সুচিত্রার কথা লিখতে কলমে লাগাম লাগাতে হবে, উচ্ছাসহীন হতে ইচ্ছে করলেও হওয়া যায় না। বিরাট ক্যানভাসে যেন তুলি দিয়ে আঁকা এক স্কেচ। আপন মনোবিহারিনী সুচিত্রার কোন জীবন কাব্য নয়, শুধু তাঁকে ছুঁয়ে যাওয়া।
পর্দায় হাজার হাজার দর্শকের সামনে বিরাজমান সুচিত্রা তাঁর জীবন কথা জন সাধারণের গোচরে আনার বিরোধী ছিলেন। তাঁর অন্যতম জীবনীকার গোপালকৃষ্ণ রায় এর কথায় – সুচিত্রা বলেন, “আমি আপন মনোবিহারিনী হয়ে থাকতে চাই। মনের দরজায় তাই তালা লাগিয়ে দিয়েছি। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তালা লাগানো থাকবে। চাবি তো হারিয়ে ফেলেছি।”
“চাবি হারিয়ে ফেলেছ তাহলে ভাঙছো না কেন?”
সুচিত্রার জবাব, “ভাঙা সহজ, জোড়া নয়। তাই তা ভাঙতে চেয়ো না।”
সুচিত্রার ভুবন মোহিনী হাসি- এই হাসি তাঁর সহজাত। চেষ্টা করে কি এই হাসি আনা যায়! সুচিত্রা বলেন, “হ্যাঁ, এই হাসি আমি পেয়েছিলাম, তাই আজ আমি সুচিত্রা। বলেন কিন্তু ‘রমা সেন’ গম্ভীর মুখেই।
রহস্যময়ী সুচিত্রা
বাবার আহ্লাদিত মেজো মেয়ে, তিন ভাই, পাঁচ বোন তাঁরা। দেশভাগের পর বোলপুরে এসে থাকা। বাবা করুনাময় দাশগুপ্ত মা ইন্দিরা। বাড়ীর ডাক নাম কৃষ্ণা। সিনেমায় এলেন, পরিচালক নাম দিলেন ‘রমা’ থেকে ‘সুচিত্রা’। ব্যারিস্টার বড়ঘরের দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে ১৯৪৭ সালে। সে ঘর বেশীদিন টেঁকসই হয় নি মাঝে একটি কন্যাসন্তান (মুনমুন সেন – পরবর্তীতে সিনেমা নায়িকা হওয়া, মায়ের ধারে কাছেও আসতে পারে নি।)
যখন করছেন ‘সাত পাকে বাঁধা’ তখন তাঁর ঘর ভাঙছে। আর যে ছবি ‘প্রণয় পাশা’ সেটি তাঁর শেষ ছবি। তাঁর সঙ্গে হলিউড অভিনেত্রী ‘গ্রেটা গার্বো’র তুলনায় তিনি বলেছিলেন, না তা একেবারে নয়। আমি চেয়েছিলাম আপন মনে থাকতে। শুধু সাধছিলো রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’র ‘দামিনী’ করবো। সাধ তো পূরণ হয় নি। বেলুড় মঠের ভরত মহারাজ, যিনি স্বামী অভয়ানন্দ, তিনি আমার মন্ত্র গুরু। মাঝে মাঝে কাকভোরে তাঁর কাছে যেতাম, কিন্তু তাঁর চলে যাওয়ায় আর হয় না যাওয়া।
গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু
১৯৫৪ সালে ‘অগ্নিপরীক্ষা’র গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে তাঁর লিপএ নায়িকা তাপসীর গান ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ সেই গানে আজও বিভোর হয়ে আছি আমি, অশীতিপর বরষে আজও হয়ে আছি এক পঞ্চদশী কিশোরী কন্যা। এই অগ্নিপরীক্ষায় মহানায়ক উত্তমকুমার (তার আগে পর্যন্ত ফ্লপ মাস্টার উপাধি বিভূষিত) খুঁজে পেয়েছিলেব তাঁর যোগ্য রোমান্টিক জুটি। তারপর সব ছবি হিট আর হিট। তার আগে ১৯৫৩ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দিয়ে শুরু।
তারপর ক্রমে ‘সাগরিকা (১৯৫৬)’, ‘হারানো সুর (১৯৫৭)’ ‘পথে হলো দেরী (১৯৫৭)’, ‘রাজলক্ষী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রাণী (১৯৫৮)’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯)’, ‘সপ্তপদী (১৯৬০)’, ‘সাতপাকে বাঁধা’, ‘উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬২)’, ‘গৃহদাহ (১৯৬৭)’, ‘দেবী চৌধুরাণী (১৯৭৪)’, ‘দত্তা (১৯৭৬)’ এবং শেষ বাংলা ছবি ‘প্রণয় পাশা’।
এই উল্লিখিত ছবিগুলি ছাড়াও আরও বহু ছবি হিন্দি গুলি – দেবদাস, মুসাফির, চম্পাকলি, বোম্বাই কা বাবু, সরহদ, মমতা, আঁধি। প্রথম প্রথম উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন। এমনটা প্রথমে সুচিত্রা প্রোডিউসার কে বলেছিলেন তাঁর নাম উত্তমের আগে দিতে হবে তারপর থেকে সুচিত্রা-উত্তম।
সুচিত্রার কিছু নায়ক
অভিনেতা হিসেবে দিলীপকুমার কে খুব শ্রদ্ধা করতেন। সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে ও ভালো বন্ধুত্ব। সব সময় সঞ্জীব তাঁকে ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকেন। আহা! বেচারা অল্পবয়সে হার্টের অসুখে মারা গেলো। রাজকাপুরও এসেছিলেন একবার সাদা নেক টাই, হাতে একরাশ লাল গোলাপ নিয়ে। বসতে বলে দেখি তিনি আমার পায়ের কাছে বসেছেন। সেই ভাবেই গোলাপের তোড়া উপহার দিলেন ও তাঁর প্রযোজনায় একটি ছবি করার অনুরোধ করলেন। দুর! কোন পুরুষ মানুষ মেয়েদের পায়ের কাছে বসেন নাকি! রিফিউজ তাঁকে।
পরিচালক সত্যজিৎ এসেছিলেন ‘দেবী চৌধুরাণী’র অফার নিয়ে সঙ্গে অদ্ভুত সব শর্ত। তাঁর ছবিতে কাজ করার সময় অন্য ছবিতে শ্যুটিং বন্ধ রাখতে হবে। সত্যজিৎ কেও ফিরিয়ে দেওয়া।
গ্ল্যামার গার্ল সুচিত্রা
১৯৫৩ সালে যে শিল্পীর আগমন, কিছু দিন পরে অসামান্য গ্ল্যামার কন্যা হয়ে তাঁর অভ্যুদয়। গ্ল্যামার শব্দটির আভিধানিক অর্থ যাই হোক, সুচিত্রা সেনের গ্ল্যামার প্রসঙ্গ অভিনব। সেই মেয়ে যে আবাল্য পুরুষের মন কে দোলা দেয়, ঈষৎ হাসি, ছোট একটি কথা সলাজ বা সপ্রতিভ ঘাড় বেঁকিয়ে তাকানো এ সবই গ্ল্যামার গার্ল সুচিত্রার মুগ্ধ করানের হাতিয়ার। সবাইকে যা দিয়ে ভাসিয়েছিলেন।
রোমান্টিক জুটি – স্টার সিস্টেম
সুচিত্রা-উত্তমের রোমান্টিকতা নিয়ে আলোচনা কখনো ফুরোবে না। সুচিত্রার পোশাক, তাকানো, হাসি, উত্তম কুমারের চুলের স্টাইল যুবক-যুবতীরা নকল করতো। তাঁদের ভঙ্গিমায় নবদম্পতিরা ছবি তোলাতো। লক্ষী, সরস্বতী প্রতিমা সুচিত্রার আদলে গড়া হতো। উত্তম একবার স্বীকার করেছেন, “সুচিত্রা কে পাশে না পেলে তিনি কখনো আজকের উত্তম কুমার হতে পারতেন না। এ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো।”
নিষ্পাপ কোমলতার সুচিত্রা
সুচিত্রার কথা বলতে আসবেই মহানায়কের কথা। এঁদের দুজনের স্বাভাবিক হাঁটা চলা, ও স্বতঃস্ফূর্ত তার কোন মাপকাঠি নেই। আর একটি ব্যাপার তাঁদের বাঙয়লিয়ানা। সুচিত্রার আর একটি প্লাস পয়েন্ট তাঁর নিষ্কলুষ সারল্য, নিষ্পাপ কোমলতা।
মুডি সুচিত্রা
সাত পাকে বাঁধার শ্যুটিং য়ে একটি টিয়া পাখী নিয়ে কয়েকটি দৃশ্য হয়ে গেছে সুচিত্রা সেই পাখীকে ছেড়ে দিতে বললেন। আজ্ঞা পালন হলো। সুচিত্রা হাতে তালি দিয়ে টিয়া কে আকাশে উড়িয়ে দিলেন। পরিচালক অজয় কর এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় সুচিত্রা বলেন, ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। তাই ছেড়ে দিলাম। সরি!
আবার নিউমার্কেটে গিয়ে পাখী কিনে আনা ও শ্যুটিং করতে তিন/চার ঘন্টা লেগে গেলো। এক প্রডিউসারের না কি গোঁফ কামাতে হয়েছিলো সুচিত্রার জন্য। তাঁর কিছুতেই নাকি গোঁফটা দেখে শ্যুট করার মুড আসছিলো না।
পুরস্কার
‘সপ্তপদী’ করে সুচিত্রা-উত্তম যুগ্ম ভাবে বিএফজে অ্যাওয়ার্ডস পেয়েছিলেন। ও ‘সাত পাকে বাঁধা’য় সুচিত্রা মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ নায়িকা সম্মান দিয়েছিলেন যা তাঁর আগে শুধু নার্গিস মাদার ইন্ডিয়ার জন্য কোন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিলেন।
পদ্মশ্রী সুচিত্রা সেন
ষাটের দশকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পদ্মশ্রী পাওয়া। তবুও তিনি ইন্টারভিউ দিতে রাজি হননি। একজন বলেন, তাই তো তোমায় নিয়ে গুজব সুচিত্রা! তাঁর বিখ্যাত ভঙ্গি ঘাড় বেঁকিয়ে বলা- “আমি তো ন্যাশনাল প্রপার্টি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ। যার খুশী যা ভাবুক, বলুক স্বপ্নও দেখতে পারে!”
আজও তাঁর চলে যাওয়ার পরও তাই হয়ে চলেছে। চলছে…
কৃতজ্ঞতা
অমিতাভ চৌধুরী
সুমন গুপ্ত
গোপালকৃষ্ণ রায়