ইতিহাস

হযরত শাহ মখদুম (রাহঃ): বাংলার প্রথিতযশা সুফী সাধকের জীবনী

বাংলার মাটিতে পীর ও আউলিয়াদের আগমন

বিজ্ঞাপন

ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে, পূর্ব বাংলায় কোন নবী বা রাসূল আসেননি ইসলাম প্রচার করার জন্য। বরং যুগে যুগে যাদের পবিত্র পদধূলিতে বাংলার মাটি নূরের আলোয় আলোকিত হয়েছেন তারা হলেন পীর ও আউলিয়ায়ে কেরাম। যাদের আগমনের ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যারা শোষিত ও নির্যাতিত, তারা দলে দলে ইসলামের পতাকা তলে আশ্রয় নিয়ে শান্তি ও সমৃদ্ধির সন্ধান পান। তেমনই একজন পীর ও আউলিয়া ছিলেন হযরত শাহ মখদুম (রাহঃ)। তার আগমনের ফলে উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে রাজশাহীতে ইসলাম প্রচার বিশেষভাবে বিস্তার লাভ করে।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন

হযরত শাহ মখদুমের প্রকৃত নাম আব্দুল কুদ্দুস। ধর্ম এবং জ্ঞান সাধনায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপাধি দেওয়া হয়। হযরত শাহ মখদুম (রাহঃ) ১২১৬ (হিজরি ৬১৫ সালের ২রা রজব) সালে বাগদাদের এক বিখ্যাত সুফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার জন্ম সাল নিয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। তার দাদা ছিলেন বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী। তিনিও অনেক জ্ঞানী এবং ধর্মবিশারদ সুফী ছিলেন। বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর ২৭ জন পুত্র সন্তান ছিলেন। তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল সৈয়দ আজাল্লাহ শাহ, এবং তিনি হলেন শাহ মখদুমের পিতা। তিনিও একজন বড় ওলী ছিলেন। হযরত শাহ মখদুম ছিলেন আজাল্লাহ শাহের দ্বিতীয় পুত্র। হযরত শাহ মখদুম তার দাদার মৃত্যুর ৫৪ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাল্যকাল কাটে বাগদাদে।

শিক্ষা ও ধর্মীয় জীবন

হযরত শাহ মখদুমের শিক্ষার হাতে খড়ি হয় তার পিতা আজাল্লাহ শাহের মাধ্যমে। আজাল্লাহ শাহ তৎকালীন সময়ের একজন বিশিষ্ট আলেম এবং ধার্মিক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। সুফী জ্ঞানে তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। ছোট বেলাতেই তিনি তার পুত্র আব্দুল কুদ্দুস শাহ মখদুমকে তার পিতা আব্দুল কাদের জিলানী প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। শাহ মখদুম ছিলেন তীক্ষ্ণ জ্ঞানের অধিকারী, যেকারণে তিনি অল্প বয়সেই কোরান, হাদীস, ফিকহ, আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ, সুফীতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। তবে শাহ মখদুম যখন কৈশর ছিলেন তখন তার পিতা শাসকদের রোষানলে পড়েন এবং স্বপরিবারে তারা বাগদাদ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। পরে ১২৫৮ সালে তাতারীদের হাতে বাগদাদ নগরীর পতন ঘটে। বাগদাদ ছেড়ে যাওয়ার পর শাহ মখদুমের পরিবার সিন্ধুতে অবস্থান করেছিলেন। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি বিখ্যাত সুফি জালাল উদ্দীন শাহ সুরের মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি সুফী ধারাবাহিকতার বিভিন্ন শিক্ষা, প্রকৃতিগত উন্নত যোগ্যতা, ইজতেহাদীশক্তি ইত্যাদি অর্জন করেন এবং কাদেরীয় তরিকায় সিদ্ধ পুরুষে পরিণত হন। সে সময় তাকে “মখদুম” খেতাব দেওয়া হয়।

ভারতে আগমন

বাগদাদ থেকে বিতাড়িত হয়ে শাহ মখদুমের পিতা আজাল্লাহ শাহ পরিবার নিয়ে দিল্লিতে বসবাস করেন। এই সময় দিল্লির সম্রাট ছিলেন নাসিরউদ্দিন। তবে, প্রকৃতপক্ষে রাজ্য শাসন করতেন গিয়াসউদ্দিন বলবন। তাদের উভয়ের সাথে শাহ আজাল্লাহ ও শাহ মখদুমের ভালো সম্পর্ক ছিল। তারা দিল্লিতে থাকা অবস্থায় আজাল্লাহ শাহ তার তিন পুত্রকে সুফী জ্ঞান দান করেন এবং তার তিন পুত্রকেই ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে যাওয়ার আদেশ দেন। হালাকু খা যখন মৃত্যুবরণ করেন, আজাল্লাহ শাহ তখন ভারত থেকে দিল্লিতে ফিরে আসেন এবং তার পুত্রদের ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতে রেখে আসেন।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে আগমন

শাহ মখদুম ৬০ বছর বয়সে বাংলাদেশে আগমন করেন। সেই সময় বাংলার শাসক ছিলেন তুঘলির খান। তিনি দিল্লির সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এই বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে গিয়াসউদ্দিন বলবন তার বৃদ্ধবয়সে অর্থাৎ ১২৭৮ সালে বাংলাদেশে আসেন। এই সময় গিয়াসউদ্দিন বলবনের সাথে শাহ মখদুম, তার তিন ভাই ও শতাধিক অনুসারী বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যুদ্ধযাত্রায় অনুগামী হন। যুদ্ধে তুঘলির খান পরাজিত হন। ফলে গিয়াসউদ্দিনের পুত্র বোরখা খানকে সুলতান বানানো হয়। বোরখা খান আলেম ও ধর্মপ্রচারকদের অনেক সম্মান করতেন। তাই সেই সুবাদেই শাহ মখদুমের সাথে তার গভীর সম্পর্ক তৈরি হয় এবং তিনি গৌড়ে বসবাস শুরু করেন।

ধর্ম প্রচার ও প্রভাব

শাহ মখদুম রূপোস ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে গৌড় থেকে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করেন। এই সময় তিনি নৌপথে যাত্রা করেন এবং নোয়াখালিতে এসে পৌঁছান। নোয়াখালির সোনাইমুরী রেল স্টেশন থেকে ১০/১২ মাইল দূরে শামপুর গ্রামে আস্তানা গড়েন এবং ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন। ১২৮৭ সালে কাঞ্চনপুরে তিনি একটি খানকা নির্মাণ করেন। তার অনুপম চরিত্র আর ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে শত শত মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এখানে তিনি প্রায় দুই বছর ছিলেন। ১২৮৯ সালে তিনি সংবাদ পান গৌড়ে তার প্রাণপ্রিয় শিষ্য তুরকান শাহ ইসলাম প্রচার কার্যে গিয়ে মারা যান। তখন তিনি তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে গৌড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

রাজশাহীতে ধর্ম প্রচার

শাহ মখদুম বিভিন্ন অবিচার ও অনাচার দূর করে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসেন ৬৮৫ হিজরী সালে। হযরত শাহ মখদুম (রাহঃ) এদেশে এসে বাঘা নামক স্থানে পদ্মা নদীর নিকটস্থ যে কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন সেটাই মখদুম নগর নামে খ্যাত। শাহ মখদুমের আগমনের সময় রাজশাহীর নাম ছিল মহাকালগড়। পরে এই নাম রামপুর বোয়ালিয়াতে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে এটি দরগাপাড়া নামে পরিচিত। এখানে মহাকাল দিঘী নামে একটি বিশাল দিঘী ছিল। ৩০-৪০ বিঘা জমির উপর দেও রাজার বাড়ি ছিল। তৎকালীন দৈত্য ধর্মাম্বলীদের প্রধান তীর্থ স্থান ছিল এই রামপুর বোয়ালিয়া। তাদের ধর্ম অনুসারে তারা এখানে এসে নরবলি দিতেন। অনেকে বলির জন্য মানুষ কিনে আনত, কখনও জোর করে আনত, অনেকে আবার বলি হওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় আসতো। এখানে দুইজন দেও রাজা ছিল। তাদেরকে মানুষ ঈশ্বরের অবতার মনে করতো। এখানে কয়েকজন মুসলমান দরবেশ আসলে তাদেরকেও ধরে বলি দেওয়া হয়। এই সংবাদ বাগদাদে পৌঁছলে বাগদাদ থেকে তুরকান শাহকে ধর্ম প্রচারের জন্য এখানে পাঠানো হয়। তিনি তার সঙ্গীদের নিয়ে ধর্ম প্রচার করতে গেলে দেও রাজার সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। এই সংঘর্ষে তিনি অনেক চেষ্টার পরেও পরাজিত হন এবং তাকে মেরে ফেলা হয়। কিন্তু তার লাশটিকে স্থানান্তর করতে না পেরে ওই স্থানেই তাকে পুতে ফেলা হয়। আজও সেই স্থানটি দরগাপাড়া তুরকান শহীদের আস্তানা নামে পরিচিত। হযরত শাহ মখদুম এই সংবাদটি পেয়ে দানব কুলকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে কুমিরের পিঠে করে রাজশাহীতে আসেন। এখানে এসে বাঘা নামক স্থানে পদ্মা নদীর নিকটস্থ যে কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন সেই কেল্লা থেকেই অভিযান চালিয়ে তিনি মহাকালগড় দেও রাজ্য জয় করেন।

উল্লেখযোগ্য ঘটনা

হযরত শাহ মখদুম (রাহঃ) কে ঘিরে রয়েছে নানা অলৌকিক ঘটনা। রামপুর বোয়ালিয়া এক নাপিতের তিনটি পুত্র ছিল। সে সময় তার দুই পুত্রকে মহাকালগড়ে বলি দেওয়া হয় এবং শেষ পুত্রকেও বলি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে নাপিত মখদুম নগরীতে গিয়ে শাহ মখদুমকে নালিশ করেন। এতে শাহ মখদুম বলেন, “তুমি তোমার সন্তানকে নিয়ে নদীর ধারে অবস্থান কর, সেখানেই আমার দেখা পাবে।” নাপিত দম্পতি দিন রাত সেখানে অপেক্ষা করার পর হুজুরের দেখা না পেয়ে স্বপরিবারে পানিতে ডুবে মরার সিদ্ধান্ত নেন এবং ধীরে ধীরে পানিতে নামতে শুরু করেন। এমন সময় ভয় নেই, ভয় নেই বলে কুমিরের পিঠে করে শাহ মখদুম আবির্ভূত হন। তিনি নাপিতের পুত্রের গলায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং ফু দিয়ে বললেন, “শীঘ্রই দেও রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে আর তোমার পুত্রও বলি হবে না।”

বিজ্ঞাপন

সকালবেলা নাপিত পুত্রকে বলিদানের জন্য আনা হলো। কিন্তু ছুরির ঘাত প্রতিঘাতেও নাপিত পুত্রকে কোনভাবেই কাটা গেল না। এই সংবাদ দেও রাজার কাছে গেলে তিনি বললেন, “ওই ছেলের দোষ আছে, ওকে ছেড়ে দাও।” আর এইভাবেই ছেলেটি বলির হাত থেকে বেঁচে ফিরে। কথিত আছে, শাহ মখদুম কুমিরের পিঠে করে নদী পার হতেন। তার কারামতের শক্তিতে কুমির শুধু নয়, বনের বাঘও পোষ মানতো বলে জানা যায়।

মৃত্যু

রাজশাহী অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর তিনি সারাদিন ইবাদতে মশগুল থাকতেন। কথা কম বলতেন, কোরান বেশী পড়তেন। যখন তিনি উপলব্ধি করেন যে তার মৃত্যু আসন্ন, তখন তিনি তার ভক্তদের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ডেকে পাঠান। সবাইকে তিনি অসিয়ত দান করেন এবং তার যোগ্য শিষ্যদের এলাকা ভাগ করে দিয়ে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি মৃত্যুর আগে তার কবরের স্থান দেখিয়ে দিয়ে বলেন তাকে যেন এখানে দাফন দেওয়া হয়। মাগরিবের নামাজ পরে তিনি হুজুর খানায় ঢুকে সাদা কাপড় দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর আর বের হচ্ছেন না দেখে শিষ্যরা হুজরার ভেতরে গিয়ে দেখেন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সাধক শাহ মখদুম রূপোস পরপারে পারি জমিয়েছেন। হিজরী ৭১৩ সালের রজব মাসের ২৭ তারিখে অর্থাৎ ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

উপসংহার

শাহ মখদুমের নামে রাজশাহী মহানগরীতে একটি থানার নামকরণ করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য একটি হল রয়েছে তার নামে। এছাড়াও রাজশাহী বিমানবন্দর, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও একটি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তার নামে। তার নামে রাজধানী ঢাকার উত্তরায় বৃহৎ সড়কের নামকরণ করা হয়েছে যা বর্তমানে ঢাকা এভিনিউ নামে পরিচিত। সবকিছু মিলিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে, শাহ মখদুম বাংলার প্রথিতযশা সুফী সাধক এবং ধর্ম প্রচারে অন্যতম ছিলেন। তার অনুপম ব্যক্তিত্বে শত শত মানুষ মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং অত্যাচারীর হাত থেকে মানুষদেরকে রক্ষা করে মানুষের মাঝে শান্তি ফিরিয়ে দেন তিনি। তাই দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার ভক্ত অনুসারীরা তার মাজার জিয়ারতের জন্য আসেন।

বিজ্ঞাপন


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

নুরুন্নাহার বানু

কন্টেন্ট রাইটার, অভিযাত্রী

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading