জীবনানন্দ দাশ বেশ কয়েকবার চাকুরী বিহীন হয়েছেন কোনও চাকুরীতে থিতু হতে পারেন নি। সিটি কলেজের চাকরি যাবার পর তিনি অত্যন্ত নিরাশায় ছিলেন। ব্রাহ্ম সমাজ কর্তৃক পরিচালিত সিটি কলেজে সরস্বতী পুজো উপলক্ষে বিতর্কে জীবনানন্দ বলোছিলেন, সকলের ধর্ম পালনের অধিকার থাকা উচিত।
এর-ই জেরে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। কেউ বলেছিলেন “ক্যাম্পে” নামে এক অশ্লীল কবিতা তাঁর চাকরি যাওয়ার কারণ। অবশ্য সেটা ভুল তথ্য। সেই সময়ে “চৌত্রিশ” নামে একটি উপন্যাস লেখেন তিনি, তাতে তাঁর জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে। তিনি চাকরি হারানোর বেদনাভার নিয়ে এক নিভৃত, একক জীবন যাপন করতে শুরু করেন।
সেই সময় কলকাতায় আগমন জীবনানন্দ’র। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। বুদ্ধদেব বসু নানা ভাবে তাঁকে অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। বুদ্ধদেব বসুর রাসবিহারি এভিনিউয়ের বাড়ীতে অনেক আলাপচারিতা হয়েছিল তাঁদের। বুদ্ধদেব বলেন, “আপনি সিটি কলেজে আর একবার আবেদন করুন না!”
জীবনানন্দ আকাশ থেকে পড়েন, সিটি কলেজে চাকরির আবেদন! বুদ্ধদেবের বাড়ী ‘কবিতা ভবন’ থেকে চা খেয়ে তাঁরা পথে নেমে এলেন। তখন বিকেল। রাসবিহারির চওড়া ফুটপাথে ঝলমলে রোদ। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কথা হতে লাগলো।
কলকাতা শহর, এদিকে সবে মাত্র বিস্তার করতে শুরু করেছে। পরিষ্কার ও ঝকঝকে পথঘাট। প্রচুর গাছপালা, গাছের পাতার শীতল ছায়া। এদিকে বাড়িঘর কম, সদ্য নতুন নতুন বাড়ী উঠছে। বাড়ির বারান্দায় গাছের পাতা টুপটাপ পড়ে।
ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে বুদ্ধদেব বলেন, “কেন নয়?” জীবনানন্দ বলেন, “আমাকে তো ওখান থেকে একবার চাকরীচ্যুত করা হয়েছে। লোকে কি ভাববে!”
দু’আঙুলের ফাঁকে কৌশলে সিগারেট ধরে বুদ্ধদেব বলেন, “দেখুন জীবনানন্দ বাবু, আমি আপনাকে পছন্দ করি, তার চেয়েও ভালোবাসি আপনার কবিতা। অন্য কেউ হলে আমি এভাবে বলতাম না। বলার রুচিই হতো না আমার। কলকাতায় আপনার একটা কাজ দরকার, আপনিও তেমনটাই চান, আমি বুঝি। কে কবে কোথায় চাকরি হারিয়েছে না কি বার করে দিয়েছে, এখন আর এ সব অপমান কেউ গায়ে মাখেনা, কেউ মনেও রাখে না।”
- বলছেন?
– আলবৎ বলছি। আপনার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অন্য অনেকের মধ্যে নেই। আপনার কলকাতায় থাকা দরকার।
– তা হলে একটা অ্যাপ্লিকেশন করবো?
– নিশ্চয়। কনফিডেন্স কখনো হারাবেন না।
কথা বলতে বলতে বুদ্ধদেব দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন, বললেন, “আর শুনুন ভাল হয় যদি রজনীকান্ত গুপ্ত কে ধরতে পারেন। তিনি কিন্তু ময়মনসিংহের লোক, ট্যালেন্টেণ্ট। ইংরেজি তে এম. এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় হয়েছিলেন। সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। আপনাদের বরিশালের বিএম কলেজেও অনেক দিন অধ্যাপনা করেছেন। ভাল লোক। তাঁকে ধরতে পারলে কাজ হবে।”
বুদ্ধদেবের কথায় জীবনানন্দ কিছুটা ভরসা পেলেন। বললেন, “আচ্ছা দেখি।”
- দেখার কিছু নেই। আপনি বরিশালে ফিরেই তাঁকে চিঠি লিখুন, চিঠি লিখলেন কি না সেটা আমায় জানাবেন।
জীবনানন্দ একবার আড়চোখে বুদ্ধদেবের দিকে তাকালেন। তাঁর চেয়ে আটবছরের ছোট বুদ্ধদেব। কিন্তু সমীহ জাগানো একটা ব্যক্তিত্ব আছে তাঁর। এই যে বিকেল বেলায় বাড়ীর কাছেই হাঁটতে বেরিয়েছেন তবুও পরিস্কার একটি ইস্ত্রি করা পাজামা, পাঞ্জাবি তাঁর পরনে। অনর্গল সিগারেট খাচ্ছন। একটা স্মার্ট ব্যক্তিত্বর ছবি ফুটে আছে সমস্ত অবয়বে। ঘরোয়া আড্ডাতেও এমনই পোশাকে দেখা যায় বুদ্ধদেবকে।
বয়সে ছোট হলেও বুদ্ধদেবকে সন্মান করেন জীবনানন্দ। মান্য করে চলেন। বুদ্ধদেবও তাঁকে মান্য করেন। কবি হিসেবে যথেষ্ট সমাদর করেন। জীবনানন্দ বুঝতে পারেন। বুদ্ধদেব তাঁর কবিতা পত্রিকায় গুরুত্ব দিয়ে জীবনানন্দর কবিতা ছাপেন দীর্ঘ ও গুচ্ছ।
একদিন তিনি জীবনানন্দকে একটু বকবকি করলেন, সেটা যে জীবনানন্দ’র ভালোর জন্য সেটা জীবনানন্দ অনুভব করলেন। বুদ্ধদেব বসু বললেন, “দেখুন জীবনানন্দ বাবু একটু সভ্য হোন।”
- সভ্য হবো? জীবনানন্দ অবাক!
– আপনি ইংরেজি জানা একজন শিক্ষিত পন্ডিত মানুষ, এভাবে হয় না।
– কী ভাবে হয় না?
– আপনি ধুতি পাঞ্জাবি না পরে যদি পায়জামা পাঞ্জাবি পরেন তা-ও দেখতে ভাল লাগে। এখন আধুনিক মানুষ কমই ধুতি পরেন।
জীবনানন্দ হাসলেন, “ওহ! এই ব্যাপার।” একবার তাঁর মনে হলেো, তাই তো বুদ্ধদেব কখনো ধুতি পরেন না। পরলেও জীবনানন্দ’র চোখে পড়েনি। হয় শার্ট, প্যান্ট, টাই নয় তো পাটভাঙা পাজামা, পাঞ্জাবি। অত্যন্ত সৌখিন মানুষ। এতোবার বুদ্ধদেবের বাড়ী গিয়েছেন, কখনো তাঁকে খালি গায়ে দেখেন নি।
প্রতি সন্ধ্যায় পাটভাঙা, ইস্ত্রি করা পায়জামা পাঞ্জাবি সদ্য ধোওয়া এবং ইস্ত্রী করা রুমাল নিয়ে আড্ডা বসেন। বুদ্ধদেব হঠাৎ বললেন, “কী ভাবছেন জীবনানন্দবাবু?”
- না ভাবছি আপনি খুব সৌখিন মানুষ।
বাতাস কাঁপিয়ে বুদ্ধদেব হাসতে লাগলেন। এমন প্রাণখোলা হাসি কম লোকই হাসতে পারেন। রাসবিহারির হাসি গড়িয়াহাট থেকে শোনা যায়। জীবনানন্দ ভেবে পান না এতো ছোটখাট মাপের মানুষ এতো প্রভাব কি ভাবে ফেলতে পারে!
বুদ্ধদেব বললেন, “শৌখিনতার কথা বলছেন?”
- হুম
বুদ্ধদেব হেসে বললেন, “তা কিছু শৌখিনতা আমার আছে বৈ কি! লেখার ক্ষেত্রেও আমার কলম নিয়ে শৌখিনতা আছে। আমি এক একটা কলম দিয়ে এক একটা লেখা লিখি।” জীবনানন্দ মৃদু হেসে বলেন, “আপনি সুখী মানুষও বটে!”
- সুখী?
নিশ্চয়। এটা তো কিছুটা অর্জন করতে হয়! জীবনানন্দ বরিশালের বাড়ী ফিরে গেলেন। জীবনানন্দ’র ধূসর পান্ডুলিপি প্রকশের কোন নামী প্রকাশক প্রকাশ করুক বুদ্ধদেব চেয়েছিলেন। সেটা কিছুতেই না বুদ্ধদেব তাঁর ২০২ রাসবিহারি এভেনিউয়ের ঠিকানা ব্যবহার করে ‘কবিতা ভবন’ নামে একটি প্রকশনা সংস্থাই খুলে ফেললেন শুধু ধূসর পান্ডুলিপি প্রকাশ করার জন্য।
কারণ বুদ্ধদেব বুঝতে পেরেছিলেন, জীবনানন্দ’র এই বই বার করা বিশেষ দরকার। “ধুসর পান্ডুলিপি” প্রকাশ করে বুদ্ধদেব একটি আলোচনাও লেখেন। জীবনানন্দ বাবুর বহু কবিতায় এই ধরণের পরম বিষষ্ময়কর কথাচিত্র পাওয়া যায়। সেই কবিতাগুলো সব মৃদি রঙে আঁকা, তাঁর কবিতার “tone” আগাগোড়া “subdued…” অপরিসীম অবসাদে আচ্ছন্ন বাঙালীর হৃদয়কে তা স্পর্শ না করে থাকতে পারে না।
বরিশালের বাড়ীতে তাঁর মা কুসুমকুমারী তাঁকে কোন ঘরোয়া প্রয়োজনে বাজারে পাঠিয়েছিলেন কিছু মিষ্টি ও মাছ আনতে মাছের বাজারে ঢুকে নদীর তাজা মাছ দেখে সেই দোকানে এগিয়ে গেলেন সেই সময়ে তাঁর সিরাজুল হক এর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো।
বিএম কলেজে জীবনানন্দর সহকর্মী অধ্যাপক সিরাজুল হক। বয়সে তাঁর চেয়ে জীবনানন্দ অনেকটাই সিনিয়র। সিরাজুল হক তাঁকে “দাশবাবু” ও তিনি সিরজুল কে “হক সাহেব” বলে ডাকেন। বয়সে অন্তর থাকলেও অন্তরঙ্গতা আছে তাঁদের।
জীবনানন্দকে আন্তরিক মন দিয়ে বুঝতে চান সিরাজুল। এটি ভাল লাগে জীবনানন্দর। মাঝে মাঝে তাঁদের রাস্তাঘাট, এধার ওধার দেখা হয়ে যায়। আজও তেমনিই। ভাল হলো, জীবনানন্দ ভাবলেন। মাছের দরদাম করতে জীবনানন্দ পারঙ্গম নন। কুশল বিনিময় করে চুপি চুপি সিরাজুল হককে বললেন, “হক সাহেব, আমায় একটা বড় মাছ কিনে দিন না!”
- ও আর এমন কি, আসুন!
সংসারে যে মানুষ নিজেকে বেচতে পারে না, সে আর কোনো কাজে লাগে না। যার কোনো বাজার মুল্য নেই, ব্যক্তি মুল্য নেই, না স্ত্রীর কাছে, না সংসারে, তার কোনো কিছুতে কোনো অধিকার নেই। থাকবার কথাও নয়।
জীবনের কোনো একটা সময়ে নিজের সম্পর্কে এমন ভাবনা ছিল তাঁর। এ ভাবেও মুল্যায়ণ করেছেন নিজে কে নিয়ে জীবনানন্দ দাশ।
তথ্যসূত্র
মাসউদ আহমদ
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.