জীবনী

মহাশ্বেতা দেবী: আদিবাসীদের আওয়াজ, বাংলার গর্ব

আদিবাসীদের জীবন ও সংগ্রামের অনন্য কাহিনীকার

বিজ্ঞাপন

জন্ম: ১৪ জানুয়ারী, ১৯২৬ ঢাকা, বাংলাদেশ

পিতা: মণীষ ঘটক (কবি, ঔপন্যাসিক, অবিভাজিত ভারত)

মাতা: ধরিত্রী দেবী (কবি, সমাজসেবী)

কাকা: ঋত্বিক ঘটক (প্রখ্যাত চলচিত্র নির্দেশক)

পতি: বিজন ভট্টাচার্য (লেখক, নাট্যকার, ফিল্ম স্ক্রিপ্ট রাইটার)

বিজ্ঞাপন

পুত্র: নবারুণ ভট্টাচার্য (পত্রকার, কবি কথাকার, ঔপন্যাসিক)

মহাশ্বেতা দেবী বাংলা সাহিত্যকার ও সামাজিক কার্যকর্তা ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকায়। পরে ভারত বিভাজনের সময় কিশোরী বেলায় পরিবার সমেত পশ্চিমবঙ্গে এসে পরবর্তী কালে শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. অনার্স (ইংরেজী) ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. (ইংরেজী) করেন।

এক শিক্ষক ও পত্রকার রুপে জীবন যাত্রা শুরু করেন। এক সময় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধাপক হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু নিজের লেখায় মনঃসংযোগ করতে সেবানিবৃত্তি নেন। ১৯৯৬ তে জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে সম্মানিত হন এবং একাডেমী ও মেগসেসাই পুরস্কারে সম্মানিত হন।

মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসী জনজীবনের যেন সাক্ষাৎ আয়না। তাঁর রচনা এক বিশ্বসনীয়তা বোধ জাগায় আমাদের মনে। এক জবরদস্ত ইতিহাস বোধ। শক্ত জমির ওপর চলতে থাকা এক সশক্ত পদক্ষেপ যেন।

মহাশ্বেতার বর্ণনা মতো, তিনি শোনা কথা বা কোনো রিপোর্টের ওপর ভরসা তথা নির্ভরশীল ছিলেন না। আদিবাসীদের ইচ্ছা, প্রয়োজন, সংঘর্ষ সব সংগ্রহ করতে আকুল হয়ে থাকতেন। কোন ঘটনাকে জানতে বুঝতে সোজা সেই সংঘটিত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতেন গিয়ে। সে দুরবর্তী বা বিপদসংকুল কিনা চিন্তা না করেই।

বিজ্ঞাপন

তাদের ব্যাথা কথা, একটি একটি কথা মনোযোগ লাগিয়ে অনুধাবন করে একেবারে আত্মসাৎ করে নিয়ে নিজ রচনায় যেন ছবি এঁকে দিতেন লিপিবদ্ধতায়। কখনো চরিত্রের নাম পর্যন্ত যথাযথ রেখে দিতেন বদল না করে।

মহাশ্বেতা সর্বদা এই উক্তি দিয়েছেন, আদিবাসীরা কবে তাদের সুযোগ সুবিধা ফিরে পাবে, কবে তাদের লোকজন বুঝতে পারবেন। কেন তাদের সবাই বোঝে না!

তাঁর অনুভব, “অরন্যের অধিকার” -লেখবার পর বিরসা মুন্ডা কে লোক চিনতে পারে। মুখে মুখে তার কথা ছড়িয়েছে, তার জন্মতিথি পালিত হয় আজ ওদের চিনছে তো লোক! এটিও তিনি বলেছেন, পুরো টা না-ই চিনুক, এক বুঁন্দ এক বুঁন্দ করেই তো ঘড়া ধীরে ধীরে ভরে ওঠে।

একবার তাঁর কথায় পাওয়া যায় যে, তাঁর চোখের সামনে এক আদিবাসী কে পিটিয়ে মেরে ফেলবার ঘটনা দেখে তিনি তার ‘ফাইল’ তৈরী করে সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত লড়েছিলে। সেই সময় তাঁর মনে হয়েছিলো এতো বড় বিশাল দেশে চারিদিকে বিস্তৃত ভাবে বসবাস করা আদিবাসীদের জন্য একটি সংযুক্ত সংস্থা বা শাখা খোলা যায়, তাহলে একটি কাজ নিষ্পাদিত হয়। এবং তা হয়েছিল, ১৯৫২ সালের পুর্ব পর্যন্ত যা নজরের আড়ালে ছিল।

যে আদিবাসীরা নিজ সুখ সুবিধে হতে বঞ্চিত হয়ে বিহার, পালামৌ ইত্যাদি স্থানের প্রায় আড়াই কোটি আদিবাসী নিজেদের অধিকার পাচ্ছেনা, বন্ধুয়া মজদুর হয়ে সংঘর্ষপুর্ন জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে তাদের তো সামনে আনা যাচ্ছে। মহশ্বেতা স্বীকার করছেন বার বার আমার যা কিছু, আমার জীবন সব এদের জন্য সমর্পিত। এদের জন্য লড়বো ‘আমি’।

বিজ্ঞাপন

একবার তাঁকে বিবিসি’র (হিন্দি) ললিত মোদী প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি এতো বৈভবপুর্ন নানা পুরস্কারে সম্মানিত এক ব্যক্তি, আপনি আদিবাসীদের জন্য কেন এক আরামযুক্ত জীবন ছেড়ে আদিবাসীদের জন্য লড়াই করছেন? এতে দেশের সরকারের কি প্রতিক্রিয়া?

মহাশ্বেতা জবাব দিয়েছিলেন তিনি কোন গঙ্গা, যমুনা নন। এক ছোট পাহাড়ী নদী সীমিত সংখ্যক লোকের কাছেই পৌঁছতে পেরেছেন। আরও বলেছেন, তিনি এক সাধারণ বাঙালী মেয়ে, মাথার ওপর ছাদ আছে, দু’বেলা খেতে পান, আর কি চাই এক ভারতীয় ব্যক্তির! তিনি এতেই যথেষ্ট খুশী।

হেসে বলেছেন- তার পরিবারের সবাই সাহিত্য ও শিল্পজগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা লোক। তাঁরা যখন জেনেছিলেন, ‘মহাশ্বেতা’ কিছু না কি লিখছে। তো তাঁদের অভিব্যক্তি ঐ টুকি টাকি, ছুটকো, ছাটকা  দু’একটা ‘কলাম’ লিখছে কোন নিউজপেপারে হবে!

শুনতে পেয়ে মহাশ্বেতা নিশ্চয় দৃঢ়তাপুর্বক তাঁর মনে হয়েছিলো দিদিমা, ঠাকুমার কাছে শোনা “ঝাঁসির রাণী” যা খুব আকর্ষণ বোধ বা মুম্বাইতে স্বামী বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বসবাস কালীন ‘বীর সাভার কর’ এর বীরত্ব এর কাহিনী তাঁকে আকর্ষিত করেছিলো।

সেগুলো নিয়ে গল্পের পাতায় উখরে দেবেন। প্রসঙ্গতঃ বলা যায় স্বামী বিজন ইপ্টা সংস্থাপক, নাট্যকার কবি শিল্পী ও স্টোরী রাইটার (মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ফিল্ম- নাগিন) এবং শতকরা কমিউনিস্ট হলেও তিনি নিজে আজীবন লেফটিস্ট ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

“ঝাসির রানী” লেখবার সময় তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল সোজা যাবেন ঝাঁসী। সেখানে সাধারণ লোক ইংরেজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো। শুনবেন সেই সময়টায় ঝাঁসির তার আশপাশ যাওয়া ও বাঘের মুখে হাত দেওয়া এক কথা ছিলো। তখন সেই অঞ্চলে খুংখার ডাকাত মান সিংহের এলাকা ছিলো।

মহাশ্বেতা কিন্তু ভয়ে ভীত না হয়ে ঝাঁসি তে গিয়ে বাস করে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে কথা বলে তাদের কথার সঙ্গে শোনা কথার দস্তাবেজ মিল করে লিখেছিলেন কাহিনী। সেই জনজাতি এমন ভাবে দেখেছিলেন- “পাথর মাটির ফৌজ বানিয়ে, কাঠের কাঠবার, পাহাড় উঠিয়ে ঘোড়া বানাও, চলো গোয়ালিয়র।”

মহাশ্বেতার প্রথম রচনা “ঝাসীর রাণী” আর প্রথম উপন্যাস, “নাতি” । ঐ সময়ে “গণেশ মহিমা” খুব চর্চিত উপন্যাস। শুরুতে কবিতা চর্চা করলেও “ঝাঁসির রাণী” লেখার পর অনুভব করেছিলেন তিনি কথাকার হবেন।

উপন্যাসটি সাগর, জব্বলপুর, পুণা, ইন্দোর ললিতপুরের জঙ্গলে ঘুরে লিখেছিলেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৮ সালে ইতিহাসের মঞ্চে ঘটিত ঘটনা গুলি লেখা। তাঁর “অগ্নিগর্ভ”, “অরন্যের অধিকার”, “১০৮৪ এর  মা” মাহেশ্বর গ্রাম বাংলা কয়েকটি লেখা। ৪০ বছরে ২০ টি সংগ্রহ ও ১০০ টির কাছাকাছি উপন্যাস (সব বাংলা ভাষায়) প্রকাশিত হয়েছে।

মহাশ্বেতা দেবী চিরকাল জমি, মাটির ওপর পা রেখে চলতেন। আদিবাসীদের জন্য, তাদের জীবন ধারা অনুভব করার জন্য গহন জঙ্গলে যেতে পিছ পা হতেন না। তাদের সঙ্গে বাস করে, কথাবার্তা বলে তাদের দৈনন্দিন সাধারণ আচরণ নিয়ে নিজের লেখন জীবন্ত করেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

এই জন্য আজ সাহিত্য দুনিয়ায় তাঁর লেখা ‘ধরোহর’ রুপে মান্য হয়। তিনি মানব অধিকার নিয়েও অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। এক বার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, “আপনি এতো বিভিন্ন আদিবাসী চরিত্র নিয়ে থেকে তাদের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন না?”

হেসে তাঁর উত্তরে বলেন, “ঐ আদিবাসীরা আমার রক্তে মজ্জায় মিশে আছে, তাদের জীবনের সঙ্গে আমি চলি, তারা আমার জীবনের সঙ্গে।” ‘অরন্যের অধিকার’, ‘জঙ্গল’, ‘১০৮৪ এর মা’ নকশাল আন্দোলন নিয়ে, একটা ব্রেস্ট ক্যানসার নিয়ে “ব্রেস্ট গিভার” নিয়ে লেখা।

“অক্লান্ত কৌরব”, “রুদালী”, “নীল ছবি”, “ইঁটের ওপর ইঁট” এ সবের হিন্দি অনুবাদও আছে। “অরন্যের অধিকার” একাডেমী পুরস্কারের অধিকারী। তিনি বলেন, “আমার স্বামী কমিউনিস্ট হলেও আমার কিন্তু সর্বদা সাম্যবাদে আস্থা আছে।”

“১০৮৪ এর মা” -এই বিষয়ে বলেছেন- কলকাতায় রাস্তা ঘাটে, বিরোধী পার্টিতে, সরকারী পুলিশ সব জায়গায় তরুণ, যুবকদের চোখের সামনে হত্যা হতে দেখেছেন। তখন তাঁর পুত্র নবারুণ ও নিজের আটজন বন্ধু কে বিনা দোষে নকশাল অপবাদে হত্যা করা হওয়ায় সে ব্যথিত হয়ে একটি কবিতা- “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়” -রচনা করেছিলো। পড়ে আমি অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেছিলাম।

ঐ সময় আমায় দুই যুবক অভিযোগের সুরে বলেছিলো আপনি শুধু আদিবাসীদের জন্য লিখবেন? কলকাতার মাটি রক্তে লালে লাল হচ্ছে। কিশোর তরুণদের নির্বিচারে হত্যা হচ্ছে, কলকাতায় এতো রক্তের লীলা, আপনাকে উদ্বেলিত করে না? সেই সময় লেখা “১০৮৪ এর মা” আমি রাজনীতি জানি না, তাই নায়কের মায়ের চরিত্র কে রাজনীতি নয়, সাধারণ মায়ের রুপে চিত্রিত করেছি।

বিজ্ঞাপন

মহাশ্বেতা দিনে ১৮ থেকে ১৯ ঘন্টা লেখন কার্যে ব্যয় করতেন। এমন প্রতিভাশালী লেখিকা আমাদের মধ্যে বিরল।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading