেন যে, তিনি চল্লিশ দিনের চিল্লা করবেন। এমতাবস্থায় তিনি তার মুরিদদের নির্দেশ দিলেন যে, চল্লিশ দিনের পূর্বে কেউ যেন হুজরার দরজা না খোলেন। এই বলে তিনি হুজরার ভেতর আল্লাহর সাথে ফানা ফিল্লাহর নামাজে রত হন। এই নামাজ তরীকা জগতে খুবই কঠিন নামাজ। জানা যায় যে, এই নামাজ পরাকালীন সময়ে আল্লাহর তরফ হতে অনেক ভয়ঙ্কর সৃষ্টির সম্মুখীন হতে হয়। এই নামাজে একটু অমনযোগ হলে আল্লাহর জালালী নূরে তার দেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তার নির্দেশ মতে মুরীদগণ চিল্লা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন কিন্তু ৩৯ তম দিনে হুজরার ভেতর থেকে ভীষণ চিৎকারের আওয়াজ আসে। মুরীদগণ তখন নিরুপায় হয়ে হুজরার দরজা খুলে দেখেন শাহ আলীর দেহ রক্তাক্ত অবস্থায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে। এবং সেই মুহূর্তে তারা একটি গায়েবী আওয়াজ শুনতে পান যেখানে বলা হয়েছে “যেখানে পড়ে আছে সেখানেই দাফন করো”। অতঃপর তাকে সেই মসজিদের ভেতরেই দাফন করা হয়। যা কখনো অন্য কোন আউলিয়া বা পীরের সম্পর্কে শোনা যায়নি।
মাজার শরীফ
হযরত শাহ আলী বাগদাদি (রাহঃ) কে যে মসজিদে দাফন করা হয়েছে সেই মসজিদই শাহ আলীর মাজার। এই মাজারটি অনেক উঁচু। প্রতি বৃহিস্পতিবার এই মাজারে বিরাট মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এই মাহফিলে দেশের নামী-দামী বাউল, ফকির, সাধু সন্ন্যাসীরা ভক্তিমূলক গানের মাধ্যমে শাহ আলী বাগদাদির গুণগান করেন। এই দিনে মাজারের আশেপাশে রাস্তায় প্রচুর ভীড় জমে।
তথ্যবহুল টেবিল
বিষয় | তথ্য |
---|---|
জন্মস্থান | বাগদাদ, ফোরাত নদীর তীরবর্তী কসবা |
বংশ পরিচিতি | হযরত আলী (রাহঃ) এর বংশধর |
তরীকা | কাদেরীয়া ও চিস্তিয়া |
আগমন | ১৪৮৯ সালে বাংলায় |
কারামত | সিন্নি গাছ, সুন্নী গাছে আগুন, উঁচু মাজার, রহস্যজনক মৃত্যু |
মাজার | মিরপুর, ঢাকা |
উপসংহার
হযরত শাহ আলী বাগদাদি (রাহঃ) এর নামে মিরপুর ১ এ একটি সড়ক নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও একটি থানা ও শাহ আলী মহিলা কলেজ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। হযরত শাহ আলী বাগদাদি (রাহঃ) কে জিন্দা অলী বলা হয়, কেননা, যদি তাকে কোন ভক্ত প্রেমভক্তিতে ডাকেন, তাহলে বাবা সাথে সাথে তার ডাকে সাড়া দিয়ে থাকেন।
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.