জঁ লুক গদার: চলচ্চিত্রের নবতরঙ্গময় বিপ্লবী
নবতরঙ্গময় শিল্পী, রীতি বিরুদ্ধ নির্মাতা, এবং দর্শনের প্রাবন্ধিক
কি বলা যায় তাঁকে! নবতরঙ্গময়! মৃত্যু থেকে জেগে ওঠা ল্যাজারাস! না কি আত্মসমালোচক! কিংবা রীতি বিরুদ্ধ! আশ্চর্যের বিষয় হলো, পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য মিলিয়ে প্রায় একশো টি ছবির পরিচালক জঁ লুক গদার (Jean-Luc Godard) আসলে চলচ্চিত্র-ই নির্মাণ করতে চাননি।
চেয়েছিলেন দর্শন আঁকতে! চলচ্চিত্র কে হাতিয়ার করে প্রবন্ধ লিখতে। কিন্তু চলচ্চিত্রের ভাষায় ভাবিত থেকে স্বচ্ছন্দে ভেঙেছিলেন চলচিত্রের গৃহীত রীতিনীতি। এনেছিলেন এক অমোধ স্বাতন্ত্র। এক স্বতন্ত্রীকরণ চলচিত্রের।
চলচ্চিত্র শিল্পের প্রচলিত সনাতন সমস্ত ধ্যাণ ধারণাকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন। দৃশ্যের সঙ্গে কাহিনী, ফিকশনের সঙ্গে ডকুমেন্টারি, এবং বাস্তবের সঙ্গে এবসাট্রাক্টের রসায়ণ বিলকুল বদল করা! গদারের শিল্পকলার এক উজ্জ্বল নিদর্শণ এগুলি।
গদার তাঁর ছবিতে কি কি বিশেষ স্টাই লাইজেশনের মাত্রা দিয়ে ছিলেন – জীবন থেকে আহরণ সৃজনশীলতার প্রাথমিক শর্ত, জীবনের রোমান্টিসিজমের সঙ্গে শিল্প সম্ভাবনার ন্যারেশন। এই জায়গাতেই তিনি রীতি বিরুদ্ধ। এতোটাই যে, সিনেমার টাইটেল পিস – এ ‘পরিচালনা’ শব্দটি ব্যবহার করতেও বিরত!
গদার সচেষ্ট থেকেছেন মার্ক্স, লেনিন, মাও, চে প্রমুখ সংগ্রাম, তাঁদের চিন্তাধারা। তাঁর ছবিতে স্থান পেয়েছে ব্যক্তি আকাঙ্খার সঙ্গে মার্ক্সের আর্থ-সামাজিক দর্শণ। গদার এর নিজের কথা অনুযায়ী, তিনি ডায়ালেকটিক্সে-এ বিশ্বাসী।
একদা যে রোমান্টিক দৃষ্টভঙ্গি ছিল তাঁর, সেটির পরিবর্তন হলো। মানুষ সামাজিক জীব। গদার এর ছবিতে মূখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল ‘চিন্তাভাবনার জগতে বর্ণনামূলক এক দৃশ্যগ্রাহ্যতা’!
বাংলায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় এমন মিলের দ্বন্দ্ব দেখতে পাওয়া যায়। ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’ -তে অপু যেন জাগতিকতাকে ছাপিয়ে এক বাস্তবতার দিকে আকৃষ্ট হয়েছে।
সত্যজিৎ রায় ও তাঁর ছবিতে এমন দ্বন্দ্বের দৃশ্যায়ণ করে দেখিয়েছেন। গদার জীবিতাবস্থায় কিংবদন্তীর সম্মান পেয়েছেন। জাঁ-লুক গদার এর ‘উইক এন্ড’ এর শেষ টাইটেল কার্ড। ১৯৬৮ সালের ছবি।
গদার এর শিল্পী জীবনের সুচনা ১৯৫৯ সালে। এই টাইটেল কার্ডের অনুবাদ ‘সিনেমার শেষ’। গত ১৩ সেপ্টেম্বর এই দীর্ঘজীবী শিল্পীর এসিস্টেড সুইসাইডের খবরে অনেকের মনে পড়েছে, ‘ফ্যাঁ দা সিনেমা’ অনেকের মনে পড়ে নি।
গদার এর ‘উইকএণ্ড’ টাইটেল কার্ড গোদার এর শিল্পীজীবনের বেশ উল্লেখযোগ্য। অথচ কেউ এই নিয়ে কথা বলেছে, কেউ বলেনি। ১৯৫৯ সালে ফরাসী নব-তরঙ্গের পুরোধা হয়ে গদার এর অবতীর্ণ হওয়া।
এর আগে প্রবাদ প্রতিম অঁদ্রে বাজাঁ এর সম্পাদনায় ‘কাইয়ে দু’ সিনেমার ছবি নিয়ে লিখতেন। গদার এর ‘ব্রেথলেস’ ছিলো ফরাসী নবতরঙ্গর অন্যতম প্রথম ছবি। আগনেস ভের্দার ১৯৫৫ সালের ছবি ‘লা পঁত কুর্ত’ এ নবতরঙ্গময় সব বৈশিষ্ট ছিলো। জাঁ – লুক গদার ও ক্লিস মার্কার ছাড়া একমাত্র ভের্দার মধ্যে নবতরঙ্গর ‘স্পিরিট’ শেষ পর্যন্ত জীবিত ছিলো।
১৯৬৮ সালের ছবিগুলিতে গোদার একই সঙ্গে নবতরঙ্গকে প্রসারিত করেন শৈল্পিকভাবে এবং চলে যান সাংস্কৃতিকতায়। গদার নিজেই তাঁর ছবিকে চলচ্চিত্র বিশ্বের মূল্যবান ছবি ‘ব্রেথলেস’ কে ‘বুর্জোয়া’ আখ্যায় ত্যাজ্য করেছেন।
১৯৬৬ থেকে তিনি ক্রমশ মার্ক্সবাদী, লেনিনবাদী ছবির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। প্রথম ছবি থেকেই তিনি নিবিষ্ট শিল্পী ছিলেন, এইবার তিনি মাওবাদী চলচ্চিত্রকার হওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। ১৯৬৮ মে মাসে তিনি গতানুগতিক নির্মাণ ত্যাগ করে জ্যা পিয়ের গোরাঁর সঙ্গে প্যামফ্লেট ধর্মী ছবি বানাতে শুরু করেন।
এর মধ্যে বাদ সাধে ১৯৭১ সালে জীবনহানি করা এক পথ দূর্ঘটনা। গদার এর শিল্পী জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় অবসান ঘটিয়ে তৃতীয় জীবন সঙ্গিনী আন মেরি মিয়েভিলের সঙ্গে প্যারিস ত্যাগ করেন।
১৯৬৬ সালে চলচ্চিত্র উৎসবে ফরাসী পরিচালক ‘অঁরি ক্রুজোঁ’ একটি প্রশ্ন ছোঁড়েন তাঁর দিকে, “আচ্ছা মঁসিয়ে গদার একটি ছবির নিশ্চয় শুরু, মধ্য ও শেষ থাকতে হয়?” গদার এর উত্তর ছিলো, “হ্যাঁ, কিন্তু সেটা ঐ ক্রম অনুসারে থাকবে, এমন কোনো কথা নেই।”
এই উক্তি গদার এর বেশীর ভাগ ছবির আখ্যান বিন্যাসের ক্ষেত্রে উপযুক্ত বলে মনে করেন সিনেমান ভাবুকরা। জাঁ – লুক গদার (Jean-Luc Godard) আমাদের নিউ টেস্টামেণ্ট বর্নিত মৃত্যু থেকে জেগে ওঠা ল্যাজারাস। গদার এর চিকিৎসক বলেছেন, “সম্ভাবনা দেখা গেলেও তিনি বৈকল্যে পৌঁছে যাননি।”
স্বেচ্ছামৃত্যুর সময়ে, “He was not sick, he was simply exhausted.”। তিনি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন ৯১ বছরের অস্থিরতার তারুন্যের পর!