ইতিহাস

হযরত শাহ আমানত (রহ): চট্টগ্রামের আধ্যাত্মিক আলোকবর্তিকা

ইসলামের প্রচার, আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিক ঘটনাবলীর এক অনন্য দৃষ্টান্ত

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের চট্টগ্রামকে বলা হয় বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমি। এখানে যুগে যুগে ফকির দরবেশ ও পীর আউলিয়াদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ও প্রভাব ঘটে। যাদের দ্বারা মানুষ অন্ধ ধর্ম থেকে আলোকময় সুন্দর ও সুশীল জীবন যাপনের সন্ধান পান। তেমনই একজন আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পন্ন ফকির ও দরবেশ হলেন হযরত শাহ আমানত (রহ)। আমরা আজকে তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন

হযরত শাহ আমানত (রহ) ইরাকি আরব দেশের একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি ১০৯৫ আরবী হিজরি মোতাবেক ১৬৮৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিলো শাহ নেয়ামত (রহ)। তিনি মূলত অলীকুলের সম্রাট পীরানে পীর বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জীলানীর বংশধর ছিলেন। তার পূর্বপুরুষগণ বংশপরম্পরায় বুজর্গী ছিলেন। ১২০০ শতাব্দীর শেষের দিকে তার পূর্বপুরুষগণ বাগদাদ থেকে বিহারে চলে আসেন। বিহারের প্রখ্যাত সাধক সুফী হযরত মোনামেয় পাকচার তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন।

সুফি দর্শন

হযরত শাহ আমানত (রহ) ছিলেন কাদেরিয়ান তরিকার প্রখ্যাত সাধক। তার পিতা হযরত নায়ামত শাহ ও পিতামহ হযরত ছয়রদ্দিন শাহ (রাহ) দুজনই ইসলাম ধর্ম প্রচারে বিহারে ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই সময় ভারতের কাশ্মির, পাটনা, লৌক্ষন, মুর্শীদাবাদ ছিলো ফকির দরবেশদের মিলন ক্ষেত্র। এখান থেকেই সুফী দরবেশগণ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে বেড়িয়ে পড়তেন। হযরত আমানত শাহ সে সময় সংসারের মায়া ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে কাশ্মিরের দিকে রওয়ানা দেন। সেখানে গিয়ে তিনি তার জন্য মুর্শিদের খোঁজ করলে একজন বুজর্গ ব্যক্তি সেখান থেকে হযরত রহীম শহীদের সন্ধান দেন। তারপর তিনি হযরত রহীম শহীদের খোঁজ করে জানতে পারেন তিনি কলকাতার মুর্শীদাবাদে রয়েছেন। তারপর হযরত শাহ আমানত মুর্শীদাবাদে গিয়ে হযরত রহীম শহীদের সান্নিধ্য লাভ করেন। সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের সান্নিধ্য পেয়ে হযরত অত্যন্ত গৌরবান্বিত হলেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি মুর্শীদের সহচার্যে থেকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করে আধ্যাত্মিক জগতের শীর্ষ স্থানে পৌঁছতে পেরেছিলেন। হযরত শাহ আমানত দীর্ঘ ১২ বছর তার মুর্শিদের খেদমতে কাটিয়ে দেন। হযরত শাহ আমানতের মধ্যে প্রচুর খোদাভীতি দর্শন পেয়ে তার মুর্শিদ তাকে বালায়েতের সমস্ত ক্ষমতা প্রদান করেন। তাকে বিবাহিত জীবন যাপন, হালাল উপার্জনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা এবং চট্টগ্রামে গিয়ে ইসলাম প্রচার করার আদেশ দেন। ফলে হযরত শাহ আমানত (রহ) মুর্শীদাবাদ থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

কর্মজীবন

হযরত শাহ আমানত (রহ) ছিলেন নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী প্রকৃতির একজন আউলিয়া। তিনি চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলেন। তিনি সবসময় কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করতেন। তাই তিনি নিজের পরিচয় গোপন করে চট্টগ্রামের কোর্ট বিল্ডিং এ পাখা টানার চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি তার কাজে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল তিনি নিরলস কাজ করে যেতেন। তিনি দিনের বেলা কাজ করতেন এবং রাতের বেলা মহান আল্লাহ-তায়ালার ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তিনি লাল দিঘীর পূর্ব পারস্থ নিজ কুঠিরে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকতেন। অল্প আহার ও অধিক ইবাদত করা ছিলো তার কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। তার আচরণ, ব্যবহার, চলাফেরা ও কথাবার্তায় বিনম্রতার কারণে লোকজন তাকে মিয়া সাহেব বলে সম্বোধন করতেন। তিনি সব সময় ইহরামের কাপড়ের মতো সাদা কাপড় পরিধান করে থাকতেন। তিনি লোক চক্ষুর আড়ালে গোপনে গোপনে আধ্যাত্মিক কার্যাদি চালিয়ে যেতে থাকেন। তার নম্র ব্যবহার, পরম ধৈর্য ও মৌনতার কারণে স্থানীয় লোকজন তাকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতেন। মানুষের কল্যাণ করতে গিয়ে অধিক পরিমাণে আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশ পায়। ফলে তিনি আর কোর্ট বিল্ডিং এর চাকরি করতে পারেন না। পরবর্তীতে তিনি মানব কল্যাণে ও ইসলাম প্রচারে পুরোপুরিভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

ইসলামের প্রচার ও প্রভাব

হযরত শাহ আমানত (রহ) ছিলেন একজন বেলায়েত সম্পন্ন সুফি। আধ্যাত্মিক জগতের এত বড় সুফী হয়েও সাংসারিক মোহে তিনি কখনো আচ্ছন্ন হননি। বরং মৌনতা, সরলতা, বিশ্বস্ততা এবং তার জ্যোতির্ময় চেহারায় আকৃষ্ট হয়ে দূর দূরান্ত থেকে দলে দলে মানুষ তার কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি কাউকে জোর করে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেননি। তিনি তার ভক্তদের সবসময় সংযমী, হালাল উপার্জন ও আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকার পরামর্শ দিতেন। সমাজপতিদের ধনদৌলতের গর্বকে তিনি আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় ঐশী ক্ষমতার দ্বারা অগ্নিস্নাত করে দিয়েছিলেন। শাহ আমানত ইসলাম প্রচারের জন্য খানকা আমানতিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রথম শিষ্যদের মধ্যে একজন ছিলেন আজিমপুরের দায়রা শরিফের শাহ সুফী মুহাম্মদ দায়েম। এছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশে তার অসংখ্য শিষ্য ছড়িয়ে ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

অলৌকিক ঘটনা

হযরত শাহ আমানত (রহ) এর ইসলাম প্রচার কার্যে নানা অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। তার মধ্যে একটি হলো, মহেশখালীর একজন বাসিন্দা চট্টগ্রামে এসেছিলেন তার নিজের বাজার করতে। ফেরার সময় তিনি তার পুরাতন মামলার খবর জানার জন্য উকিলের কাছে গিয়ে জানতে পারেন আগামিকাল তার মামলার তারিখ পড়েছে। লোকটি এই খবর শুনে হতবম্ভ হয়ে পড়েন। কারণ এক রাতের মধ্যে পুরাতন কাগজপত্র সংগ্রহ করা এবং বাড়ি থেকে দলিলাদি নিয়ে এসে আদালতে পেশ করা সম্ভব না। মামলায় হেরে গেলে সব সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাবে ভেবে লোকটি কাঁদতে শুরু করেন। আদালত বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমানত শাহ লোকটিকে দেখতে পান। তিনি লোকটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে লোকটি তাকে সব খুলে বললেন। আমানত শাহ তাকে বললেন আপনার সম্পদ কি হালাল পথে অর্জিত? তখন লোকটি উত্তরে বললেন হ্যাঁ। তারপর আমানত শাহ লোকটিকে মাগরিবের নামাজ পরে নদীর ঘাটে দেখা করতে বললেন। এবং তাকে ওয়াদা করালেন যে, আজকে যা যা ঘটবে সেটা যেনো তিনি কাউকে না বলেন। এই বলে তিনি তার গায়ের চাদর বিছিয়ে দেন কর্ণফুলি নদীতে এবং বলেন চাদরে ওঠার সাথে সাথে এটি সাম্পানে পরিণত হবে আর চোখ বন্ধ করলেই এটি চলতে শুরু করবে। সাম্পান যেখানে থামবে সেখানেই নামতে হবে। হযরতের কথা মতো লোকটি সাম্পানে আরোহন করে কাগজপত্র নিয়ে ফিরে আসেন মুহূর্তের মধ্যে। পরের দিন মামলার নথি কোথায় থেকে এলো হাকিম জানতে চাইলে লোকটি বললেন আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলো। কিন্তু হাকিম তা বিশ্বাস না করে তাকে ৭ বছরের জেল দেওয়ার কথা বলেন। লোকটি তখন ভয় পেয়ে পুরো ঘটনা বলে দেন। সাথে সাথে দমকা হাওয়া বয়ে যায় এবং শেষ হয়ে যায় হযরতের কর্ম জীবন। বিনা মৌসুমে কূল ফল, অন্ধের চোখে আলো দান, সাধু সন্তের ইসলাম গ্রহণ, সংযমহীন দরবেশের শাস্তি এরকম অনেক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী সে সময়ের মানুষেরা।

মৃত্যু ও মাজার শরীফ

হযরত শাহ আমানত (রহ) ১১৮৭ হিজরীর ৩০ শে জিলকদ তার খানকা শরীফে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বেই তিনি তার খানকা শরীফ ও নিজ বসতবাড়ির দেখাশোনার ভার তার একমাত্র পুত্র শাহাজাদা মুহাম্মদ আনোয়ার খানকে দিয়ে যান। ওয়াকফনামার বিধান মতে, হযরতের বংশধরগণ তার ভক্তদের খেদমতে নিয়োজিত থেকে যুগে যুগে অত্যন্ত সুন্দর ও শরীয়ত সম্মতভাবে মাজার শরীফ পরিচালনা করে আসছেন। এই মাজারে প্রত্যেক বছরই একটি বার্ষিক ওরস অনুষ্ঠিত হয়। হযরতের আশেকানরা তবারক বিতরণ ও নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করেন। দূর-দূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা এসে এখানে জিয়ারত, মিলাদ শরীফ, দরূদ পাঠ ও কোরআন খতম করেন। পুরো মাজার শরীফ এই দিনে নবী (সাঃ) এর উপর দরূদ ও আল্লাহ আল্লাহ ধ্বনিতে মুখরিত হয়।

উপসংহার

হযরত শাহ আমানত (রহ) ছোট-বড় সকল মানুষের উপকার করেছেন। তার নামে একটি সেতুর নামকরণ করা হয়েছে। হালিশহরে তার নামে বাচ্চাদের একটি শিশুনিকেতন স্কুল রয়েছে। শাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। সর্বোপরি, আমাদের সকলের উচিত তার আদর্শ মেনে সুন্দর ও সৌহার্দ্যপূর্ণ দেশ গড়ার কাজে শামিল হওয়া।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

নুরুন্নাহার বানু

কন্টেন্ট রাইটার, অভিযাত্রী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিজ্ঞাপন
Back to top button