Uncategorized

কলকাতা: স্মৃতির শহর

কলকাতার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য

বিজ্ঞাপন

কলকাতা শুধু একটা শব্দ, একটা নাম বা একটা শহর নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির শিক্ষা ও সংস্কৃতি। এটি বাঙালির সাহিত্যচর্চার বা ভাবধারার পীঠস্থান। বাঙালির সব ধ্যান-জ্ঞান সব এই কলকাতাকে কেন্দ্র করে।

ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা

১৯১১ সাল অবধি কলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী আর এর গুরুত্ব ছিল লন্ডনের পরেই। কলকাতা বলতে আমরা বুঝি হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ময়দান, দুর্গা পুজো, শ্যামলী, সুন্দরী লম্বা চুল মেয়ে, ইলিশ মাছ, মিষ্টি দই, ফুটবল, রসগোল্লা, সন্দেশ।

ভারতবর্ষে শুধুমাত্র কলকাতাতেই আছে ট্রাম, আছে হাতে টানা রিকশা, নন্দন, বিড়লা তারামণ্ডল, রবীন্দ্র সদন, দক্ষিণ কলকাতার লেক। কলকাতা, যাদবপুর, রবীন্দ্র – তিনটি ইউনিভার্সিটি, নেতাজি ইনস্টিটিউট, গঙ্গার ঘাট, দক্ষিণেশ্বরের মন্দির, বেলুড় মঠ, কালীঘাট, মেট্রো স্টেশন, কুমোরটুলি। এখানে আছে টালিগঞ্জ বাংলা চলচিত্রের জন্মভূমি। আরও কত কে ছড়িয়ে আছে তার কোন হিসেব নেই!

মায়ার শহর কলকাতা

কলকাতা বড় মায়ার শহর, অনেকে বলে কলকাতা ঘিঞ্জি, নোংরা, বস্তি – কিন্তু আমি বলি সে তিলোত্তমা। ঐ যে উপরিউক্ত বিবরণ! – ও গুলো সব আমার প্রাণের শহর কলকাতায়। বাড়ীর কাছে সাদার্ন অ্যাভেনিউ। স্কুল-কলেজের জীবনে দেখতাম কি চমৎকার রোড, পরিষ্কার, প্রশস্ত, পরিচ্ছন্ন, দু’পাশে সবুজের হাতছানি। পথের ধারে আলপনার নকশা যেন কেউ কেটে রাখতো!

দু’পাশে সুরম্য অভিজাত বাড়িগুলোর তাদের চাকচিক্য ও দম্ভতার প্রতীক হয়ে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। তেমনই কলকাতার ফুসফুস বলে খ্যাত গড়ের মাঠ। ময়দানের কোল ঘেঁষে ট্রাম লাইন, ছুটির দিনে অলস দুপুরে আমেজ করে একটু ঘুরে আসা। ধীর গতিতে চলা ট্রামে বসে নয়নাভিরাম দৃশ্য – কেউ বা তার পোষা সারমেয় নিয়ে প্রাতঃভ্রমণ এ বেরিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কলকাতার ফুটবল ক্লাব

অনেকেই কলকাতা বলতে বোঝে ফুটবল – যেখানে আছে ইস্ট বেঙ্গল, মোহন বাগান, মোহামেডান স্পোর্টিং ফুটবল ক্লাব। পাশেই কলকাতার রেসকোর্স যেখানে প্রতিনিয়ত কত লোকের আনন্দ ফুর্তিতে কাটে আবার কেউ কেউ দুঃখ নিয়ে ঘরে ফেরে। আছে রেসের ঘোড়া যাদের পালকেরা প্রতিদিন দলাই মালাই করে সুন্দর ভাবে যত্ন করে।

কলকাতার সিনেমা হল

দেখতে পাই – কলেজে যাচ্ছি, বাড়ি হতে দুই পা ফেলিয়া রাজবিহারী মোড়ে বাস বা ট্রাম স্টপে বাস বা ট্রাম ধরা ভাড়া এক দিকের ৮ নয়া পয়সা। কলকাতায় তখন চলতো ট্যাক্সি, ক্যাব বা উবের নয়।

কলেজ থেকে পালিয়ে কাছেই কসবায় ‘আলেয়া’য় সিনেমা দেখা। আর এক পাশেই দেশপ্রিয় পার্কের গা লাগানো ‘প্রিয়া’ হলে আর একেবারে লেকের মাঝখানে ‘মেনকা’ হলে বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখা, ভুলতে পারি না। কলকাতার প্রেম ফ্লেভার প্রথম বুঝেছিলাম নিজের জীবন থেকে। প্রতি রবিবারে যেতাম গান ও গীটার শিখতে। সেখানে হঠাৎ প্রেম!

এখন মনে হয় ক্রাশ! আমার গীটার শিক্ষক – সুদর্শণ, যুবা পুরুষ। শিক্ষক- ছাত্রী প্রেম, বাংলা গল্প উপন্যাসের প্রচলিত বিষয়। সেটি আমার জীবনে নেমে এল। যেতাম লেকে হেঁটে হেঁটে। জলের ধারে চিনেবাদাম খেতে খেতে কবিতা শোনা ও শোনানো। এই প্রেম কলকাতার ফ্লেভার।

পুজোর কলকাতা

পুজোর কলকাতা বিশ্বখ্যাত। জমজমাট প্যান্ডেল, উজ্জ্বল আলোর রোশনাই, বিরাট জন সমাগম। পুরো পৃথিবী কলকাতায় ভেঙে পড়া! এখনো হয় নিশ্চয়ই। জানি না। পুজোর গান, পুজো সাহিত্য সত্যিই কলকাতার এক অবদান।

বিজ্ঞাপন

‘এবার পুজোয় কি গান রেকর্ড হয়ে বেরুবে?’, ‘এবার কি কি রচনা থাকবে? – পুজো সংখ্যাগুলোতে?’ – প্রসাদ, দেশ, আনন্দলোক, আনন্দবাজার, যুগান্তর, বর্তমান, উল্টোরথ, সিনেমা জগৎ, জলসা, আনন্দমেলা, নব কল্লোল, দেব সাহিত্য কুটির প্রকাশিত ছোটদের মোটা মোটা পুজো সংখ্যা – তাতে কি কি কার কার গল্প, উপন্যাস, কবিতা বেরুল।

সে যে কি উত্তেজনা মনের ভিতর! সুনীল, শীর্ষেন্দু, বিমল কর, শঙখ ঘোষ, মহাশ্বেতা দেবী, আশাপুর্না, লীলা মজুমদার!

কলকাতা আইকনিক পরিচয়

আর পুজো গান, কলকাতা আইকনিক পরিচয়! হেমন্ত, সন্ধ্যা, মানবেন্দ্র, মান্না দে, শ্যামল মিত্র আরও কত! কলকাতা সবায়ইকে আপন করে নিতে জানে। অতিথি পরায়ণতায় কলকাতার নাম ডাক আছে। কলকাতার বাঙালী, বাংলা তার মাতৃভাষা- আহা! কি মিষ্টি ভাষা! তাতে সে গর্বিত আর বাইরে থেকে আসা কাজের নানা সুত্রে আসা লোকজন যখন ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে – সে-ও কত মধুর!

কলকাতার খাওয়া-দাওয়া

কলকাতার খাওয়াদাওয়া – মাছের ঝোল, চিংড়ি মালাইকারি, ভাপা ইলিশ, পোলাও, বিরিয়ানী, শুক্ত, সবাই যেমন খায় তেমনই – ল্যাংড়া বোমবাই, গোলাপখাস, ফজলি, হিমসাগর, আম খায়। এমন আর কোথাও কি আছে! আরে ছাড়ো ওসব – কলকাতার মিষ্টান্ন, পায়েস কতো সুস্বাদু, লোভনীয়, পৃথিবী বিখ্যাত!

কলকাতার রসগোল্লা, সন্দেশ, মিষ্টি দই কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি! আচ্ছা ও সবও ছাড়ো – কলকাতার ঝালমুড়ি, আর ফুচকা? সেটা কে কে খেয়েছে! লা-জবাব। যে খেয়েছে সে জানে।

বিজ্ঞাপন

কলকাতার সিনেমা জগত

কলকাতার সিনেমা জগত- সেই ঘাড় বেঁকিয়ে তাকানো সুচিত্রা সেন আর সিগারেট ঠোঁঠে লাগানো উত্তম কুমারের পোজ। বাঁজখাই গলার নায়িকার বাবা কমল মিত্র, অভিজাত চেহারার জমিদার – ছবি বিশ্বাস, ছায়া দেবী ও মলিনা দেবীর গ্রামীণ স্নেহময়ী মাতৃমুর্তি মানুষের মনে উজ্বল থাকবে।

দক্ষিণ কলকাতার সিনেমা গৃহ – বসুশ্রী, উজ্জ্বলা, ভারতী, ইন্দিরা, পুর্ন, মধ্য কলকাতার শ্রী, প্রাচী, পূরবী, উত্তরা তে বাংলা সিনেমা, আর একদিকে কলকাতার বিখ্যাত চৌরঙ্গী এলাকার (এসপ্ল্যানেড) মেট্রো, টাইগার, লাইট হাউস, গ্লোব, এলিট এ ইংরেজী মুভি। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ।

কলকাতার সার্কাস, যাত্রাপালা ও সঙ্গীত

কলকাতার সার্কাস সে কি ভোলা যায়! শীত কালের চিড়িয়া খানায় ঘুরতে যাওয়া, পুরো দুনিয়া অবগত। নামগুলো সুন্দর – জেমিনি, কমলা আরও আছে। কলকাতার রাতজাগা সঙ্গীত অনুষ্ঠান! সে আধুনিক হোক! কি উচ্চাঙ্গ হোক- আলি আকবর খাঁ, আশীষ খাঁর সরোদ, নিখিল ব্যানার্জি, রবিশংকরের সেতার, শিশিরকনা ধর চৌধুরীর বেহালা, ভীমসেন যোশীর ঠুংরি, যশরাজ এর খেয়াল কি নয়! শেষ হতে হতে ভোরের আলো ফুটে উঠতো।

তেমনি কলকাতার যাত্রা পালার কথা না বললে কি হয়! এক সময় মনোরঞ্জনের প্রধান মাধ্যম ছিল যাত্রা। যাত্রার প্রধান কেন্দ্র ছিল মধ্য কলকাতার চিৎপুর। ছিল বিস্বরূপ থিয়েটার। অনেকে সিনেমায় প্রবেশের পূর্বে যাত্রা পালায় নাম করে আসতেন। যাত্রাপালার আবার অনেকগুলো অপেরা ছিল।

কলকাতার ইস্টবেঙ্গল – মোহন বাগান ফুটবল ম্যাচ আর তা জুড়ে ঘটি (পঃ বঙ্গ) আর বাঙাল (পুঃ বঙ্গ) এর জোরদার লড়াই, ঝগড়া না বললে তো কলকাতা অসম্পুর্ণ থাকবে। মোহন বাগান জিতলে চিংড়ি ও ইষ্টবেঙ্গল জিতলে ইলিশ বাজারে অপ্রতুল হয়ে পড়তো।

বিজ্ঞাপন

কলকাতার রোমান্স

কলকাতার লেক, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, আর গঙ্গার ঘাট। কলকাতা রোমান্সের সঙ্গে সমার্থক। আছে এখনকার দিনে ইকো পার্ক, গঙ্গাতীরে নবনির্মিত মিলেনিয়াম পার্ক। ভারতে মোবাইল ফোনের জয়যাত্রা শুরু হয় কলকাতা থেকে। জ্যোতিবাবুই প্রথম মোবাইলে ফোন করেন দিল্লিতে ব্রডকাশর্টিং এন্ড ইনফরমেশন মিনিস্টার কে।

আর আছে কলকাতার পাতাল রেল বা মেট্রো রেল। ভারতে প্রথম পাতাল রেল চলে কলকাতায় সেই ১৯৮৪ সালে। এখন আবার গঙ্গার তলা দিয়ে পাতাল রেলের লাইন পাতা হয়েছে শিয়ালদহ থেকে হাওড়া স্টেশন হয়ে হাওড়া ময়দান অবধি। বছর দেড়েকের মধ্যেই আমরা গঙ্গার তলা দিয়ে সফর করবো মেট্রো রেলে।

শেষকথা

কলকাতার বিস্তার এখন উত্তরে কল্যাণী আর দক্ষিণে বারুইপুর অবধি। পূর্ব প্রান্তে গড়ে উঠেছে আধুনিক শহর, কলকাতার গর্ব নিউ টাউন। এতোগুলো কলকাতা ফ্লেভার বললাম। বাংলা ও বাঙালির সবথেকে প্রিয় শহর এই কলকাতা যার প্রসিদ্ধি সারা জগতে।

এবার আমার পরিচয় দিই- আমি এই কলকাতারই মেয়ে, স্কুল কলেজের শিক্ষা এই শহরে। বিবাহিত হয়ে বাইরে চলে আসি সেই ষাটের দশকে। হয়ে গেলাম প্রবাসী বাঙালি, কিন্তু তাই বলে কি কলকাতা কে ভুলতে পারি!

ছবি: Image by vwalakte on Freepik

বিজ্ঞাপন


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

Related Articles

Leave a Reply

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading