জীবনী

মহানায়ক উত্তম কুমার: ৪৩ বছর পরও অমলিন তারকা

সুচিত্রা সেনের সাথে অমলিন জুটি

বিজ্ঞাপন

মহানায়ক উত্তম কুমার এর প্রয়াণ দিবস ২৪ জুলাই পার হলো। ৪৩ বছরেও আসেনি তাঁর বিকল্প। সত্যজিৎ  রায় ছবি করছেন ‘ঘরে বাইরে’।  উত্তম কুমার কে বললেন, ‘সন্দীপ’ করতে। উত্তম সবিনয়ে অস্বীকৃত হলেন, বললেন, “না, আমি নই, আর কোনও যোগ্য অভিনেতা ঐ চরিত্র জাষ্টিফাইড করতে পারবেন।”

পোর্ট কমিশনার ট্রাষ্টের কেরাণীর চাকরি সামলে পাঁচটা বছরেও অরুণ কুমার চট্ট্যোপাধ্যায় বক্স অফিসে তাঁর একটি ছবিও আনা দুর, সপ্তাহ কিছুও টেঁকাতে পারলেন না ‘হাউজ গুলি’ তে। তাঁর চেহারা যেমন তেমন, ঠোঁট মোটা, উচ্চারণে অপারগ, ইংরেজি জানে না – এই কথাগুলি চারিদিকে, বিশেষতঃ সিনেমা পাড়ায় ও স্টুডিও চত্বরে এক নাগাড়ে শুনতে শুনতে অরুণ যেন পাগল হয়ে উঠলেন।

নিজের ওপর রাগও হয়! পারেন কি তিনি? এমেচার থিয়েটার আর পাড়ার ক্লাবে হারমোনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে আর তবলা চেটাতে!

প্রথম মুখ দেখানো ছবি ‘মায়াডোর’ ক্যান বন্দীই রইলো। পর পর ‘দৃষ্টিদান’, ‘কামনা’ সব ফ্লপ। অপমান কত! পাশের ফ্লোরে পরিচিত প্রদীপ কুমারেরা কাছে গিয়ে দাঁড়াতে তিনি বলেন – কে ভাই তুমি? চিনতে পারছি না তো!

একে একে ‘মর্যাদা’, ‘নষ্টনীড়’, ‘সহযাত্রী’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘সঞ্জীবনী’ সব একই পথের যাত্রী। ডাকসাইটে অভিনেত্রী প্রভা দেবী বলেন – ও করবে  অভিনয়! ওর তো গা হাত পা সব ঠাণ্ডা জল হয়ে গেছে!

বিজ্ঞাপন

মাঝে এক পরিচালক নামটা বদলে অরুপ রাখলেন ফলাফল এক। তখনই তাঁর নাম হলো, ‘ফ্লপ মাষ্টার জেনারেল!’

আবার তাঁর নাম বদল – ‘উত্তম চ্যাটার্জি (কামনা)’। তখন এক ছোট নিউজপেপার লিখলেন, উত্তম কিছুটা অভিনয় এতে দেখিয়েছেন। তার পর তাঁর নাম হলো – উত্তম কুমার।

১৯৫২ সালে ‘বসু পরিবার’ এ ভেবেছিলেন, এ ছবি না চললে ফিরে যাবেন কেরাণী গিরিতে। ১৯৫৩ তে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ এ বাঙালি জীবন একটা নাড়া খেলো যেন! শুধু বাঙালি নয়, বিশ্ব পরিজনের হৃদয়ে  ফুটে উঠলেন পদ্ম কোরক হয়ে। আজ তাঁর ৪৩ বছর পেরিয়ে এলো তাঁর চলে যাবার, আজও তিনি নিত্য আলোচিত নতুন নতুন ভাবে। তিনি সয়েছিলেন শত অপমান টিমটিমে শুকতারার মতো, তিনিই তারকা হয়ে আকাশে জ্বলজ্বল করতে লাগলেন।

তিনিই দেখিয়েছেন, এক অভিনেতাকে হতে হয় ‘ব্লটিং পেপারের মতো’ যে  নিন্দা, অপমান, কেচ্ছা আবার প্রশংসা, স্তাবকতা, সম্মান সব সমান ভাবে শুষে নিতে হয়।

কলকাতায় আহিরিটোলা জন্ম তাঁর। বাবা সাত্যকি চট্টোপাধ্যায়, মা চপলা দেবী। বরুনকুমার, তরুণ কুমার দুই ভাই। তরুণকুমার একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা পরবর্তীকালে। কলেজের পাঠ সমাপ্ত না করা পরিবারে অর্থনৈতিক সমস্যা। পোর্ট ট্রাস্ট কমিশনে কেরাণীর চাকরি মাত্র ৭৫ টাকা মাইনে। রহস্য, সংকল্প, ইচ্ছাশক্তি, পেশাদারিত্ব, হতাশা সব কিছু নিয়ে উত্তম কুমার এর জীবন।

বিজ্ঞাপন

১৯৫২ তে ‘বসু পরিবার’ ১৯৫৩ তে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ তাঁর জীবন শুধু নয়, গোটা বাঙালি জীবনের মোড় ঘুরিয়েছিলো। তিনি প্রথমে অরুণ, পরে অরুপ, তার পরে উত্তম চ্যাটার্জি তারও পরে আজকের ‘উত্তম কুমার’ – বাঙালির নয়ন মণি, কলকাতার রাজকুমার, অলিতে গলিতে ‘গুরু’, এক আইকোনিক।

সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের নারী পুরুষের মনে জাগিয়ে দিয়েছিলেন এক নতুন আশার আলো। এক নতুন অধ্যায় তাঁর রোমান্টিসিজমের মাধ্যমে। যেন তিনি স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক দেবদূত! তাঁর এ এক আশ্চর্য ক্ষমতা পর্দায় তাঁকে দেখতে দেখতে দর্শক নিজেকে বসাতে পারতেন তাঁর স্থানে!

যখন এলেন সুচিত্রা সেন, তাঁর ও সুচিত্রার কেমিষ্ট্রি যেন এক মহাকাব্য। পরবর্তী সময়ে উত্তম বলেছেন, বলা যায় তাঁর স্বীকারোক্তি, ১৯৫৫ সালে  দুজনের ‘অগ্নিপরীক্ষা’ যেন তাঁর জীবনের এক ‘স্পার্কিং’ সময়। আজ আমি উত্তম কুমার হয়ে উঠেছি রমা (সুচিত্রা) এর কারণে।

প্রকৃতপক্ষে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ এর আগে আমার সব নায়িকা বয়স্ক ছিলেন – সন্ধ্যারাণী, অনুভা গুপ্তা, ভারতী দেবী। তাঁদের সঙ্গে আমার রসায়ণ জমতো না, প্রেমের সংলাপ বলতে কোন উত্তাপ বোধ করতাম না, রমা কে দেখলাম, অভিনয় করলাম, জানলাম আমার নায়িকা এসে গেছে।

উত্তম কুমারের অর্ধাঙ্গিনী গৌরী দেবী অপুর্ব সুন্দরী, তাঁকে ভালবেসে উত্তম বিয়ে করেছিলেন। বিধির খেয়ালে ‘সোনার হরিণ’ ছবিতে সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে অভিনয়, প্রনয়, তাঁকে নিয়ে বাসা বাধলেন অন্য গৃহে। গৌরী রইলেন পৈতৃক বাসায়, পুত্র নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি, তিনি মাঝে মাঝে যেতেন সেখানে, লক্ষ্মী পুজো খুব ধুমধাম করে পালিত হতো আগের মতই। ডিভোর্সী সুপ্রিয়া (বেণু) এক কন্যাকে নিয়ে ছিলেন তাঁর সঙ্গে ১৭ বছর ১৯৮০ সাল অবধি উত্তম কুমার এর আমৃত্যুকাল।

বিজ্ঞাপন

একবার হিন্দি জগতেও বলিউডে স্বনামধন্য রাজ কাপুর তাঁকে ‘জাগতে রহো’ ও ‘সঙ্গম’ ছবি অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাঁর সেখানেও সবিনয় প্রত্যাখ্যান।

বৈজয়ন্তীমালাকে নায়িকা করে ‘ছোটি সি মুলাকাত’ (বাংলা হিট ‘অগ্নি পরীক্ষা’) বলিউডে মুখ থুবড়ে পড়লো, ‘কিতাব’ আর ‘দুরিয়াঁ-ও’।

শুধু শক্তি সামন্ত এর ‘অমানুষ’ (হিন্দি ও বাংলা ভার্সন) দুর্দান্ত রুপে সফলতা লাভ করেছিলো। তাঁকে একজনই টেক্কা দিয়েছিলেন। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বেশ ভারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলো তাঁদের। কয়েকটি ছবিতে মুখোমুখি হয়েছেন তাঁরা। স্ক্রিনে তাঁদের সম্পর্ক  যেমনই থাক,  ব্যক্তিগত রুপে তাঁদের সুমধুর সম্পর্ক  ছিলো, সৌমিত্রের কথনে পরিস্কার।

তাঁকে ভেবেই সত্যজিৎ রায় ‘নায়ক’ করেছিলেন ও পরে ‘চিড়িয়াখানা’। উত্তম এর মৃত্যুর পর সত্যজিৎ এর আফসোস – আর একটা উত্তম হবে না।

তাঁর তৈরী ‘শিল্পী সংসাদ’ দ্বারা বহু দরিদ্র শিল্পী ও কলাকুশলীদের উত্তমকুমার তাঁর ‘শো’ এর মাধ্যমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।

বিজ্ঞাপন

২৩ জুলাই ৮০ তে ‘ওগো বধু সুন্দরী’ এর শ্যুটিং করতে করতে তিনি অত্যন্ত অসুস্থতা বোধ করলেও কাউকে জানতে না দিয়ে শ্যুটিং পুরো করেছিলেন, ক্যানসেল না করে। সে দিনই মধ্যরাত্রে নার্সিং হোমে যাওয়া ও অবশেষে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ।

উত্তম কুমার ২০০ এর ওপর ছবি করেছিলেন। পেয়েছেন পদ্মশ্রী ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, এন্টনি ফিরিঙ্গি ও চিড়িয়াখানায়। সিনে অভিনয়ের মাঝে পাবলিক নাটকও করেছেন। স্টার থিয়েটারে তাঁর অভিনীত ‘শ্যামলী’ ৪৪৮টি সন্ধ্যে অতিক্রম করেছিলো।

তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন এলিজাবেথ টেলর, দিলীপ কুমার, ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন ও আরও অনেকে। কলকাতার টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন তাঁর নামে ‘মহানায়ক  মেট্রো’ নামকরণ হয়েছে তাঁরই সম্মানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এক নতুন সম্মান ‘মহানায়ক’ শুরু করেছেন কলা কুশলীদের সম্মান জানাতে।

আজ হয়ে গেলো চার  দশক। টিভি চ্যানেলে আজও তাঁর ছবি প্রদর্শিত হলে দর্শক রুপে সমান ভাবে উপভোগ করেন ঠাকুমা, মা, মেয়ে আর নাতনী উত্তম-ম্যাজিক।

তাঁর ঘাড় বেঁকিয়ে তাকানো, ঠোঁটে অদ্ভুদ কায়দায় সিগারেট রাখা, আর তাঁর সম্মোহক ভুবন মোহিনী হাসি, সর্বোপরি তাঁর অবিস্মরণীয় রোমান্টিসিজমে আজও ভুলে রয়েছি আপামর আমরা বাঙালি।

বিজ্ঞাপন

কৃতজ্ঞতা

অগ্নি রায়


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading