মাইকেল বা শ্রী মধুসূদন: পোশাক ও পরিচয়ের সংঘাত
যশোরের কপতাক্ষ তীরে জন্মগ্রহণকারী মধুসূদন দত্তের জীবন ও কাব্যকর্মের এক অধ্যয়ন
মধুসূদনের জীবনে অমোঘ এক শব্দক্রম, “তবু এ আশার নেশা ছুটিল না।” যশোরে সাগর দাঁড়ি কপতাক্ষ তীরে/জন্ম ভূমি হলেও তিনি যেন এক ইউরোপ জাতক। আশার ছলনে ভুলে যাওয়া উনিশ শতকের কোন উপনিবেশের সামনে দুটি পথ – মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়া। তিনি তাঁর প্রাণের বন্ধু গৌরচন্দ্র বসাক কে লিখছেন,
“Oh! How Should I like to see you write my ‘life’ if I happen to be a great poet while I am always sure I shall be, if I can go to England.”
মধুসূদনের আশা তাঁকে ভাবতে বাধ্য করে এ বঙ্গদেশ তাঁর জায়গা নয়। তাঁর লক্ষ্য Albions Distant Shore – ইংল্যাণ্ড। তাঁকে বিলাপ করতে হয় – যশোলাভ লোভে আয়ু কত কি যে ব্যয় হায়! কবে তা কাহারে! আর সাধিতে মনের সাধ! ব্যরিষ্টারি পড়তে হবে!
মধুসূদন থেকে মাইকেল হয়ে ওঠা যেন এক পোশাক গায়ে দেওয়া! মাইকেল নামক পোশাক তাঁকে এক পরিচিতি দিয়েছিলো। শুধু যে বিয়ে করবার জন্য তাঁর খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করা তা নয়। মিশনারিদের এক বিরাট জয় সেটা। মধুসূদনের আশা ক্রিশ্চান ধর্মে তিনি পাশ্চাত্য জগতে প্রবেশ করে তিনি ইংরেজ কবি হতে পারবেন।
ক্রিশ্চান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি নিষ্কাাসিত হলেন হিন্দু কলেজ থেকে দু’বছর নষ্ট করে শিবপুর বিশপস কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন কিন্তু তাঁর জনক রাজনারায়ণ বসু তাঁর মাসিক মাসোহারা হঠাৎ বন্ধ করেন, নিশ্চয় পুত্র কে ঘরে ফেরাবার আশায়। উদভ্রান্ত মধুসূদন মাদ্রাজে একটি চাকরি পেয়ে সেখানে রওয়া হন। মধুসূদন জানেন তিনি ‘নিগার’।
ইংরেজ তাঁকে তাঁর দেশীয় পরিচয়ে জন্য তাঁর সঙ্গে মিশ্রিত হতে পারবে না। তাঁকে এগোতে হবে মেধায়, বৈদগ্ধে। নানা পত্র পত্রিকায় লেখা, সম্পাদনা ইউরেশিয়ান ও হিন্দু ক্রনিকলে আর প্রথম বাঙালি মধুসূদন এক ইংরেজ কন্যা রেবেকা টমসন এর সঙ্গে কোর্টশিপ করে তাকে বিয়েও করলেন। আর মাইকেলও হলেন। ম্যারেজ সার্টিফিকেটে নাম সই হলো ‘মাইকেল’। তাঁর অনুভব – I have had to do in the way-no easy matter-specialy for a friendless stranger.
তিনি বুঝেছেন বর্ন বিদ্বেষ, বুঝেছেন তিনি পোশাকে, মননে, খাদ্যে আচারে ইংরেজ হলেও থাকতে হবে তাঁকে ব্ল্যাক টাউনে নেটিভের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায়। তিনি কিন্তু বাংলা ভাষা ভুলে যাচ্ছেন দ্রুত। আবার মনে সংশয়ও জাগে তিনি কি পারছেন পুরো ইউরোপীয়ান হতে! সম্পুর্ন এক ‘মাইকেল!’
বন্ধু গৌর কে লেখেন, Did you ever see me in my European clothes! I make a possible Tash Firingee!
তাঁর ইংরেজ চর্চায় ব্লু -আইড মেইড, আ লেডি, ইউলিসিস, দ্য ক্যাপটিভ লেডি সাকুল্যে এই! মাইকেল নামক পোশাকে তাঁর অস্বস্তি বাড়ে যিনি এমন লিখলেন I love the language of Anglow Saxon. Yes I love the language… যার জন্য লজ্জিত হতে হয় এটি মধুসূদনের লেখা! তিনিই পরে লেখেন, ‘হে বঙ্গ ভব সংসারে তব’ বা ‘রেখো মা দাসেরে মনে’।
মধুসূদন ফের প্রেমে পড়েছিলেন আর এক ব্লু আইড মেড হেনরিয়েটার সঙ্গে যিনি মধুসূদনের সহকর্মীর কন্যা। মধুসূদন ছাড়লেন চার সন্তানের জননী রেবেকাকে, বাসা বাধলেন হেনরিয়েটার সঙ্গে। রেবেকার সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি আর হেনরিয়েটার সঙ্গে বিয়ে হয়নি তাঁর। লিভ-ইন সংসারে মাইকেল প্রথম দিশারী বাঙালি হিসেবে।
আট বছর পর কলকাতায় ফেরা পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধারে। এবং ফেরা বাংলা ভাষায়। তাঁর জীবনের লিটারারি ‘বুম’ পিরিয়ডে। টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরে দুলাল নাটকের কথ্য ভাষা শুনে তীব্র আপত্তি জানানো বলা আমি এক সাহিত্য ভাষা সৃষ্টি করে দেখাবো বলে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। ধীরে ধীরে ‘শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯ তাঁর জয়লাভের জয়ডংকা)’, ‘মায়া কানন’ – দুটি প্রহসন। এর পরই তাঁর মেঘনাদ বধ কাব্য – ধ্রুপদী এক শব্দ যজ্ঞ। দুর্লভ এক কার্নিভ্যাল।
তিনি সরে এলেন বাল্মীকি কৃত্তিবাস থেকে। দেবতা নয়, দানব তাঁর মহাকাব্যে। ঐশ্বরিক ক্ষমতার কাছে সেই রাক্ষসরা অসহায়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের মিলিয়েছেন মধুসূদন। তাঁর রাবন, মেঘনাদ পাপী নয়। তারা ভেবে পায় না রাঘব কেন রাক্ষসকুলকে উৎখাত করতে এসেছেন তারা বোঝে না। কি করেছে তারা! সীতাহরণ পাপ কেন হবে! সে তো একটি ‘কর্ম’। রাবনের কর্মফল। কিন্তু রাবনও কি বুঝেছিলো! শোনা যায় রাবনের বিলাপ- কি কুক্ষণে দেখেছিলি তুই রে অভাগী!/কাল পঞ্চবটী বনে কালকুঠে ভরা/এ ভুজঙ্গে, কি কুক্ষণে… পাবক শিখা রুপে জানকীরে আমি/আনিনু এ হেন গোহে?
কেন সীতাহরণ পাপ হবে রাবন বোঝে না তাই কে বীর চুড়ামণি- পুত্র অকালে যমপুরী চলি গেলা রে! কি পাপ দেখি না মোর, রে দারুণ বিধি, হরিলি এ ধন তুই? ইউরোপে রেনেসাঁস পরবর্তী কবিতায় মিলটনের মত কবি নিজের বিশ্বাস চালিত করছেন অর্থাৎ (পার্সোনাল প্রাইভেট) প্রবনতা।
মধুসূদনের রাবন ও মেঘনাদ পোস্ট ইউরোপীয়ান – রেনেসাঁস চরিত্র। মধুসূদনের রাম লংকায় এক ‘আগন্তুক’। কলোনাইজার। রাবন কলোনাইনাইজড, প্রান্তিক বা সাব-অলটার্ন। তারা যেন না বুঝে, না জেনে ডেকে আনে নিজের বিপদ।
এই সময়ে ঘটে গিয়েছে ১৮৫৭। কবি তাতে তেমন কৌতুহল দেখান নি। তিনি তখন অসংযত অমিতব্যয়ী গর্বিত মধুসূদন। গৌরচন্দ্রকে লিখছেন- Bengali is very beautiful language… কবি ফ্রান্সে বসেই লিখেছিলেন প্রথম বাংলা ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নর কবিকুল পিতা তুমি মহামতি/ব্রহ্মদন্ড এ সুখন্তে… ভাষাগত ভাবের বদলে গেলেন, সই করলেন- M.M.Dutt.Michael Madhusudan Dutta
পরিণত বয়সের রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ১৩৩৫ সনে এ কথা সত্য সাহিত্যে মেঘনাদ বধ কাব্য তার দোহার পেল না। একলা রয়ে গেলো। মাইকেল বাংলা ভাষার স্বভাব কে মেনে চলেন নি। তাই তাতে বীজ ফললো না।
অবশ্য এ কথাও সত্য যে মধুসূদন বাংলা কবিতায় এমন কতকগুলি কাজ করেছিলেন যা ছিলো একেবারে নতুন। তাঁরই পরীক্ষা নিরিক্ষায বাংলা কবিতা ঝকঝকে তকতকে রুপে ফুটে উঠেছে। পয়ারের কয়েদ থেকে মুক্ত করা, সনেট ও এপিটাফ রচনা, মিত্রাক্ষর থেকে অমিত্রাক্ষরে কবিতাকে নিয়ে যাওয়া, এর জন্য আধুনিক বাংলা কবিতা মধুসূদনের কাছে ঋণী থাকবে। এ কথা রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করেছেন। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য যবনিকা উত্তোলন শুধু মাত্র, আসল পালা রবীন্দ্রনাথের হাতে।’
আবার এ কথা না মেনে উপায় নেই মধুসূদনের জন্য আমরা জীবনানন্দের অক্ষরবৃত্তি পেয়েছি। যে বিদ্যাসাগরের বহুবার অর্থসাহায্যে মধুসূদন বিপদ ও ঋণ মুক্ত হয়েছিলেন সেই বিদ্যাসাগরের অনুকরণে মধুসূদন পাঠ্যপুস্তক রচনা করে উপার্জন করতে গিয়ে অসফল হয়েছিলেন।
তারপর তিনি নির্জলা হুইস্কি পান করে আত্মহত্যার রাস্তা বেছে নিয়ে ছিলেন। ক্রমশঃ স্তিমিত, রুগ্ন হয়ে কলকাতা প্রেসিডেন্সি হাসপাতালে ১৮৭৩ এ আষাঢ়ে প্রয়াত হলেন তিনি ‘দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন’। মাইকেল নামক পোশাক তখন মিশে গিয়েছে শ্রী মধুসূদনে।
তাঁর সমাধিতলে লেখা আছে,
দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে
তিষ্ঠ ক্ষণকাল।
কৃতজ্ঞতা
গোলাম মুরশিদ
অংশুমান কর
সায়ম বন্দ্যোপাধ্যায়
Discover more from অভিযাত্রী
Subscribe to get the latest posts sent to your email.