জীবনী

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও মান্না দে: সংগীতের দুই কিংবদন্তির অমর কাহিনী

বাংলা সংগীতের দুই মহীরুহের জীবনী ও তাঁদের অবিস্মরণীয় অবদান

বিজ্ঞাপন

 

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও মান্না দে: সংগীতের দুই কিংবদন্তি

সংগীতের প্রতি তাঁদের অবদান

এঁরা সংগীতকে যে ভাবে লালন করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। এই দুই কন্ঠশিল্পীকে নিয়ে বাঙালীর আত্মশ্লাঘা স্বাভাবিক। এমন একটা সময়ে এঁরা গান গেয়েছেন, যে সময়ে বিনোদন শিল্প ছিল খানিকটা নিঃসঙ্গ। বর্তমান যুগের মতো এত জাঁকজমক, এত ঠমক কোনো টাই ছিল না।

অনন্য গায়কী

হেমন্ত বাবু এবং মান্না বাবুর অনন্য গায়কী তাঁদের বিপুল সংখ্যক শ্রোতার কাছে আইকনিক ইমেজে পরিণত করে তোলে। এ দিক থেকে দেখলে ব্যাপারটায় বেশ অভিনবত্ব লক্ষ করা যায়। রাগাশ্রয়ী, রবীন্দ্রগীতি থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলা গানের নেপথ্য সংগীত সর্বত্রই ছিল এঁদের অনায়াস বিচরণ।

কালজয়ী গান

যে সমস্ত গান এঁরা গেয়েছেন, সে সময়ে তো বটেই, তারপরে পঞ্চাশ, ষাট বছর পেরিয়ে গেলেও, তাঁদের কন্ঠে মাধুর্যপূর্ণ থেকে গেছে। শুধু তাই নয়, এভাবে কালজয়ী হয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্মের মুখে সে গান ঘুরে ফিরে, বারবার এসেছে। সে সব গানের আবেদন এতোটাই যে পরবর্তী সময়ে অন্য শিল্পীদের কন্ঠে গানগুলি অজস্র বার গীত হলেও, সেসবের মর্যাদা এতোটুকু ক্ষুন্ন হয় নি!

যুগ্ম কিন্নর

এঁরা একই আকাশে যুগ্ম কিন্নর। এক পাশে হেমন্ত, অন্য পাশে মান্না দে। দুজনেই দীর্ঘ দিনের পরাক্রান্ত পারফর্মার। পরস্পরকে জানতেন, বুঝতেন তবে ঘনিষ্ঠতা ততো প্রকাশ্য হয় নি। কারণ তাঁদের ভাবনা ও সৃজনের অভিমুখ ছিল আলাদা। খানদান বা ঘরানাও যথেষ্ট স্বতন্ত্র। নিজেকে গড়ে তোলার বা সমকালের গানের প্রভাব একেবারে অন্যরকম। অথচ দুজনেই আদ্যন্ত বাঙালী যদিও পরিবার ও সমাজ কাঠামো দুজনের দু’রকম।

বিজ্ঞাপন

মান্না দে: প্রাদেশিক ভাষার গায়ক

মান্না বিশ শতকের গোড়ার দিকের যৌথ পরিবারের সন্তান, উত্তর কলকাতার। ছোট কাকা অন্ধ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্রর সান্নিধ্যে ছোট থেকেই গানের যোগাযোগ। শোনা যায় মান্না না কি তেরোটি প্রাদেশিক ভাষায় অনায়াসে গান গাইতেন। বাঙালীয়ানার দিকে তাঁর টান ছিল, পছন্দ করতেন কলকাতা প্রিয় কিন্তু স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতের ডেরা!

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়: সহজ সুরের গায়ক

অথচ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ডাক নাম কেউ শোনে নি। তবে মুম্বাই বা হিন্দি জগতে তিনি হেমন্তকুমার। বাঙালীর চোখে তিনি দীর্ঘ, দেহাবয়ব, ধুতি ও হাত গোটানো শার্ট, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা ও পায়ে চটি। সভামঞ্চে, ড্রয়িং রুমে, স্টুডিও গণ নাট্য জনায়েতে একই রকম। শুধু বিদেশ যাত্রায় স্যুটে সব গাইতেন। তবে স্বচ্ছন্দ ছিলেন অনলংকার, তান বর্জিত সহজ সুরের বাংলা গানের গায়নে।

সুরকারদের সাথে সম্পর্ক

সুরকার রবীন্দ্রনাথ থেকে সলিল চৌধুরী সব গানে তিনি রাগভিত্তিক ও টপ্পা জাতীয় গান বর্জন করে গাইতেন। বেছে নিতেন সুরপ্রধান গায়ন। ‘গায়ের বধু’ ও ‘পালকি’র গান যে আজ পর্যন্ত জন সমাদার পাচ্ছে যথাযথ কেরামতি ও তাঁর পেশাদারি জৌলুস আবার অন্যদিকে ‘নাগিন’ সারা ভারতে আলোড়ন তোলা হিন্দি ফিল্মের গান।

মান্না দে: উস্তাদি গানের প্রশিক্ষণ

বলা হয় মান্না দে না কি এমন গান পেলে লুফে নিতেন। কেননা তাঁর যে উস্তাদি গানে জবরদস্ত ট্রেনিং ছিল। কাকা কৃষ্ণচন্দ্রর কাছে রাগদারি গানের তালিম ছাড়াও ১৯৪৪ সালে মুম্বাইতে থাকা কালীন সময়ে উস্তাদ আমানআলি খাঁ সাহবের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় বার মুম্বাই থাকাকালীন সময়ে মান্না দে উস্তাদ আবদুল রহনান খাঁ সাহেবের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের নিবিড় শিক্ষা লাভ করেন।

সমসাময়িক জীবন

দুজনে সমসাময়িক। মান্না দে ১৯১৯ (১লা মে) ও হেমন্ত ১৯২০ (২৬ জুন)। তবে মান্না দে ভাবেন নি কোন দিন গায়ক হয়ে উঠবেন আবার হেমন্তও ভাবেন নি এমনটা। তিনি গল্প লেখক হতে চেয়েছিলেন। পড়লেন ইঞ্জিনায়ারিং। সে সব ফেলে কি এক টানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সঙ্গীতে! সুন্দর সুকণ্ঠ ও সুউচ্চারণ তাঁর সম্বল ছিল। কিন্তু কলকাতা কেন্দ্রিত জীবনধারায় দুজনেই পরিস্থিতি ও পরিবেশ ততো সহজ ছিল না।

বিজ্ঞাপন

মুম্বাইতে প্রথম ব্রেক

মুম্বাইতে প্রথম শচীন দেব বর্মন মান্না দে কে ‘উপর গগন বিশাল’ গানে ব্রেক দেন যা সারা ভারত শুনলো এক সম্ভ্রান্ত পুরুষ কন্ঠ খোলামেলা, হৃদয়স্পর্শী। প্রকৃত পক্ষে চল্লিশের দশকে শচীন দেব বর্মন, মান্না দে, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রা কলকাতা ত্যাগ করেছিলেন জীবিকাগত নিশ্চিন্ততা ও স্বচ্ছলতা লাভের বাসনায়।

বাংলা গানের দুটি ডানা

আরও এক কারণ। তখন গান শোনা যেত ছোট খাট আসরে, ধনী গৃহে বা থিয়েটারে। শুধু গ্রামোফোনে কত মুনাফা তুলবে! তখন শুরু হয় ১৯২৭ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং ১৯৩১ সালে সবাক চলচ্চিত্র। তখন বাংলা গানে দুটি ডানা লাগলো। বেতার, সিনেমা।

হেমন্তর প্রয়াণ

হেমন্তর প্রয়াণ হয় ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। বড় স্বল্পজীবি ছিলেন তিনি। এই মাত্র ৬৯ বছর বয়সে হেমন্ত অতিরিক্ত পরিশ্রম, বুকে পেস মেকার, রক্তে শর্করা তাঁকে বিভ্রান্ত করেছে। তবুও এই মাইল ফলক গায়কের আর একটি হলো মহানয়ক উত্তম কুমারের লিপ পাওয়া। বহুকাল ধরে বাঙালী জানতো উত্তম মানেই হেমন্ত কিন্তু তাও তিনি সরকারের তরফ থেকে তেমন সাড়া পাননি। অপর দিকে মান্না দে পেয়েছিলেন ‘দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার (১৯০৭)।

রবীন্দ্রসংগীতের জাদু

তবু ‘আমার গানের স্বরলিপি’ তো তাঁকেই মানায়। রবীন্দ্রসংগীতকে সর্বসমক্ষের আনার জাদু তো তিনিই দেখিয়েছেন। ‘এই কথা টি মনে রেখো। আমি যে গান গেয়েছিলাম ’ এই রবি বাণী তাঁর কন্ঠে প্রাণ পেয়েছে।

জীবনকাল

হেমন্তর জীবনকাল মাত্র ৬৯ বছর আর মান্না দে ছিলেন নবতিপর (মৃত্যু ২০১৩)। হেমন্তকে বলা যায় ‘এ টেল অব টু সিটিজ’ কলকাতা ও মুম্বাইয়ের। আর এ দিকে মান্না দে’র জীবন সেই তুলনায় অনেকটাই প্রবাসী তথা সর্বভারতীয়।

বিজ্ঞাপন

আন্তরিক উক্তি

মান্না দে একবার বলেছিলেন- আমি যে কেন বেঁচে আছি। আমার আগে আমার স্ত্রীরও আগে চলে যাওয়া উচিত ছিলো- এই উক্তি অত্যন্ত আন্তরিক, কোন আড়াল বা ভান নেই। এই দিকপাল গায়কদ্বয়ের দুখা নি বই রয়েছে:

১. জীবনের জলসা ঘরে – মান্না দে (আনন্দ পাবলিশার্স) ২. আনন্দ ধারা – হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (সপ্তর্ষি)

সংগীতের দুই কিংবদন্তি

এই দুজন কেই মনে হয় স্বর্গ থেকে নেমে আসা কন্ঠ। মানুষ জুটি পছন্দ করে-সত্যজিৎ-ঋত্বিক, আশা-লতা, ক্রুফো-গদার, শক্তি- সুনীল, উত্তম-সৌমিত্র, শচীন-সৌরভ, শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্ত। তেমনই হেমন্ত-মান্না।

দ্বৈরথ ও প্রতিযোগিতা

হবে বিপরীত, লাগবে টাগ অব ওয়ার কিন্তু টানবে দুজনেই। অতল জলে নামিয়ে মারবে এ বলবে আমায় দেখ, ও বলবে আমায় দেখ। মান্না-হেমন্ত দ্বৈরথ জীবন অস্থির করে তুলেছিল। এ বলে হেমন্ত, ও বলে মান্না। এ বলছে ‘তোর হেমন্ত গাইতে পারবে আমি যে জলসা ঘরে!’ ও বলে, ‘তোর মান্না গাইতে পারবে’ অবাক পৃথিবী অবাল করলে আমায়!

মানবিক দৃষ্টিকোণ

যদি মানুষ হিসেবে দেখি এই দুজনকে, গায়ক নয়, তাহলে আর দ্বৈরথ থাকে না। থাকে একটাই ঢেউ। তার কোনো এপিঠ ওপিঠ থাকে না। হেমন্ত-মান্না অথবা মান্না-হেমন্ত একটাই ঢেউ, একটাই তরঙ্গ। হেমন্ত- হ্যায় অপনা দিল, বেকরার করকে, ন তুম হমে জানো, জানে ও ক্যায়সে লোগ থী, ন ইয়ে চাঁদ হোগা।

বিজ্ঞাপন

মান্না দে: সর্বজনীন গায়ক

মান্না দে- এ ভাই জরা দেখকে চলো, এয় মেরে পেয়ারে ওয়াতন, তুম বিন জীবন, কসমে ভাদে পেয়ার, জীন্দগী ক্যায়সে হ্যায় পহেলি, তু পেয়ার কা সাগর লাগা চুনরী মে দাগ। এই সব গান পৃথিবীর সর্বপ্রান্তে পৌঁছেছে। কোন ভিসা লাগে নি।

সংগীতের সর্বোচ্চ ভিসা

এখনো শ্রেষ্ঠ ভিসার নাম গান, কবিতা বা সাহিত্য, শিল্প। মেঘের মতো হেমন্ত-মান্না দে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে লাহোর থেকে যশোরে বৃষ্টি নামিয়েছে। কে পারবে বলতে – এক গোছা রজনী গন্ধা হাতে নিয়ে বললাম, চললাম।

চিরন্তন গান

কে বলবে- যদি কাগজে লেখো নাম কাগজ ছিঁড়ে যাবে। যদি পাথরে নাম লেখো পাথর ক্ষয়ে যাবে। হৃদয়ে লেখো নাম সে নাম রয়ে যাবে। একজন সুরের আকাশে ধ্রুবতারা আর একজন মনের আকাশে স্বরলিপি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিজ্ঞাপন
Back to top button