জীবনী

তরুণ মজুমদার: বাংলা সিনেমার এক আইকন

'পলাতক' থেকে 'জীবনপুরের পথিক' পর্যন্ত এক অবিস্মরণীয় যাত্রা

বিজ্ঞাপন

‘সিনেমা পাড়া’ পেরিয়ে ‘পলাতক’ তরুণ মজুমদার! হতে পেরেছেন কি! নাম যাঁর তরুণ! সঙ্গে রয়েছে ‘দাদার কীর্তি’, ‘বালিকা বধু’, ‘শ্রীমাণ পৃথ্বীরাজ’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘কুহেলি’, ‘ঠগিনী’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘ভালবাসা ভালবাসা’, ‘আলোর পিপাসা’, ‘গণ দেবতা’, ‘নিমন্ত্রণ’ আরও অনেক।

শ্রীমতী পিকচার্সের সঙ্গে যুক্ত হয়ে “ত্রয়ী” দিলীপ মুখোপাধ্যায়, শচীন মুখোপাধ্যায় ও তরুণ মজুমদার এর মিলিত প্রডাকশনের প্রাথমিক তৈরী নিরাপদ হওয়ার তাগিদে স্টারডম যুগল জোড়ী, উত্তম – সুচিত্রার ‘চাওয়া পাওয়া’ এবং সুচিত্রা কে নিয়ে ‘স্মৃতিটুকু থাক’ পরে নতুন দের নিয়ে ‘কাঁচের স্বর্গ’ তারপরেই ‘পলাতক’ (যেন দুন্দুভি বাজিয়ে দিলো যুদ্ধ জয়ের)। কিন্তু ভিন্ন মতে ‘কাঁচের স্বর্গ’ তে বিজয় অভিযানের বিউগিল শুনতে পেয়েছিলেন অধিকাংশ লোক।

চিত্র জগতে পরিচিত ‘তনু দা’ বা তনুবাবু নামে পরিচিত তরুন মজুমদার। প্রাণশক্তিতে ভরপুর তনু বাবুর জন্ম কলকাতায় হলেও তিনি মুলতঃ আজকের বাংলা দেশে এর ‘বগুড়া’য় একান্নবর্তী পরিবারের ছেলে। সেই পুর্বপাকিস্তানের বগুড়ায় বাবা বীরেন্দেনাথ ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, কাকারা জেলে বন্দী, জ্যাঠামশায় ফরিদপুর জেলে মারা গিয়েছিলেন।

বাবা বলেছিলেন, “তোমার যা ইচ্ছে করো” । কলকাতার সেন্ট পলস ও স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়া  তরুণের পারিবারিক পরিবেশ ভবিষ্যৎ চিত্রপরিচালকের অনিশ্চিততা কাম্য ছিল না। কলকাতায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ডিসিকা, রোজেনিলির ছবি দেখে দারুণ নাড়া খেয়েছিলেন তরুণ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বস্ত ইউরোপের মানুষের সংকট তাঁকে উপলব্ধি করালো ভালো ছবির সঙ্গে একাত্মতা ও ‘কমিউনিকেশন’ কোনো ভাল ছবি করতে কি বৃহৎ প্রেরণা হয়ে উঠতে পারে! নিয়মিত ভালো ছবি দেখা, ভালো বই পড়া, ভালো গান শোনা তাঁর মতো সৃজনমনস্ক ব্যক্তিত্বর ভিতর খুব দ্রুত, যাকে বলে ত্বরিত গতিতে আলোাড়িত করেছিলো।

বিজ্ঞাপন

বিদেশের ছবি, সঙ্গে ভারতীয় ছবি দেখে – প্রমথেশ বড়ুয়া, নীতিন বোস, দেবকী বসু ভি, শান্তারাম, বিমল রায়ের ছবি দেখার অভিজ্ঞতা অন্য দিকে গণনাট্য সংঘ আন্দোলন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস সুচিত্রা মিত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস কে প্রথম চেনা!

পরে তরুণ বাবু বলেছেন, এ সব অভিজ্ঞতা ভিন্নও যখন। ‘পথের পাঁচালী’ দেখলাম আমার ভাবনার জগতে তুমুল তোলপাড় মেলে দিলো। মনে হলো- এক পা এক পা করে যে ভারতীয় ছবি সিঁড়ি উঠছিল ধাপে ধাপে সে যেন এক লাফে একসঙ্গে “টপ” সোপানে পৌঁছে গেলো।

সেই সময় সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক এর ত্রয়ী মিলনে সমারোহ। কিন্তু এই বিরল মানুষটার মূল্যবোধ ও মানুষের প্রতি বিশ্বাস অটল। তিনি মানুষের ক্ষতি করে সিনেমা বানাতে চান না- অগ্রজ দেবকী বসুর উচ্চারিত উক্তি তাঁর অন্ধের যষ্টি কে সারা জীবন মেনে এসেছেন।

‘যাত্রিক’ এ নিরাপত্তার চাবিকাঠি রুপে স্টারডমের আশ্রয় নিলেও তনু বাবুর মনে স্থান পেয়েছিলো অন্য আশা, ভিন্ন ভাবনা। দর্শকের সামনে বাঁধাধরা ইমেজ নয়, পথের মোড় ঘুরিয়ে পরিবেশন করতে হবে।

তিনি চির দিন ‘জনপ্রিয়’,  এই শব্দ বন্ধটি পছন্দ করতেন। বলেছিলেন একবার! মডেল হিসেবে কিন্তু এটা সত্য যে জনপ্রিয় ছবি ও ভালো পরিচালক একই সঙ্গে সম্ভব- এতে কোন বাধা হতে পারে না।

বিজ্ঞাপন

তাঁর ‘আলোর পিপাসা’ থেকে (যখন তিনি যাত্রিক থেকে সরে এসে স্বাধীন চিত্র পরিচালনা করছেন) প্রত্যেক ছবি উপস্থাপনা করে খুঁতসম্পন্ন অথচ অসাধারণ মানুষ গুলো নিয়ে। শুধু কলকাতা নয়, ছেড়ে আসা দেশ, গাঁ, গঞ্জ, বিশ্বাস, ভালোবাসার পারিবারিক কাঠামো তাঁর ছবির বুনন।

সব প্রজন্মকে আনন্দ দিতে মনে হয় তরুণ মজুমদার একমাত্র সফল পরিচালক। বাণিজ্যসফল পরিচালক রুপে তিনি সত্যজিৎ রায় থেকেও সফল এই উক্তির ব্যতিক্রম নেই স্বয়ং সত্যজিৎ তাঁর ফিল্মের অনুরাগী ছিলেন।

“পদ্মশ্রী” ও বহু জাতীয়, ফিল্মফেয়ার, আনন্দ পুরস্কার বিজয়ী লিখে ছিলেন এই বই গুলি- গল্পগ্রন্থ- ‘বাতিল চিত্রনাট্য’, প্রবন্ধ- ‘নকশি কাঁথা’, ‘সিনেমা পাড়া দিয়ে’ (অসমাপ্ত রয়ে গেলো তাঁর দেহাবসনে)।

তরুণ মজুমদার, রবীন্দ্রসঙ্গীত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সমার্থক। অত্যন্ত নিপুণতায় প্রয়োগ হয়েছে তাঁর ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত হেমন্তর হাত ধরে পরিচালকের মনস্বিতায়। তনু বাবু শুধু সুর নয় হেমন্তর ‘ভয়েস’ ও ব্যতিক্রম হতে দিতেন না।

‘পলাতক’ এ বাউল আঙ্গিকের গান এ সুরকার রুপে হেমন্ত প্রথমে সরে দাঁড়িয়েছিলেন- ওরে না রে আমি ঐ ধরণের সুরে ‘পোক্ত’ নই, আমারে ছাইরা দে, পারবো না। কিন্তু তরুণ বাবু তো সেই সুদূরের দুর দৃষ্টি দিয়ে হেমন্তকে যে শুধু করালেন, তাই নয় তাঁর কন্ঠও ব্যবহার করলেন।

বিজ্ঞাপন

জেনেছিলেন, ‘জীবন পুরের পথিক রে ভাই, কোন সাকিন নাই’ -তে তরুন জেদ করে করিয়েছিলেন, তার ফল প্রমাণসাপেক্ষ। ‘দাদার কীর্তি’ -তে কি অসাধারণ দৃশ্যপট তাপস পাল এর কি চমৎকার লিপ মুভমেন্টে রবীন্দ্রনাথের, ‘চরণ ধরিতে দিও গো মোরে, নিও না সরায়ে’।

ঐ ছবিরই কি এক অসামান্য দৃশ্যপট, আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া, দেবশ্রী রায়ের লিপে, ‘বয়েই গেছে’ এক চটুলতায় ভরা অরন্যাণিতে প্রেমিকের সামনে প্রেমিকার আবেগ। তাঁর বিচ্ছিন্ন সহধর্মিনী, শিষ্যা, সহযোদ্ধা, অতি সশক্ত অভিনত্রী সন্ধ্যা রায় এর লিপে এই গানটি কেউ কোনদিন ভুলবে না, ‘মাথার ঐ গোলাপ দিয়ে মনটা কেন আমার কাছে টানলে’ এমন অজস্র ছবির অসংখ্য গান- তনুবাবুর ছায়াছবির সম্পদ। তাঁর ছবির গান ও দৃশ্য ও যেন সমার্থক হয়ে উঠেছিলো।

৪ জুলাই তাঁর দেহাবসানের পর বিচ্ছিন্ন থাকা স্ত্রী সন্ধ্যা রায় ছুটে হাসপাতালে গিয়েও দেখা পাননি আগে একদিন গিয়ে ও তরুণ বাবুর ভেন্টিলেটরে থাকার কারণে দেখা হয়নি তাঁদের। সন্ধ্যা রায় হাহাকারে অনবরত বলেছেন, “আমি মাটির সংগে মিশিয়ে গেলাম”।

পিতৃপ্রতিম অভিভাবককে হারিয়ে দুঃখে প্রলাপ করছেন, তাঁরই আবিস্কার (যেন এক তাল মাটি দিয়ে মুর্তি গড়া!) মৌসুমী, দেবশ্রী, তাপস, শতাব্দী, মহুয়া এখন আর ইহলোকে নেই। সহজকথা সহজভাবে না বলতে পারলেও তরুণবাবু তা অনায়াসে বলেছেন।

দেখিয়েছেন অনাড়ম্বর জীবন যাপনে যাপিত তরুণ মজুমদার মরণেও তা প্রমাণ করলেন। সঙ্গে ছিল আজীবন বামপন্থী ধারণায় বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার অবসান কালে দেহ মোড়া লাল পতাকায় ও বুকে স্থাপিত ‘গীতাঞ্জলি’।

বিজ্ঞাপন

ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, নীরবে তিনি বিনা আড়ম্বরে বিদায় নিতে চান। কোন জাঁকজমক, তাঁকে নিয়ে পদযাত্রা, সরকারী সম্মান এমন কি একটি ফুল নয়, একটি মালা নয়। তরুণ বাবুর ‘দেহদান’ লিপিবদ্ধ ছিলো। সেই ইচ্ছার সম্মানে যে হসপিটালে তিনি ভর্ত্তি ছিলেন সেই ‘এস এস কে এম’ এই তাঁর দেহ দান করা হয়েছে।

তিনি “পলাতক” নন। তিনি “জীবনপুরের পথিক” । নাম  যে “তাঁর” তরুণ! কোনো শোকযাপন নয়, জীবন যাপন।


Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

শ্রীমতী স্মৃতি দত্ত

অ্যাডভোকেট, লেখিকা, বঙ্গীয় সাহিত্যের সদস্য, কীবোর্ড প্লেয়ার, অ্যামওয়ে ব্যবসার মালিক। আমার লেখা সর্বশেষ বইয়ের নাম, ‘কেমেষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল ও টি.ভি শো’ এবং ‘লেনিন সাহেবের সাথে দেখা’ বইটি Flipkart -এ নেবার জন্য ক্লিক করুন: https://www.flipkart.com/lenin-saheber-sathe-dekha/p/itmc9bfae4c39392

আপনার মতামত জানান?

বিজ্ঞাপন
Back to top button

Discover more from অভিযাত্রী

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading