যে সকল সুফী সাধকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রসার ঘটে, তাদের মধ্যে হযরত শাহ পরান (রহঃ) অন্যতম। তিনি ছিলেন আউলিয়া কুলের মধ্যমুনি হযরত শাহ জালালের ভাগিনা। হযরত শাহ জালালের পরেই তার খ্যাতি ছিল। নিচে তার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
প্রাথমিক জীবন
হযরত শাহ পরানের জন্ম ইয়েমেনের হাদ্রামাউথ অঞ্চলে। তার পূর্বপুরুষগণ বোখরার অধিবাসী ছিলেন। তার উর্ধ্বতন চতুর্থ পুরুষ জালালুদ্দীন (রহঃ) বোখারা থেকে সমরকন্দ এবং পরে তুর্কীস্থানে বসবাস করেন। তার পিতার নাম ছিল মোহাম্মদ (রহঃ)। বংশসূত্রে তিনি ছিলেন একজন শীর্ষস্থানীয় আলেম এবং উচ্চস্তরের বুযর্গ। তার মাতাও ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা এবং উন্নত চরিত্রের অধিকারীনি। হযরত শাহ পরানের বয়স যখন ১১ বছর, তখন তার পিতা মারা যান।
প্রাথমিক শিক্ষা
হযরত শাহ পরানের পিতার মৃত্যুর পর তার মাতা একা তাকে লালন পালন করেন। তিনি শৈশব ও কৈশোর অবস্থায় তার মায়ের নিকট প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য অন্যান্য শিক্ষকের শরণাপন্ন হন। তিনি তার আত্মীয় প্রখ্যাত দরবেশ সৈয়দ আহমদ কবিরের কাছে ধর্ম শিক্ষায় দীক্ষিত হন। পরবর্তীতে তিনি আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভে নেশাপুরের বিখ্যাত দরবেশ পাগলা আমিনের শরণাপন্ন হন। হযরত শাহ পরানের সিদ্ধি লাভের ক্ষেত্রে তার নিজের অবিরাম সাধনা ও সত্য-ন্যায়ের সংগ্রামে সর্বোচ্চ ত্যাগ তিতীক্ষার পাশাপাশি তার মায়ের চরিত্র ও নেক জীবন ছেলের জীবনের সাফল্য ও প্রতিষ্ঠার পেছনে সুদূর ভূমিকা রেখেছে।
সিলেটে ইসলাম প্রচার
সিলেট অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠায় শাহ পরানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে হযরত শাহ জালাল যখন ৩৬০ জন সঙ্গী নিয়ে সিলেটে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে রওনা দেন, সেই সময় তাদের মধ্যে অন্যতম সঙ্গী ছিলেন হযরত শাহ পরান (রহঃ)। সিলেট বিজয়ের পর হযরত শাহ জালালের নির্দেশে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। পরবর্তীতে হযরত শাহ পরান (রহঃ) সিলেটের নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব এলাকায় তিনি দাওয়াতের কাজ করেন। তিনি তার মামা হযরত শাহ জালালের বদৌলতে কামালিয়াত হাসিল করেন। কামালিয়াত হাসিলের পর তিনি মুরাকাবা, মুসাহাদার মাধ্যমে তার মামা হযরত শাহ জালালের সঙ্গে আধ্যাত্মিক যোগাযোগ রাখতেন।
অলৌকিক ঘটনা
হযরত শাহ পরানের জীবনে ঘটা উল্লেখযোগ্য অলৌকিক ঘটনাগুলো হলো:
- শাহ পরানের জন্মের সময় তার মায়ের কাছে পরিচর্যাকারীনি মহিলারা সদ্য প্রসূত সন্তানের মুখে আল্লাহ আল্লাহ জিকির শুনতে পেয়েছিলেন।
- শাহ পরানের বয়স যখন ৫ বছর, তখন একদিন তিনি তার পিতার নিকট বসে পাক কালামে মাজীদ পাঠ করছিলেন। এমন সময় একটি লোক এসে বললো, “হুজুর, আমার একটি মাত্র ছেলে, কিন্তু তাকে কে বা কারা ধরে নিয়ে গেছে। প্রায় তিন মাস হলো তার কোনো সন্ধান পাচ্ছি না। আমি একজন বৃদ্ধলোক। আমার স্ত্রী পুত্রটিকে হারিয়ে দিবানিশি কাঁদতে কাঁদতে প্রায় অন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আপনি যদি আমার ছেলের জন্য দোয়া করতেন যাতে সে আমাদের নিকট ফিরে আসে।” প্রতিত্তরে শাহ পরান (রহঃ) এর পিতা কিছু বলার আগে শাহ পরান (রহঃ) বলে উঠলেন, “তুমি বাড়িতে ফিরে যাও এবং খানা পিনার ব্যবস্থা কর। মাগরিবের পূর্বেই তোমার ছেলে ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ।” শাহ পরানের কথা অনুযায়ী বৃদ্ধের ছেলে মাগরিবের পূর্বেই বাড়িতে ফিরে আসে।
- হযরত শাহ জালাল সিলেটে আসার পথে নিজামুদ্দীন আউলিয়া তাকে এক জোড়া কবুতর উপহার দেন। কবুতরগুলো ধীরে ধীরে বংশ বিস্তার করতে থাকে। সাধারণ মানুষ এমনকি শাহ জালালের সহচর কেউই এই জালালি কবুতর বধ করেন না। অথচ হযরত শাহ পরান প্রতিদিন একটি করে কবুতর জবাই করে খাওয়া শুরু করেন। বেশ কয়েকদিন পর হযরত শাহ জালাল লক্ষ্য করলেন তার কবুতর দিন দিন কমে যাচ্ছে। খাদেমগণের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তারা আসল ঘটনা খুলে বললেন। শাহ জালাল তখন শাহ পরানকে ডেকে আনার হুকুম দিলেন। শাহ পরান তাকে তলবের কারণ জানতে পেরে বললেন, “একটু অপেক্ষা কর, আমি কবুতরগুলো ফেরত দিয়ে দিচ্ছি।” এই বলে তিনি কবুতরের পালকগুলো নিয়ে দরজার সামনে গিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “আল্লাহর হুকুমে তোমরা শাহ জালালের দরবারে চলে যাও।” সাথে সাথে কবুতরগুলো জীবিত হয়ে শাহ জালালের দরবারে চলে যায়।
শাহ পরানের এইসব কারামতি দেখে হযরত শাহ জালাল খুশি হন এবং তাকে দূরে কোথাও আস্তানা গড়ার নির্দেশ দেন। মামার নির্দেশে তিনি খাদেম পাড়ায় চলে যান এবং সেখানে তিনি সাধনা ক্ষেত্র ও ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। এখানেই তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ইসলাম প্রচার করেন।
মাজার শরীফ
শাহ পরানের মাজার সিলেট শহরের একটি পুণ্যতীর্থ বা আধ্যাত্মিক স্থাপনা। এটি খাদিম নগর এলাকায় অবস্থিত, যা শাহ জালালের দরগাহ থেকে ৮ কিলোমিটার দূরত্বে। মাজারের পাশেই একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ রয়েছে। হযরত শাহ জালালের দরগাহের মতো এ মাজারেও প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। রবিউল আউয়াল মাসের ৪, ৫, ও ৬ তারিখে এই মাজারে ওরস হয়।
উপসংহার
হযরত শাহ পরান ছিলেন সুহরাওয়ার্দিয়া ও জালালিয়া তরিকার প্রখ্যাত সাধক। সিলেট শহরে ইসলাম ধর্ম প্রচারে হযরত শাহ জালালের পর তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাই দূর-দূরান্ত থেকে এখনো প্রচুর মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তার মাজারে যান এবং মাজার জিয়ারত করেন।
তথ্যবহুল টেবিল
বিষয় | তথ্য |
---|---|
জন্মস্থান | ইয়েমেন, হাদ্রামাউথ |
পিতার নাম | মোহাম্মদ (রহঃ) |
শিক্ষাগুরু | সৈয়দ আহমদ কবির, পাগলা আমিন |
ইসলাম প্রচার এলাকা | সিলেট, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ |
মাজারের অবস্থান | খাদিম নগর, সিলেট |
ওরসের তারিখ | রবিউল আউয়াল ৪, ৫, ৬ |
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.